কলঙ্কময় আগস্ট মাস

ছাবেরা শারমিন | শনিবার , ৬ আগস্ট, ২০২২ at ৫:২৯ পূর্বাহ্ণ

সায়েন্স ফিকশন লেখক হার্বাট জর্জ ওয়েলস যিনি H.G Welse নামে পরিচিত। তিনি ‘WAR OF THE WORLD’ নামে একটি বই লেখেন। বইটি পড়ে মার্কিনিরা এতই বিমর্ষ হয়ে যান যে, তারা ভিন্ন গ্রহের সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের জন্য আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে শুরু করলেন। শান্তি প্রিয় প্রতিটি মানুষই চাই-যুদ্ধ নয় শান্তি। কিন্তু তারপরেও আমাদের চাওয়া-পাওয়ার ব্যবধানে মাঝে মাঝে এমন কিছু ঘটনার জন্ম দেয় যা সম্পূর্ণ অনভিপ্রেত। আর এসব ঘটনার মর্মভেদী দুঃসহ স্মৃতি দিন, মাস বছর যুগের চৌহদ্দি পেরিয়ে আমাদের আমরণ খুঁড়ে খুঁড়ে খায়। তেমনি এক হৃদয় বিদারক ঘটনার মাস হচ্ছে ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাস। তারিখটি ছিল ৬ আগস্ট। পাহাড়ের গা ঘেঁষে ছবির মত দাঁড়িয়ে আছে জাপানের হিরোশিমা নগরী। স্থানীয় সময় সকাল ৭টা। হিরোশিমার মানুষ তখনো জানে না, তাদের মাথার উপর প্যারাসুটে ঝুলছে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ধ্বংস ক্ষমতাসম্পন্ন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কারের ফসল প্রথম পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’। বোমাটি মাটি স্পর্শ করার সাথে সাথে বিদ্যুৎ চমকানোর মতো এক ঝলক আলো দেখা গেলো। চোখ ঝলসানো প্রকাণ্ড এক অগ্নি কুণ্ডলী ফুলে ফেঁপে হিরোশিমা শহরটিকে গ্রাস করতে লাগলো। সে এক নারকীয় ব্যাপার! আগুনের প্রচণ্ড তাপে মানুষের গায়ের চামড়া ঝলসে গেল। অনেকেই একটু শীতল স্পর্শের আশায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। হিরোশিমা নদী মৃত ও অর্ধমৃত মানুষে ভরে গেলো। ঘরবাড়ি দালানকোঠা সব ভেঙে পড়ে তার নিচে অনেকে চাপা পড়ে গেলো। ৩১,৬০০ ফুট উঁচু থেকে নিক্ষেপ করা ১২,৫০০টন ওজন এই বোমার আঘাতে হিরোশিমার যে ক্ষয়ক্ষতির হিসাব আমরা পেয়েছি তা সবটাই আনুমানিক। সরকারি হিসাব মতে, মৃতের সংখ্যা ধরা হয়েছিল ৩৮,০০০ এবং আহতের সংখ্যা ৬৯,০০০। আর বেসরকারি ভাবে মৃতের সংখ্যা ঘোষণা করা হয়েছিল ২ লাখেরও বেশি। বোমাটি বিস্ফোরণের পর যে অগ্নিকাণ্ড ও তাপের সৃষ্টি হয় তার মাত্রা ছিল ৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ‘লিটল বয়’ যে বিমান থেকে নিক্ষেপ করা হয় তার নাম ছিল ‘এ্যানেলো গে’। বিমানে আরোহী ছিল চারজন। বিমানের পাইলট কর্নেল টিরেটস, বোমা নিক্ষেপের দায়িত্বে ছিলেন মেজর ফেরবি, সংযোজনের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন পারসন্স এবং ইলেকট্রনিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন লেফটেন্যান্ট ড্যাপসন। এ মিশনে অংশ নিয়েছিলেন মোট ৭টি বিমান। হিরোশিমা থেকে ১৭’শ মাইল দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের তিনিয়ান দ্বীপের সামরিক ঘাঁটি থেকে পারমাণবিক বোমার আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। হিরোশিমা আক্রমণের দুই দিন পর অর্থাৎ ৯ আগস্ট পারমাণবিক বোমার ২য় আক্রমণ পরিচালিত হয় জাপানের নাগাসাকি শহরের উপর। নাগাসাকির উপর যে বোমা নিক্ষেপ করা হয় তার নাম ছিল ‘ফ্যাট ম্যান’। এ বিমানের পাইলট বিলেন চার্লস সুইনে, নিক্ষেপের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন কারমিট বিহান, বোমা সংযোজন ও ইলেকট্রনিক বিশেষজ্ঞ ছিলেন যথাক্রমে কমান্ডার আশওয়ার্থ এবং লেফটেন্যান্ট ফিলিপ বারনেস। বোমা বিস্ফোরণে শহরটি সম্পূর্ণ ধ্বংসীভূত হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা হামলা করে। এ নৃশংস বোমা হামলায় প্রায় ২ লাখ ২৬ হাজার বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারায়। এটি ছিল বিশ্বে প্রথম কোনো যুদ্ধ যেখানে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছিল। এমন বিস্ময়কর ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বোমা তৈরি করা সম্ভব এমন ধারণা সর্বপ্রথম প্রকাশ করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। আইনস্টাইন জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করলেও সরকারের রোষানলে পড়ে আমেরিকায় পালিয়ে যান। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি বাহিনীর অগ্রগতি ও অত্যাচার দমনে বৈজ্ঞানিকেরা এ ধরনের বোমার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকেন। এ পারমাণবিক বোমা নির্মাণে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তিনি হলেন হাঙ্গেরীয় বিজ্ঞানী লিও শিলার্ড। জার্মান ছিল তার কর্মস্থল। হিটলার কর্তৃক নির্যাতিত হয়ে জার্মান থেকে বিতাড়িত হন। প্রতিশোধ স্পৃহায় লিও শিলার্ড বিশ্বের সব নামকরা বিজ্ঞানীদের একত্রিত করেন এবং আইনস্টাইনকে দিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের নিকট একখানি পত্র লেখেন। ১৯৩৯ সালের ২ আগস্ট চিঠি পেয়ে প্রেসিডেন্ট তাৎক্ষণিক প্রস্তাবে সাড়া দেন। শুরু হয়ে যায় গোপন পরিকল্পনা। বিশ্বের নামকরা নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত পদার্থবিদ, গণিতজ্ঞ, আবহাওয়াবিদ, বিস্ফোরক বিজ্ঞানীদের নিয়ে গঠিত হল সুদূরপ্রসারি প্রকল্প। এ প্রকল্পের নাম দেওয়া হয় ‘ম্যানহাটন প্রকল্প’। ৩৮ বছর বয়সী তরুণ বিজ্ঞানী পারমাণবিক বোমার জনক বলে খ্যাত জুলিয়ার্স রবার্ট ওপেনহেইমারকে এ প্রকল্পের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ৩ হাজার প্রকৌশলী ও হাজার হাজার কর্মীর প্রচেষ্টায় মাত্র তিন মাসের মধ্যে বোমা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৪৫ সালের ১২ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট মারা গেলে ৩৩তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আবির্ভূত হন হ্যারী ট্রুম্যান। ২৪ জুলাই ট্রুম্যান বোমা নিক্ষেপের চূড়ান্ত দলিলে স্বাক্ষর করেন। ১৯৩৯ সালে হিটলারের পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও অগণিত মানুষের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারী ট্রুম্যান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল, রাশিয়ার স্টালিন যুদ্ধ বন্ধে সুদূর ভবিষ্যতের কর্মকাণ্ড নিয়ে আলোচনা করেন। ইতিহাসে এ ত্রিপক্ষীয় বৈঠক ঐতিহাসিক পটসডাম বৈঠক নামে পরিচিত। ১৯৪৫ সালের ৭ মে জার্মানির আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২য় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। ২৫ জুলাই জাপানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্‌বান জানানো হয়। জাপান এ আহ্‌বান প্রত্যাখ্যান করলে বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অবশেষে এলো সেই কলঙ্কময় দিন ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। এদিকে হিরোশিমা নাগাসাকির অবর্ণনীয় ধ্বংসলীলা মানবতাবাদী বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলে। বোমা ফেলার পর ১৫ আগস্ট জাপান আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। শোনা যায়, মানবতাবাদী বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন পরবর্তী সময়ে জাপান সফরে গিয়ে জাপানিদের কাছে করজোড়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তাড়া করে আমাদের। ১৯৫৪ সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী মার্কিন লেখক আর্নেস্ট মিলার হেমিংওয়ের মতো আমরাও কামনা করি- ‘FAREWELL OF ARMS’।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বোয়ালখালী হাজী মো. নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধকথা হোক মৃত্যু নিয়ে
পরবর্তী নিবন্ধতেজদীপ্ত ওয়াসফিয়ার আলোয় উদ্দীপ্ত হোক আগামীর সন্তান