কথা হোক মৃত্যু নিয়ে

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৬ আগস্ট, ২০২২ at ৫:২৮ পূর্বাহ্ণ

কত হবে ছেলেটার বয়স? ৩০ কিংবা ৩১ বছর বয়সী দীপ্তিমান জিতু। ঘুরে বেড়াবার প্রবল নেশা। কিন্তু সময়, সুযোগ আর সামর্থ্য মিলিয়ে ঘুরতে যেতে হতো হিসেব করে। হিমালয়ে ঘুরে বেড়াবার কত্ত পরিকল্পনা! কোনও পরিকল্পনাই আর কখনও বাস্তবে বাস্তবায়ন হবে না। বন্ধুরা বা সহ-ভ্রমণকারীরা ভ্রমণে গেলে হয়তো মনে করবে তার কথা! এভাবে অন্যের স্মৃতিতে ভর করেই তার ভ্রমণ করা হবে হয়তো। নামের মতো করে আর কখনও দীপ্তি ছড়ানো আর হবে না তার।
এই লেখা শুরু করেছিলাম দেশের বাইরে ২০১৭ সালে একা ঘুরে বেড়াবার গল্প বলার উদ্দেশ্য নিয়ে। এতদিন পর মনে হচ্ছে ২০২২ সালের কিছু কথা না বললে যেন সময়ের এই ব্যাবধানকে উতরানো যাবে না। মাঝের ৫ বছরে পুরো দুনিয়ার চেহারা বদলে গেছে। করোনা, যুদ্ধ, ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা- সব মিলিয়ে কেবল ২০১৭ তে আটকে থাকা আর যাচ্ছে না। আর এই সময়ের বাস্তবতায় ‘মৃত্যু’ বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবার কোনও উপায় নেই। বিগত দুই বছরে এই পৃথিবীর মানুষ যত মৃত্যু দেখেছে, এত মৃত্যু স্বাভাবিক নয়।
বলছিলাম দীপ্তিমান জিতুর কথা। চট্টগ্রামের ভ্রমণ পিপাসু ছেলে। জীবনের নানাবিধ ঘটনার স্রোতে জিতু হয়ে গিয়েছিল আমার ছোট ভাই। চাকরি ছাড়ার পর অফিসের বিদায় আয়োজনে জিতু আমাকে উপহার দিয়েছিল একটা ‘হেড লাইট’। একজন ভ্রমণকারীর জন্য, বিশেষত বনে-জঙ্গলে বা পাহাড়ে যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের জন্য হেড লাইট খুব প্রয়োজনীয়। সেই প্রয়োজনের কথা ভেবেই এই উপহার। কিন্তু, কি পরিহাসের বিষয়- প্রায় আট বছরের পরিচয়ের সময়ে ওর সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। আমরা কত কত বার পরিকল্পনা করেছিলাম একসাথে পাহাড়ে যাবার! কিন্তু, হয়নি। তাতে কি! আমাদের ভ্রমণ ছিল অন্যরকম। চট্টগ্রামের ডিসি হিল ময়লা হয়েছে? জিতু তার সংগঠন নিয়ে পরিষ্কাারে লেগে গেছে। কারও চিকিৎসার টাকা লাগবে? জিতু তার পরিচিত মহলে হাত পেতেছে। স্কুলের খাতা কলম লাগবে? তার জন্যে হাত পেতেছে মানুষের কাছে। পাহাড়ে শীতের কাপড় দিতে হবে? জিতু এবং তার বন্ধুরা লেগে গেছে ফান্ড সংগ্রহ করতে। পাহাড়ের স্কুলের শিশুদের গান শেখানোর জন্য, জিতু তার বন্ধুদের গানের দলকে অনুরোধ করেছে এবং তার বন্ধুরা স্কুলে গিয়েছে। এইতো গেল বছর, ক্যান্সারের সাথে জিতুর তখন ভীষণ যুদ্ধ চলছে, কিন্তু জিতু ভোলেনি পাহাড়ে ওই সময় শীতের কাপড় দেয়ার সময় হয়ে গেছে। ওর কয়েকজন বন্ধুর নাম্বার দিয়ে বলেছে যোগাযোগ করে নিতে। একসাথে ভ্রমণে যাওয়া না হলেও, নানাবিধ কাজের মাধ্যমে কখন যে আমরা একটা পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম, আজ আর মনে করতে পারি না। মনে করতে পারি কেবল জিতুর সদা হাসো্যজ্জ্বল চেহারা। সব কষ্টের ভেতরেও বলে ওটা ‘দিদি, কোনও সমস্যা নেই।’
জিতুকে হারিয়েছি জুলাইয়ের ২৮ তারিখ। আমার এখনও সাহস হয়নি একমাত্র ছেলেকে হারানো জিতু’র মা এবং বাবার সাথে কথা বলার। কোনদিন সেই সাহস হবে কিনা তাও জানি না।
এবার সুমন দাদার কথা বলি। সে প্রায় ১৭/১৮ বছর আগের কথা। বোধন আবৃত্তি পরিষদের মহড়া কক্ষ। সুমন দাদার কি একটা কথা শুনে হাসতে-হাসতে ফ্লোরে আক্ষরিক অর্থেই গড়াগড়ি খাচ্ছিলাম। পাশে দাঁড় করিয়ে রাখা ছিল কিছু বাঁশ। কোনও এক অনুষ্ঠান শেষে মঞ্চসজ্জার কাজে ব্যবহৃত বাঁশগুলো মহড়া কক্ষে এনে রাখা হয়েছিল। আমার হাসির ঠেলায় বাঁশগুলো হুড়মুড় করে আমার গায়ের উপরই হেলে পড়তে লাগলো। তা দেখে আমার হাসি আরও বেড়ে গেল। সাথে থাকা অন্য সদস্যরাও হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে ছিল। কিছুটা দূরে বসে থাকা সুমন দাদা লাফ দিয়ে এসে বাঁশগুলোকে আটকাল। তারপর দাদা আফসোস করে বলেছিল, “এইটা যদি বাংলা সিনেমা হত, তাহলে তো এতক্ষণে ডিসি হিলে নাচ শুরু হয়ে যেত!” অনেক বছর সেই সুমন দাদার সঙ্গে আর দেখা হয়নি বিবিধ কারণে। মাত্র ৪৩/৪৪ বছর বয়সী দাদাও চলে গেলেন এই ২৪ তারিখেই।
ভ্রমণকারীদের বেশ কিছু নিয়মের একটি হল, কোনও জায়গায় ভ্রমণে গেলে সেখানকার মানুষের সাথে যতটা সম্ভব কম সম্পৃক্ত হওয়া। সহজভাবে এর উদ্দেশ্য হল মায়া থেকে দূরে থাকা, কোনও এক জায়গায় আটকে না পড়া। কেননা, মায়া মানুষকে আঁকড়ে ধরলে তা থেকে বের হওয়া কঠিন। আর এত এত জায়গায় ভ্রমণ করার পর সব জায়গার মানুষের সাথে মায়ায় জড়িয়ে গেলে তার মানসিক চাপ অনেক বেশি হয়, এতে ভ্রমণের আনন্দ ব্যাহত হয়। কিছুটা স্বার্থপরের মতো শোনালেও, একে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তাই দেখা যায়, বছরের পর বছর যারা টানা ভ্রমণ করে, কিংবা, ভ্রমণ যাদের জীবনের অন্যতম অংশ, তারা খুব কম মানুষের সাথে গভীর সম্পর্কে জড়ায়।
কিন্তু, বাঙালিদের পক্ষে সম্পর্কের ‘মায়া’কে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না। এটি আমাদের জাতিগতভাবে পাওয়া চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ২০১১/১২ এর দিকে মাস্টার্সের থিসিসের কাজে বেশ কয়েকমাস থেকেছিলেম মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া সংরক্ষিত বনের ভেতরের খাসিয়া পুঞ্জিতে। ডিপার্টমেন্টের ডিন পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সেখানকার এক পরিবারের সাথে। খাসিয়া পুঞ্জিতে ঢোকার মুখের ঘর, রোজি দিদির। ওনার বাবা বাঙালি, কিন্তু বিয়ে করেছিলেন খাসিয়া। দিদির বাবা খাসিয়াদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন, আর ওনার প্রতিও তাদের বিশ্বাস এবং আস্থা তৈরি হয়েছিল, ফলশ্রুতিতে দিদির বাবাকে পুঞ্জিতে থাকার অধিকার দিয়েছিল পুঞ্জির রাজা। খাসিয়ারা পুঞ্জি বলতে তাদের গ্রামকে বোঝায় আর রাজা মানে তাদের গ্রামপ্রধান। রোজি দিদির এক ছেলে ইমরান। ছেলেকে নিয়ে দিদি একাই থাকতেন। প্রথম যখন ইমরানকে দেখি তখন ওর বয়েস ছিল ১৩/১৪। দিদি কোনও কাজে বাইরে থাকলে, ইমরান রান্না করত। আমাকে কোনও কাজই করতে দিত না। আমাকে সম্বোধন করত ‘ছোট মা’ বলে। দেখতে দেখতে সেই ইমরানও বড় হয়ে গেল। জীবনের ব্যস্ততায় অনেকদিন আর দেখা সাক্ষাত নেই। অনেক বছর পর ২০২১ এর জুনে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ি। সেই ছোট্ট ইমরান বিয়ে করে এক ছেলের বাবাও হয়ে গেছে। রোজি দিদি আর ইমরান আমাকে নিয়ে গেল চা বাগানের ভেতরে ওর শ্বশুর বাড়ি, মানে আমার বেয়াইন বাড়ি। নতুন বেয়াইন হিসেবে দারুণ আদরযত্ন পেলাম। ইমরান আর রোজি দিদি অনেকবার বলেছে ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছে বছরে একটা মেলা হয় খাসিয়াদের সেখানে নিয়ে যাবে। আমার আর সময় হয়নি। ইমরান ওর জিপ গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন খাসিয়া পুঞ্জি থেকে পান আর লেবু নিয়ে যায় সওদাগরের কাছে। গত বছর আমরা ঠিক করলাম, এই বছর আমি গেলে ইমরানের জিপে করে ঘুরে বেড়াব খাসিয়া পুঞ্জিগুলোতে। ইমরানের মেয়ে হল গত তিন দিন আগে। কিন্তু, মেয়ের মুখ আর ইমরানের দেখা হলো না। আমারও আর ওর সাথে খাসিয়া পুঞ্জি ঘুরে দেখা হবে না। ২২ তারিখ স্ট্রোক করে মারা গেছে ইমরান। একমাত্র সন্তানের মৃত্যু শোককে দূরে সরিয়ে রেখে, ওর মা হাসপাতালে ছেলের বউ আর সন্তানের চিকিৎসা করাচ্ছে।
একবার এক এয়ারপোর্টে একজন ইউরোপিয়ান ব্যাকপ্যাকার মেয়েকে দেখেছিলাম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে। পরে জেনেছিলাম, ওর মা হাসপাতালে। বড়দিনের সময় বাড়ি ফিরে মায়ের সাথে দেখা হবার কথা ছিল। কিন্তু, মায়ের সাথে তার দেখা আদৌ হবে কিনা সে জানে না।
সবাই সব মায়া কাটিয়ে উঠতে পারে না। ভ্রমণ খুব আনন্দের। কিন্তু, সেই সাথে কাছের মানুষদের আবার না দেখতে পাওয়ার ভয় ঘাপটি মেরে থাকে বুকের ভেতরে। ভ্রমণসূত্রে পরিচয়ের গন্ডি বড় হয়, হারানো মানুষের তালিকাও বড় হয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : সৃষ্টিতে অমর
পরবর্তী নিবন্ধকলঙ্কময় আগস্ট মাস