কবিতার হারিকিরি

স্বরূপ সুপান্থ | শুক্রবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

তুমি দূরে যাচ্ছ, চিরকালের দিকে

যতটুকু গেলে মানুষ আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে”

মানুষ নিকটে এলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’ বিনয় মজুমদারের কাব্যিক পাঠাতনে দাঁড়িয়েই কি রিমঝিম এই উচ্চারণ করেছেন! মানুষ থেকে দূরে, মানুষের ভেতরে আসলে কী আছে, যেখানে দাঁড়িয়ে শিল্পীকবিলেখকেরা এমন লিখতে পারেন, বলতে পারেন, এর নির্দিষ্ট কোন উত্তর হয় না, অনুভবের পলিতে শুধু গড়াগড়িই দেয়া যায়। অনুভূতিচূর্ণাংশের এমন অনেক খন্ডবিখন্ড ছড়িয়েছিটিয়ে আছে কবি রিমঝিম আহমেদের সামপ্রতিকতম কবিতার বই ‘কেন আমি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলাম’এ।

প্রতিবার কবিতা পড়ার সময় শিল্প সৃষ্টি হয়’ কথাটা আমার নয়, মহামতি বোর্হেসের। সাহিত্যকর্ম ও চিন্তার জগতে হোর্হে লুই বোর্হেস একজন দিগগজ ব্যক্তিত্ব। তাঁর কথাকে এখানে টেনে এনে বলতে চাই না যে, রিমঝিমের কবিতা পড়ার সময় প্রতিবার শিল্প সৃষ্টি হয়, কিন্তু অনেক অনেকবার তো হয়! বোর্হেসকে ধার করেই যদি বলি, ‘কবির ধর্ম’ শিরোনামের এক অভিভাষণে তিনি বলেন লেখক হওয়ার অর্থ কী? এর অর্থ হলো স্রেফ নিজের কল্পনার কাছে সৎ থাকা। কবি রিমঝিম আহমেদকে ‘কেন আমি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলাম’ কাব্যগ্রন্থে স্রেফ নিজের কল্পনার কাছে সৎ থাকা একজন মনে হয়েছে। তাঁর কিছু কবিতার পংক্তি এখানে উদ্ধৃত করছি, যা পাঠকের মনে হয়ত ‘সুবর্ণ বুদবুদ’ তুলবে

> দেখি, আত্মপ্রতারণার ঘোড়া দাম্পত্যের শস্যখেত মাড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে মেঘবাদাড়ের দিকে।

> স্বেচ্ছাবন্ধনের অপরূপ জট খুলে যেদিন ফিরবে এই কবাটহীন দ্বারে, তোমার অশেষ ঘুমের

সুগন্ধি আমাকে শিখিয়ে দেবে পাখিব্রত।

> দেবদারু ঝাড়ে জোনাকির অন্তর্দহন ধুলোমলিন দিগন্তের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সরল গ্রীবা

> ছদ্ম কাঠুরের কুড়াল পৃথিবীর বাকলে খুদে দেবে আদরের ভাষা

> বসন্তের গাছপালা ক্রমে কুয়াশায় লীন হয়ে এলে, আমি কি তাকে দেব তোমার জন্য তন্ময়

আছরের তাবিজ?

বোর্হেস আরও বলেছেন, যখন আমি কিছু লিখি, সেটিকে আমি তথ্যগত সত্য হিসেবে ভেবে নিই না (স্রেফ তথ্যগত সত্য হলো পরিস্থিতি এবং কাকতালীয় ঘটনার জাল), বরং এটিকে আরও গভীর কোন কিছুর প্রতি সত্য হিসেবে ভাবি। রিমঝিমের কবিতা কি আরও গভীর কোন কিছুর প্রতি সত্য হিসেবে আসে, নাকি তা আলোচনাসাপেক্ষ ব্যাপার, কেননা পাঠকের কাছে সত্যের তো বিভিন্ন রূপ।

তবে মোটাদাগে, কোন ভাষায় রিমঝিম কবিতাগুলো রচনা করেছেন তা কি মহাজাগতিক ভাষা? নাকি ইশারাকম্পন? অথবা সুদূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা ঢেউয়ের মত একেকটি বাক্যের কূলে আছড়ে পড়ার মত বিস্তার! সাদা চোখে তাঁর ভাষা কোমল, আরও মোলায়েম করে বললে ‘মিস্টিক’ এবং তুমিআমির বাইরে কবিতায় খুব একটা বেশি ত্রিশূল তিনি চালান নাই। গোটা বইজুড়ে ৪২টা কবিতা থাকলেও সব মিলিয়ে কি আসলে একটাই দীর্ঘকবিতা! পাঠের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে এই ভাবনা উঁকি দিল। বইয়ের শুরু থেকে কবির বয়ানে ‘তুমি’র প্রাধান্য থাকলেও ২৪ পৃষ্টায় এসে যখন কবি বলেন এবার তবে নিজের কথা বলি। বহুদিন তোমার কথা বলে বলে ভুলে গেছি আমিও আছি। সমান্তরাল। তখন ভেবে নিয়েছি, বইয়ের প্রথম অংশে ‘তুমি’ এবং পরবর্তী অংশে (পৃষ্টা ২৪ থেকে) ‘আমি’র সাথে বোঝাপড়ার কবির সচেতন কাব্যপ্রচেষ্টা। কিন্তু তার ব্যাঘাত ঘটে পৃষ্টা ৪৩এ আবার যখন ‘তুমি’র উপস্থিতি ঘটে। হয়ত টেক্সটকৌশলে এমন কোন চিন্তা কবির ছিল না, আবার হতেও পারে পাঠক হিসাবে এটি আমার অতিভাবনা, তবু কবিতার রস আস্বাদনের কালে টেক্সট যখন খুঁটিয়ে পড়া হয়, তখন কিছু বিষয়, যা আরও সৌন্দর্য (আমার বিবেচনায়) সৃষ্টি করতে পারে, তা থাকলে পাঠ আরও রসময় হয়ে ওঠে।

৪৮ পৃষ্টার এই কবিতার বইয়ের বয়ানভঙ্গি মনোলোগ, অনন্তের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়া আছে প্রচুর, প্রায় সমস্ত কাব্যের ভার বহন করেছে তুমি, আর এইসমস্ত নিয়ে কবি ডুব দিয়েছেন সমুদ্রে। প্রিসাইজ করে বললে দাঁড়ায় এরকম

কথক: আমি

প্রশ্ন করে: অনন্তকে

ভর করে: তুমিকে

ডুবে যায়: সমুদ্রে

এখন কথা হচ্ছে, কথক যখন ‘আমি’ তখন ‘ব্যক্তিকতা’ উজিয়ে কবি কতটুকু ‘নৈর্ব্যক্তিক’ হয়ে উঠতে পেরেছেন? তুলনামূলকভাবে, নিজের হাড়মাংসের জ্বালা আমাদের কবিতায় নারীরা অনেক বেশি গভীর ও সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন/পারেন। যেখানে তাঁরা বিষয়ী/ব্যক্তিক হয়েও রাখঢাকহীনভাবে এত মর্মছেঁড়া কথা বলতে পারেন, তাতে এমন এক বহুমাত্রিক স্তর সৃষ্টি হয় যে, তা ব্যক্তিগতঅসীম অনুসন্ধানী হয়ে ওঠে। রিমঝিম এর ব্যতিক্রম নন। ‘কেন আমি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলাম’এ তাঁর ভাষা স্বতঃস্ফূর্ত ও লিরিক্যাল, আবেগ তার বিভিন্ন জায়গায় আলো ফেলেছে। এখানে তাঁর একটা পুরা কবিতাই পাঠ করা যাক

আমি কোন দেবতার সাথে ঘর করতে চাইনি। তবু কে যেন অসীম

সৌন্দর্য দিয়ে সেলাই করে আমার কাছে পাঠাল এক দেবতাকে। সে

তার রাত্রিখাতা মেলে ধরে আমাকে শেখায় মনিকাঞ্চনখচিত বর্ণমালা।

শিকারশূন্য অরণ্য থেকে হরিণীরা আসে, শেখায় দেবতার বাহুমূলে

আদরের ভাষা। অথচ আমি এমন পূণ্য করিনি যে, বিস্তীর্ণ মাঠের পর

গোলাপেরা আমাকে শেখাবে ঘ্রাণের লিরিক। আমার অপজন্ম

আমাকে অনুসরণ করছে নীরবে, নক্ষত্রের শান্ত মনোলোক দেবতার

কিংবদন্তী পায়ে এসে মেলে ধরে তার কিরণমাখা চুমু। আমি সেই

দেবতাকে পেয়েছি বিনাপুণ্যে, যার হাত ধরে পৌঁছে যাচ্ছি আমার

নিজের থেকেও দূরে।

কবিতা পড়ে পাঠকের আসলে কি হয় এপ্রশ্নের উত্তর খোঁজা অবান্তর। কেননা এর ভেতর কর্ণফুলিতে পানি অনেক বয়ে গেছে। শুধু বাংলা সাহিত্যেও কবিতা অনেক লেখা হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ হয়ত পথ পাল্টে নিয়েছে কিন্তু তা সততই স্বতঃচ্ছল, প্রবাহমান। কবিতাও চেহারাছুরত পাল্টে পাল্টে আবহমানকাল ধরে অনুরণন সৃষ্টি করে চলেছে পাঠকের মনে। বাংলা কবিতার এজার্নিতে রিমঝিম নতুন কি যুক্ত করেছেন? তিনি কি স্বাতন্ত্রতা সৃষ্টি করেছেন ভাষায়, আঙ্গিকে, ছন্দে, সিনট্যাক্সে, উপস্থাপনে? নাকি শুধু কাব্যস্পন্দী হৃদয়আন্দোলনের ভাষা সৃষ্টিতে সীমাবদ্ধ থেকেছেন! বয়স চল্লিশ না পেরোনো কবির ৬ষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘কেন আমি সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিলাম’ পড়ে এই প্রশ্ন বা প্রত্যাশা রাখা কি বাতুলতা? কেননা তিনি তো বলেছেন, ‘অনন্তের পাঠশালায় সুর করে পড়া হবে তোমার সকল শব্দপ্রতিমা’ আর ‘মহানিষ্ক্রমণের পথ’ দিয়ে তিনি ব্যাখ্যা করবেন ‘গহন ফিসফিস’!

তথ্যসূত্র: ‘কবিতার কারখানা’ হোর্হে লুইস বোর্হেসের ধারাবাহিক বক্তৃতা, অনুবাদ অপূর্ব জামান

পূর্ববর্তী নিবন্ধআশি বিঘার মাঠ
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে সিএনজির ধাক্কায় পথচারীর মৃত্যু