আশি বিঘার মাঠ

শুভজ্যোতি মন্ডল মানিক | শুক্রবার , ২৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৮ পূর্বাহ্ণ

মোহনপুর থেকে চরবানিয়া যাতায়াতের জন্য মেঠোপথ ছাড়া বিকল্প কোন রাস্তা নেই। পরিচিত মেঠোপথের উত্তর পাশে যে খোলা মাঠটি দেখা যায় লোকের কাছে তা আশি বিঘা নামে পরিচিত। অবশ্য বর্ষাকালে মাছ চাষ করা হয় এখানে।

শোনা যায় বরিশাল অঞ্চলের আশরাফ আলী নামের এক ব্যক্তির এখানে একদাগে আশি বিঘা জমি ছিলো ; সেই থেকে লোকে আশি বিঘার মাঠ বলে সম্বোধন করে। আশরাফ আলী বছরের শুরুতে একবার এসে বিঘা প্রতি দুই হাজার টাকা করে নিয়ে এক বছরের জন্য ধান মাছ ফলানোর সুযোগ করে দেয় এলাকার মানুষকে।

আশি বিঘার মাঠ হতে লোকালয় খানিকটা দূরে, উচ্চস্বরে চিৎকার করলেও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা সম্ভব না। লোকের মুখে আশি বিঘার মাঠ হলেও বাস্তবে মাঠটি তার থেকে কয়েকগুণ বড়। এঅঞ্চলে আশরাফ আলীর তেমন কোন আত্মীয়স্বজন নেই; সাদাব খান নামে দূর সম্পর্কের এক ফুফাতো ভাই থাকে পাশের গ্রামে। তার বাড়িতে আসাযাওয়ার সূত্র ধরে পাকিস্তান আমলে সস্তায় আশি বিঘা জমি কিনেছিলেন আশরাফ আলী। এক দাগে এতোটা জমি, দুষ্ট লোকের নজরে আসা অস্বাভাবিক নয়। ছলেবলেকলে জমি হাতানোর ফন্দি অনেকের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে; একেতো দূরের মানুষ। শ্রাবণ মাসের শুরু বৃষ্টির ধারা ঝরছে; আশি বিঘার মাঠ এখন রুই কাতলার দখলে। জলে টইটুম্বুর আশি বিঘা, কচুরিপানা কলমি লতার নিজস্ব আড়ৎ। আশরাফ আলী দুপুরের লঞ্চে বেড়াতে এসেছে সাদাব খানের বাড়ি; সঙ্গে আম কাঁঠাল ইলিশ।

দুপুরে খেয়েদেয়ে আশি বিঘার উদ্দেশ্যে বেরোয়; সন্ধ্যাবেলা ফিরে এসে রাতের নামাজটা সাদাব খানের সাথেই পড়বে। বদমায়েশের দল আশরাফ আলীর উপস্থিতি টের পেয়ে তাকে হত্যার প্রস্তুতি নেয়। সন্ধ্যাকালে নৌকায় আশি বিঘার ঘের ঘুরিয়ে দেখানোর কথা বলে কয়েকজন মিলে তাকে নিয়ে মধ্য মাঠের দিকে রওনা দেয়। মধ্যমাঠে পৌঁছাতেই তাকে গলা কেটে হত্যা করে; লাশ পুতে রাখে কলমি লতার ঢিবির ভিতর। কেউ কেউ সন্ধ্যা বেলায় এখনো শুনতে পায়, আশরাফ আলী বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে। অনেকে বলাবলি করে আশরাফ আলী নাকি তার আশি বিঘা জমি রাতেরবেলা নিজেই পাহারা দেয়। উমেশ মাইতি মোহনপুর গ্রামের বাসিন্দা। পেশায় কামলা হওয়ার দরুণ যখন যেকাজ পায় তাই করে। একবার তিন মাসের জন্য আশি বিঘার মাঠে ঘেরের পাহারাদার হিসেবে নিযুক্ত হয়। মাছ ধরাবেঁচা, রাত জেগে পাহারা বসানো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। রাত নয়টার দিকে উমেশ মাইতি ঘের পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্যে নৌকা নিয়ে বেরিয়েছিলো। লোকালয় হতে দেড় কিলো দূরে মধ্য মাঠে গেওয়া গাছের শিকড়ে নৌকা বেঁধে ছুঁইয়ের মধ্যে শুইয়ে থাকে উমেশ মাইতি। মাঝে মধ্যে উঠে টর্চ লাইট মারে চতুর্দিকে। এগারটার দিকে রাতের খাবার খেয়ে নৌকায় বসে বিড়ি টানছে উমেশ মাইতি; একটা বিড়ি শেষ হতে না হতেই আরেকটা ধরায়। টর্চ লাইট এদিকওদিক মারছে; অল্প দূরে টর্চ লাইটের আলো পড়তেই দেখা যায় পাঞ্জাবি গায়ে মধ্যবয়সী কিম্ভূতকিমাকার আকৃতির মুন্ডুহীন একটা লোক উমেশ মাইতিকে হাতের ইশারায় ডাকছে; মাঠের জলে ঢেউ উঠেছে, নৌকা বাতাসে উল্টে যাওয়ার দশা। মনে হচ্ছে নৌকা ধরে কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে মুন্ডুহীন লোকটার কাছে। টর্চ লাইটের আলো ক্রমশঃ ক্ষীণ হচ্ছে যাচ্ছে; লোকটাকে আর সে আলোতে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। দুএক সেকেন্ডের মধ্যে মনে হলো লোকটা নৌকায় উঠে এসেছে; অদৃশ্য কোন শক্তি নৌকাটি নিয়ে আশি বিঘার দাগে থামলো। আশি বিঘার দাগে যাওয়া মাত্রই নৌকা থেকে ঠেলে ফেলে দিলো উমেশ মাইতিকে জলের মধ্যে; অনেকক্ষণ জলে চুবিয়ে ধরলো। উমেশের বুকচিরে কলিজা তুলে মুন্ডহীন গলনালির ভিতরে পুরছে। পরদিন খোঁজাখুঁজির পর উমেশ মাইতিকে পাওয়া গেলো মুন্ডুহীন উলঙ্গ; চোখ দুটো খুবলে খাওয়া অবস্থায়। লোকে বলে আশি বিঘার মাঠে আশরাফ আলীর দাপট বেড়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযৌথভার
পরবর্তী নিবন্ধকবিতার হারিকিরি