কবিতাভাবনা ও জলের চিত্রলেখা

রেদওয়ান খান | শুক্রবার , ৩ জুন, ২০২২ at ৪:৫৩ পূর্বাহ্ণ

কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে তার নানা রকম ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ হয়ে থাকে। কোনটা আধুনিক, কোনটা উত্তরাধুনিক কিংবা হাংরিতাড়িত এসব নিয়ে যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে কলাকৈবল্যবাদিগণ সহস্র মতবাদ ও মতাদর্শ উপস্থাপন করে থাকেন। কিন্তু কবি শুধু তাঁর কবিতাটি লেখেন। লেখার বিষয়বস্তু তাঁর রয়েছে বলে লেখেন। তিনি লিখতে পারেন, এ তাঁর নিজস্ব ক্ষমতা, তাই লেখেন। সেই কবিতাকে কালসূত্রে রাঙিয়ে তোলেন প্রথমত পাঠক এবং দ্বিতীয়ত এইসব বোদ্ধাগণ, কবিতাকে যাঁরা শ্রেণিভেদে অংকের সূত্রে ফেলে দিয়ে ‘ইজম’ বিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করে থাকেন। তাঁরা হয়তো একটা স্বীকৃতি প্রদানেরও চেষ্টা করে থাকেন। এতে কবির, যিনি নিরন্তর লিখে যাচ্ছেন, তিনি কি বিশেষ কোনও পথের দিশা পান? এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া কঠিন। তবে আমাদের মনে হতে পারে, এতে কবি অনুপ্রাণিত বোধ করতেই পারেন, আবার নাও করতে পারেন। তাঁর কাজ তিনি করে যান শব্দ, উপমা এবং বাক্যের অনুবন্ধে। এখানে কবির আত্মা মূলতঃ তাঁরই সত্য উপলব্ধিকে ভাষা দান করে সেখানে প্রকৃতিপ্রাণের অমরত্ব প্রতিষ্ঠা করে থাকেন।

প্রখ্যাত কবি ও ক্রিটিক উইলিয়াম ওয়ার্ডস্‌অর্থএর মতে Poetry is as immortal as the heart of man /কবিতা মানুষের আত্মার মতোই অমর। আবার কবিতা লেখা বিজ্ঞানের জটিল সমীকরণ মিলানোর চেয়েও কঠিনতম হয় কখনও, তবে কবিতায় যাঁর দিনাতিপাত তিনি, সেই রচয়িতা, কবি তো কবিতায় অবগাহন করেন নিজের ভিতরে উদ্ভুত এক ঝর্ণাধারায়। ফলে, কবিতায় অবগাহন করতে গিয়ে কবি হয়ে ওঠেন সময়, জীবন ও প্রকৃতির এক নিরন্তর ভাষ্যকার, সত্যদ্রষ্টা। সেখানে জীবনের ছোট ছোট উদ্‌যাপনগুলো কীরকমভাবে আলো ফেলে কবির অন্তরে তারই এক অনবদ্য চিত্রলেখা সাবিনা পারভীন লীনার কবিতাগ্রন্থ ‘জলের চিত্রলেখা।’

সাবিনা পারভীন লীনার কবিতার প্রবণতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সীমার মাঝে অসীমের কল্পনাময় এক নিজস্ব অনুসন্ধানপ্রচেষ্টা। চেতনেঅবচেতনে সীমার মাঝে অসীমের অনুসন্ধানী কবি রবীন্দ্রনাথের ছায়া জলের চিত্রলেখাসহ কবির অন্যান্য রচনায়ও বিস্তৃত হতে দেখি। জলের চিত্রলেখা’র কবিতাগুলো শারীরিক আকারে খুব একটা দীর্ঘ নয়, ছোট ছোট চিত্রকল্পঅনুভবে, দীর্ঘ এক আবেশ নির্মাণ করে যায় পাঠকের অন্তরে। পাঠক অন্তরে আনন্দ অনুভব করে একটা প্রশান্তিতে স্থিতি লাভ করেন।

আমাদের স্মরণে আসে, ‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে কবি জীবনানন্দ দাশকে বলতে দেখি ‘মহৎ কবির ভার সূক্ষ্ম, হৃদয় আন্তরিক (আশা করা যেতে পারে), সৎ কবিতা খোলাখুলিভাবে নয়, কিন্তু নিজের স্বচ্ছন্দ সমগ্রতার উৎকর্ষে শোষিত মানব জীবনের কবিতা.. ..কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, কবিতা ও শিল্পসৃষ্টির ভিতরেই তিনি (কবি) ঢের বেশি স্বাভাবিক ও বরণীয় এমনকি অধিকতর মহৎ; বাস্তব কার্যক্ষেত্রে তেমন নন।’

আবার ‘কবিদের কবি’ বুদ্ধদেব বসু বলছেন, ‘কবিতা সম্বন্ধে বোঝা কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক। কবিতা আমরা বুঝিনে, কবিতা আমরা অনুভব করি। কবিতা আমাদের কিছু বোঝায় না; স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা সংযোগ।’ (কবিতায় দুর্বোধ্যতাঃ বুদ্ধদেব বসু)

আমাদের মনে হয়, কবিতা লেখা যেমন চ্যালেঞ্জ, কবিতার পাঠক হিসেবে কবির লেখা কবিতার মনোবিশ্বে চারণ করাও বিরাট এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু সাবিনা পারভীন লীনার কবিতা কিছুতেই দুর্বোধ্য নয়, বরং আমাদের অন্তরকে তাঁর কবিতা স্পর্শ করে, স্থাপন করে একটা মনোগভীর সংযোগ। আমরা কবিতা পাঠের একটা নিবিড়মৃদুআনন্দ অনুভব করতে পারি। এখানেই কবি তাঁর নিজস্বতা নিয়ে ধরা দেন পাঠকের কাছে। সুতরাং দেখতে পাই, তিনি শব্দ ব্যবহারে সাবলীল, উপমা ও প্রতিতুলনা নির্মাণে একটার পর একটা পর্দা ফেলে অনির্বচনীয় জাদুমায়া বিছিয়ে দিতে পারেন তাঁর কবিতার শরীর ঘিরে।

তাহলে জলের চিত্রলেখাকে কি ধরনের কবিতা বলে আমরা নির্ণয় করব, এ নিয়ে জলঘোলা না করে আধুনিক কবিতা বলতে যে ক্রমশঃ পরিবর্তনকেই ইঙ্গিত করে তাই বিবেচনায় আনতে পারি। সাম্প্রতিক সময়ে কবিতা নিয়ে আহমদ রফিক এক প্রবন্ধে বলেন, ‘বাংলাদেশে সামপ্রতিক কবিতা বিচ্ছিন্ন ছোট ছোট ব্যক্তিক বৃত্তে বাঁধা। সেখানে সবাই নিজ নিজ ধারায় আধুনিক।’ (আহমদ রফিক, কবিতার বিষয় ও প্রকরণবৈচিত্র্য। কালি ও কলম।। জুন ৫, ২০১৭)

সাকুল্যে ছাপ্পান্নটি কবিতার সম্মিলন ঘটেছে জলের চিত্রলেখায়। আধুনিক কবিতায় শক্ত, দুর্বোধ্য শব্দকল্পের ব্যবহার অনিবার্য কিনা সে প্রসঙ্গ ভিন্ন। এইখানে, জলের চিত্রলেখায় দেখতে পাই, ছোট ছোট পংক্তি রচনার মধ্য দিয়ে কবি সাবিনা পারভীন লীনা সহজ কিন্তু ইঙ্গিতময় কবিতা রচনার প্রয়াস পেয়েছেন। ব্যক্তিজীবনের ফেলে আসা সময়স্মৃতিকল্পের জন্য একটা আকুতি বার বার ফিরে এসেছে তাঁর কবিতার শৈলীতে, শব্দের ব্যবহারে, উপমার আভরণে।

শক্তিমান কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘সত্যি বলা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই কবিতার।’ (শঙ্খ১৯৭০) সাবিনা পারভীন লীনার কবিতায় যাপিত জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘সত্য’ই আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত হয়েছে বার বার। কী আছে সেখানে, সেই সব কবিতামালায় ? আছে শেষ বিকেলের আলো, নদীর জলে ঘুড়িস্বপ্ন শৈশবকৈশোর। বিকেলের সাতকাহন, সোনালু, জারুল আর শিরীষের ডালে মায়াবী অন্ধকার। সেই দিনশেষের হিসবেনিকেশে কি ছিল কোনও বিশেষ কিছু হারানোর দুঃখবোধ? না হলে মায়াবী অন্ধকারের একটি টুনটুনি কেন ডেকে ডেকে বলে যায় তার দুঃখদিনের সাতকাহন ! কবিতাগুলো পড়তে পড়তে আমরা ফিরে যাই গহন অরণ্যে, নদীর ঢেউয়ে, ঘুড়িওড়া বিকেলে এবং দয়িতের প্রেমময় আলিঙ্গনে।

যদি পাঠ করা যায় একটি কবিতা, যেমন, ‘দূরের শহর’ কবিতাটি

দূরের শহর একদিন দিয়েছিল

কম্পন জাগানো এক জলের খনির সন্ধান

অথবা যখন আমরা পাঠ করি, তখন কবির অনুভবে পাঠকও জারিত হন এইভাবে

অন্তহীন আশা নিয়ে কেটে গেল

কত দীর্ঘ দিন, দীর্ঘ রাত

জলের খনিতে আজ প্রকৃতির রুদ্ররূপ

তোমার শহরে সেই মুগ্ধতার সন্ধ্যা

আর আসেনি।

কবিতায় সত্য বলতে কিছু কি খুঁজতে চায় পাঠক? মুগ্ধতার সন্ধ্যার জাদুতেও কি থাকে না এক ধরনের কাব্যিক সত্য ?

এদেশের প্রকৃতি ও মানুষকে যেমন কবিতার উপজীব্য করেছেন, তেমনি, একই সঙ্গে তাঁর রচিত পংক্তিতে এসেছে বাংলার লৌকিক শব্দ ‘দিয়াভুত’ এবং গ্রিক পৌরাণিক চরিত্র ‘দিমিতি’। লিখলেন কাব্য শিরোনাম ‘জননী, করো কৃপা’, কারণ, যাপিত জীবনে এক ধরনের নিষ্ফলা কালের উপস্থিতি কবিকে ব্যথিত করে বিধায় গ্রীক মিথ শস্য ও কৃষির দেবীকে স্মরণ করলেন।

বাংলা জনপদের লৌকিক শব্দাবলীও তুলে আনেন তাঁর সাবলীল প্রকাশ রীতিতে। ‘নদীর নাম আনন্দ’ কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে

বাদাম গাছের বড় বড় পাতার নিচে ছোট্ট বিকেল

নির্ভরতার হাত ধরে দুলে ওঠা সাম্পান

একটি প্রাচীন শব্দ ঠোঁটের কাছে একবার আনতে

দিয়া ভূতে’ পাওয়ার গল্প শোনানো।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের লোকজীবনে, কোথাও কোথাও ‘দিয়াভূত’ শব্দটি ‘দিয়াভুল’ রূপেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, যার অর্থ এক ধরনের ভূতে পাওয়া বা বেসামাল অবস্থা, যাতে করে করোটির ভিতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। সবকিছুই তখন মোহগ্রস্থ এক বিবমিষায় পরিণত হয়। চৈতন্যও কি ক্ষণিকের জন্য বিলুপ্ত হয়, হয়ে যায়?

তাঁর অন্যতম প্রিয় অনুষঙ্গ দেখতে পাই বৃষ্টি ও বর্ষণ। কবিতার শিরোনাম ‘নীল পাখিতে’ দেখি তারই অনবদ্য প্রকাশ।

সারাটি রাত বৃষ্টি হলো।

গ্রিলে বসে আছে নীল পাখিটি,

এত বর্ষণেও ভিজল না তার

শরীর জুড়ে ব্যথার পালকগুলো’

ব্যক্তির চাওয়া, ক্ষুদ্র আশাস্বপ্নভঙ্গআনন্দ, যন্ত্রণা এ সব লৌকিক জীবনাচরণউপাচার উদযাপন করছেন কবি তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে। ব্যক্তি যদি হন ঈশ্বরের মতোই একা, নিঃসঙ্গ, তবে লীনার কবিতা এক ধরনের একাকীত্বযাপনের কবিতাও।

ফেলেআসা জীবন ও জনপদ বারবার কবিকে তাড়িত করেছে। তাঁর কবিতায় এসেছে অভয়মিত্র ঘাটের মাঝি প্রসঙ্গসহ পথের ধুলো, শুকনো মরা ডাল, বায়স্কোপ, শিউলি বোঁটার রঙ, বাঁশের ভেলা, কাটাঘুড়ির নীরব কান্না, শুকতারা, পাখি, শিশির বিন্দু, গোধূলি গগনের সোনালি আভা, বর্ষার ধারাপাত, ঘাসফড়িং, কৌতূহলে ভরা মুখোশহীন শৈশব। তাড়িত করেছে চিরকালীন মাতৃত্ববোধ। আত্মজ১ ও ২এ তার প্রামাণ্যতা মেলে।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কবির নিবিড় সংযোগ ও প্রভাব দেখি, বাক্যে যখন ব্যবহৃত হয়..সময় বয়ে বেড়িয়েছে জীবনের যত ভার/রক্ত ঝরিয়েছিল যত ক্ষত, যত প্রেম

(প্রতিতুলনীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের , ‘ক্ষত যত ক্ষতি তত মিছে হতে মিছে/ক্ষণিকেরও কুশাঙ্কুর পড়ে রবে নীচে”)

বোলপুর’ কবিতায় অনুভব করেছেন চিরকালের কবি রবীন্দ্রনাথকে, যিনি কবির পরম আরাধ্য, অনুপ্রেরণা। লিখলেন

বোলপুরের লালমাটি আর শালবনের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে

আহা, গানের ভেতর আমি কেবল তাকেই দেখি,

তারই কাছে যাই,আমার ভুবনে

(বোলপুর)

ব্যবচ্ছেদের আগে’ কবিতায় এসে তিনি আমাদের বিস্মিত করে দিয়ে উচ্চারণ করেন,

নিথর দেহটি তখনো অপেক্ষা করতে থাকবে,

তার চোখের তারায় এক ফোঁটা অশ্রু কী জমেছে?

ভালোবেসে এটুকুই চেয়েছিল, বেশি কিছু নয়।

জলের চিত্রলেখা

প্রকাশকবাতিঘর, চট্টগ্রাম। প্রচ্ছদরাজীব দত্ত, প্রকাশকাল১৪২৪

পূর্ববর্তী নিবন্ধচোখের জলে শেষ বিদায়
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণে-বরণে পিতার জীবন