বঙ্গবন্ধু এক অনন্য রাষ্ট্র কাঠামো দিতে চেয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে মূলভিত্তিক সংবিধান প্রণয়ন করেন। যা ‘৭২–এর সংবিধান’ রূপে খ্যাত। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রচ্ছন্ন অনুভব। অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক হিংসা, জাতিগত নিপীড়ন ও ধর্মান্ধতা থেকে মুক্তির জন্য এই সংবিধান এক সুশাসনের কাঠামোর জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও দূরদর্শী পদক্ষেপ মানুষকে বাঁচতে শিখিয়েছিল, উজ্জীবিত করেছিল।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম অধ্যয়ন কেন্দ্রের চিন্তাপত্র ‘দ্বান্দ্বিক’। এবারকার বিষয় : ‘স্মরণে বরণে পিতার জীবন’ শীর্ষক মুজিববর্ষ সংখ্যা। সম্পাদক করিম আবদুল্লাহ এর প্রকাশ সম্পর্কে বলেন : ‘মুজিববর্ষের মহাসমারোহ ও আলোকজ্জ্বল আনন্দ উচ্ছ্বাসের নিচে প্রদীপের অন্ধকার ছায়ার মতো এক করুণ মহা বিবর্জনচিত্রও লক্ষ্য করা গেছে যা বাঙালি জাতির মহাবীর মুজিবরের জীবনের অন্তিম অধ্যায়ের বিষাদরঞ্জিত অসহায়ত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। অগণন প্রতিভাবান প্রতিষ্ঠিত মানবের কণ্ঠে ও কলমের কালিতে মুজিব বন্দনার অসংখ্য গুণ–কীর্তন উচ্চারিত, রচিত ও প্রতিধ্বনিত হলেও তাঁকে যে অপরাধে, প্রখ্যাত গণসংগীত শিল্পী ফকির আলমগীরের গানের ভাষায় ‘পশ্চিমা পুঁজিবাদ’ সবংশে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল এবং নির্মমভাবে তা কার্যকর করেছিল, নিপীড়িত–শোষিত মানুষের মুক্তির একমাত্র পথ সেই ‘অভিশপ্ত’ সমাজতন্ত্রে তাঁর লৌহকঠিন প্রত্যয় এবং তা বাস্তবায়নে তাঁর পরিণত অধ্যায়ের কথা আমাদের পত্রিকার বাইরে কদাচিৎ উচ্চারিত হয়েছে।’
মুজিববর্ষ সংখ্যার বিশেষত্ব নিয়ে এই কথাটি তুলে ধরলে আপাত পরিষ্কার হওয়া যায়। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পাঠ এখানে পাই। বাংলাদেশ ও পশ্চিবঙ্গের বেশ ক’জন সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক চিন্তকের ধারাবাহিক ভাবনায় সমৃদ্ধ হয়েছে।
ভূমিকাস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের ভাবনার সংযোগ চিরকালীন। ড. অনুপম সেন শুরুতেই এই মুজিবর্ষ সংখ্যা সম্পর্কে মন্তব্য রাখেন : ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ যেন হয় একটি প্রকৃত শোষণমুক্ত দেশ। সে স্বপ্নের দেশ পেতে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আরও বহুদূর যেতে হবে; কারণ, এখনও আমাদের দেশে প্রায় চার কোটি লোক দারিদ্র্য সীমার নীচে বাস করছে। তাদের প্রকৃত অর্থেই দারিদ্র্যমুক্ত করতে হবে, মানবিক জীবন দিতে হবে। এই গ্রন্থে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নকেই বিশেষভাবে তুলে ধরা হয়েছে।’
‘কেন তিনি আজ এত প্রাসঙ্গিক : শেখ মুজিবের সুচিন্তা থেকে আজকের বাঙালিরও শেখার আছে’ শিরোনামের প্রবন্ধে ভারতের বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন লেখেন : ‘বঙ্গবন্ধু তাঁর নৈতিক আদর্শগুলির সঙ্গে বাংলার পুরনো মূল্যবোধের সম্পর্কের কথা অনেকবারই বলেছেন। সমতার প্রতি তাঁর আগ্রহের তেমন কোনও ঐতিহাসিক যোগসূত্র আছে কি? উত্তরে বলা যায়: হ্যাঁ, আছে। যেমন, অনেককাল আগে থেকেই বাংলার সমাজসচেতন কবি ও চারণদের কবিতায় সমতার ধারণাটি গুরুত্ব পেয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের মতো বিদ্রোহী কবির লেখায় তো বটেই, একেবারে প্রথম যুগের বাংলা কবিতাতেও এমন সূত্রের সন্ধান আছে।’
লুটেরা পুঁজিপতিদের এক সমীক্ষা লক্ষ করি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম প্রবন্ধে : ‘১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি বর্বর পাঞ্জাবিদের ঔপনিবেশিক শোষণ ও লুন্ঠন থেকে মু্ক্তি পেয়েছে। কিন্তু, এই জাতির ‘অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম’ সফল করার জন্যে আমাদের সুকঠিন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে আরো বহুদিন। এই সংগ্রামে জয়ী হতে হলে এখন প্রথম অগ্রাধিকার দিতে হবে জাতির উন্নয়নের যাত্রা পথের সবচেয়ে বড় বাধা দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং বিদেশে পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামকে।’
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে লেখেন ড. মাহবুবুল হক : ‘বঙ্গবন্ধু নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে গণপরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের যে সংবিধান রচনা করেছিল তাতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হয়েছিল; গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন একাত্ম হয়ে গিয়েছিল বাঙালির জাতীয় আশা–আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। হয়ে উঠেছিল জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি ও আত্মনির্মাণের মূলমন্ত্র।’
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অঙ্গীকার করা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমেই ক্ষমতার সুবিচার্য বিষয় নিয়ে কাজ শুরু করেন। আক্ষেপ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সব ধুলিসাৎ হয়ে যায়। রাজনীতি–ইতিহাস বিশ্লেষক শাহরিয়ার কবির এক প্রবন্ধে লেখেন : ‘বঙ্গবন্ধু সরকার মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের বাসস্থান ও ভাতার ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ’৭১–এর গণহত্যাকারী এবং তাদের সহযোগীরা ক্ষমতায় এসে বহু শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারকে বাড়ি থেকে উৎখাত করেছে। যারা শহীদ পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের লাঞ্ছিত করেছে তাদের বিচার ও শাস্তির আওতায় এনে গণহত্যার ভিকটিমদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।’
বাংলাভাষাকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর গণপরিষদে উত্থাপন ও পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করে মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান। তিনি লেখেন : ‘বাংলাকে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রভাষা করেছেন। তাই বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল সদ্য স্বাধীন দেশে রাষ্ট্রের সব কাজেই বাংলা ব্যবহৃত হচ্ছে। ৭৫– এর এই আদেশ বলে দেয়া রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার ব্যবহার চালু হয়নি। এর অনেক বছর পর ১৯৮৭ সালের ৮ মার্চ বাংলা ভাষা প্রচলন আইন পাশ হয়। এই আইনে বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সাথে যোগাযোগ ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে নথি, চিঠিপত্র, আইন আদালতে সওয়াল–জওয়াব, অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলী অবশ্যই বাংলায় লিখতে হবে এবং কোন ব্যক্তি বাংলা ব্যতীত অন্য কোন ভাষায় আবেদন বা আপিল করলে সে আবেদন বেআইনী ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। আইনে আরও বলা আছে যদি কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারী এই আইন অমান্য করেন তবে তা সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপীল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এটাও টনক নাড়াতে পারেনি ক্ষুদ্র কিন্তু শক্তিশালী বাংলাভাষাবিরোধী মহলের। এই আইন অমান্য করার দায়ে কারো সাজা পর্যন্ত হয়নি।’
‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথেই থাকতে হবে বাংলাদেশকে’ নিবন্ধে কবি ও সাংবাদিক কামরুল হাসান বাদল লিখেন : ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে যে অপশক্তির উত্থান ঘটেছিল তার বিনাশ সম্ভব হয়নি। বরং তা নানা রূপ, নানা রঙে এবং নানা কৌশলে আরও বিস্তার লাভ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য যে শক্তিটি শুরু থেকে সক্রিয় ছিল যে শক্তির সাথে আরও নতুন নতুন শক্তির যোগ হয়েছে। এবং এদের আক্রমণের লক্ষ বঙ্গবন্ধু থেকে তার কন্যা শেখ হাসিনা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।’
এই অশনি আয়োজনের দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শাসন চালিয়ে নেওয়া বড় শক্তিধর হতে হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই চেষ্টায় নিয়ত নিয়োজিত রেখেছেন নিজেকে।
মুজিববর্ষ সংখ্যা এই আয়োজনে আরও লিখেছেন বেগম মুশতারী শফী, বিমল গুহ, মোহীত–উল–আলম, দুল্লাহ, জামাল উদ্দিন, আনোয়ারা আলম, আজিজ কাজল, নিজামউদ্দিন আহমদ, এ বি এম ফয়েজ উল্যা, খালেদ হামিদী, আজাদ বুলবুল, জিললুর রহমান, মহিউদ্দিন শাহ আলম নিপু, মো. আতিকুল ইসলাম। কবিতা লিখেছেন : ময়ুখ চৌধুরী, নিতাই সেন, রিজোয়ান মাহমুদ, ওমর কায়সার, হাফিজ রশিদ খান, আবু মুসা চৌধুরী, আকাশ মাহমুদ, রাশেদ রউফ, আলেক্স আলীম, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, শ ম বখতিয়ার, তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, খালেদ মাহমুদ মোর্শেদ, শাহীন মাহমুদ, মনিরুল মনির, চন্দন চৌধুরী, ফারজানা রহমান শিমু।
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষকালে তাঁর জীবন ও কর্মের আলোকে এক জাতির এক দেশের অর্জন, স্বপ্ন ও প্রেরণাকে গতিশীল করে সংকলনটি। এটি বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের জন্মসূত্রের দলিলরূপে সকলের কাছে সমাদৃত হবে বলে আশা করা যায়।
দ্বান্দ্বিক– স্মরণে বরণে পিতার জীবন– মুজিববর্ষ সংখ্যা।
সম্পাদক : করিম আবদুল্লাহ। প্রচ্ছদ : দীপক দত্ত। মূল্য : ১৫০ টাকা।