কবরী একটি নদীর নাম

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ২৬ এপ্রিল, ২০২১ at ৭:১৪ পূর্বাহ্ণ

১ম পর্ব

জীবন সে তো এক নদী। উৎস থেকে তার চলার শুরু। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তার বয়ে চলা। বয়ে চলে অবিরাম। মোহনার অভিমুখে তার অবিরত ছুটে চলা।
কবরীও তেমনি একটি নদীর নাম। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রাম থেকে উৎসারিত হয়ে ঢাকার বনানী সমাধিক্ষেত্রে তার মোহনা। ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত সেই বয়ে চলা। অবিরাম অবিরত।
কোভিড ১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার (৫ এপ্রিল) আগ পর্যন্ত তিনি কাজ করে গেছেন। অনুদানপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘সেই তুমি এই তুমি’র সম্পাদনার কাজ করছিলেন। আসন্ন ঈদে ছবিটি মুক্তি দেবার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। এটি তাঁর পরিচালিত দ্বিতীয় ছবি, যেটির কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ, গান তাঁরই রচিত। প্রথম ছবি আয়না মুক্তি পায় ২০১৫ নামে যেটি ঐ নামের একটি মেয়ের ভাগ্য বিড়ম্বনা নিয়ে নির্মিত। দ্বিতীয় ছবিটি নিয়ে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন। অনেক পরিকল্পনা করে ছবিটির কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন।
কবরীর আবিষ্কর্তা সুভাষ দত্ত। ‘সুতরাং’ ছবিটি নির্মাণের সময় সুভাষ দত্ত নতুন একজন কিশোরী অভিনেত্রীর সন্ধানে ছিলেন। যিনি তাঁর বিপরীতে অভিনয় করবেন। নৃত্যে দক্ষতা থাকতে হবে কিশোরীর। কারণ ছবির তিনটি গানে নৃত্যের প্রয়োজন রয়েছে। চরিত্রটিও এক কিশোরীর। ছবির সংগীত পরিচালক সত্য সাহা ও প্রযোজক চিত্ত চৌধুরী দুজনই চট্টগ্রামের। তাঁরা চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠক ডা. কামাল খানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি চট্টগ্রামের কিশোরী নৃত্যশিল্পী মিনা পালের কথা বলেন, যিনি তখন জে.এম. সেন স্কুলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। নাচ শিখছেন নৃত্যগুরু রুনু বিশ্বাসের কাছে। সবার সঙ্গে মিনা ঢাকা যান বাবাকে নিয়ে। অডিশন ও স্ক্রিন টেস্টে উত্তীর্ণ হলে সুভাষ দত্ত তাঁকে ‘সুতরাং’ ছবির কিশোরী নায়িকা করিনার ভূমিকায় কাস্ট করেন। এবং ১৩ বছরের কিশোরী মিনার নতুন নামকরণ করেন ‘কবরী’। ছবির কাজ শুরু হয় ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায় ৬৪ তে। সুপার ডুপার হিট সে ছবি সে-সময় তিন কোটি টাকা মুনাফা করে। সেই থেকে তাঁর কেবলই এগিয়ে চলা যার সমাপ্তি মৃত্যুতে। শেষ অভিনয় ২০১২ সালে গাজী জাহাঙ্গীর পরিচালিত রাজা সূর্য খাঁ ছবিতে মহারানি চরিত্রে। ৫৭ বছরের সুদীর্ঘ ফিল্ম ক্যারিয়ারে অভিনীত ছবির সংখ্যা দেড়শোর মতো। এর মধ্যে অধিকাংশই উল্লেখযোগ্য।
প্রথম ছবি ‘সুতরাং’ নির্মাণগত দিক থেকে শিল্পমান সম্পন্ন ছিল। প্রথম ছবিতেই কবরী তাঁর অভিনয়ের জাত চিনিয়ে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে প্রথম থেকে এখনো অভিনয়গত একটি দুর্বলতা রয়ে গেছে। দৈহিক ও বাচিক অভিনয়ের সুষম সমন্বয় খুব কম জনের মধ্যেই দেখা গেছে। কবরী সেই খুব কম জনের একজন যাঁর অভিনয়ে বডি ল্যাংগুয়েজ ও ভয়েস মডিউলেশনের সুন্দর সমন্বয় লক্ষণীয়। এক্ষেত্রে তাঁর শান্ত স্নিগ্ধ সৌন্দর্যও যুক্ত হয়েছিল। সে-সৌন্দর্য ঝাঁঝালো নয়। আটপৌরে বাঙালিয়ানায় ভরপুর। যে-কারণে বাঙালি দর্শক তাকে পাশের বাড়ির নয়। নিজের বাড়ির মেয়ে বলেই শুরুতেই গ্রহণ করে নিয়েছে যেটা শেষ পর্যন্ত অক্ষুন্ন ছিল। গ্রামীণ চরিত্রে তিনি যেমন অসাধারণ (সুতরাং, ময়মনামতি, কখগঘঙ, বিনিময় আপনপর, লালন ফকির, তিতাস একটি নদীর নাম, সুজন সখী, সারেং বৌ, আরশি নগর, বধূ বিদায়….), তেমনি নাগরিক চরিত্রেও সমান সাবলীল (বাহানা, আবির্ভাব যে আগুনে পুড়ি, ঘুর্ণিঝড়, আগন্তুক, নীল আকাশের নিচে, দীপ নেভে নাই, দর্পচূর্ণ, আঁকাবাঁকা, অধিকার, ত্রিরত্ন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, স্মৃতিটুকু থাক, জলছবি, লাভ ইন সিমলা, দুই জীবন…) অর্থাৎ অভিনয় প্রতিভা ছিল তাঁর সহজাত। ক্রমান্বয় অভিনয়-চর্চা সে প্রতিভাকে আরো পরিণত করেছে।
রূপকথা ভিত্তিক কয়েকটি ছবিতে (সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণ মালা, পারুলের সংসার) অভিনয় করলেও পোশাকী ছবিতে কাজ করেননি। মতিমহল ছবিটি খানিকটা পোশাকী ঘরানার এবং এই ছবিতেও তিনি অভিনয় দক্ষতা দেখিয়েছেন। এর ফলে তাঁর অভিনয় বৈচিত্রের দিকটি উন্মোচিত হয়। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবিতে তিনি তেমন ডাক পাননি। রক্তাক্ত বাংলা, আমার জন্মভূমি, লাল সবুজের পালা এবং কলমিলতা এই চারটি ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। এ নিয়ে তাঁর খুবই অনুযোগ ছিল, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছবিতে অনেকটা উপেক্ষিত ছিলেন।
তেমনি আরেকটি উপেক্ষা, পুরস্কারের বেলায়। মাত্র একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি সারেং বৌ ছবিতে নবিতুন চরিত্রে অভিনয়ের জন্যে ১৯৭৯ সালে। আরেকবার পেয়েছেন আজীবন রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ২০১৩ সালে। অথচ পুরস্কার প্রাপ্তিযোগ্য অনেক অভিনয় তিনি উপহার দিয়েছেন বিভিন্ন ছবিতে। আমার মনে হয় এর নেপথ্যের কারণ রাজনৈতিক। তিনি যে-দলের প্রত্যক্ষ রাজনীতি করতেন, সে-দল যখন ক্ষমতায় আসে তিনি তখন অভিনয় থেকে কিছুটা দূরে সরে গেছেন। তবে বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন পাঁচবার যথাক্রমে লালন ফকির, তিতাস একটি নদীর নাম, সুজন সখী, সারেং বৌ এবং দুই জীবন ছবিতে অভিনয়ের জন্যে।
প্রত্যেক অভিনয় শিল্পী এবং পরিচালকের একটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র থাকে যেটিকে তার আইডেনটিটি ফিল্ম বলা হয়। কবরীর ক্ষেত্রে সেটি অবশ্যই ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত তিতাস একটি নদীর নাম। এই ছবি বিশ্ব চলচ্চিত্রের সেরা একশটি চলচ্চিত্রের একটি হিসেবে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সিনেমা ফাউন্ডেশনের স্বীকৃতি পেয়েছে এবং এর প্রধান অধিকর্তা চলচ্চিত্রকার মার্টিন স্করসেসের দায়িত্বে ছবিটি ডিজিটালাইজড করা হয়েছে। এই ছবিটি সূত্রেই কবরী বিশ্ব চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আসন পেয়ে গেছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর অভিনীত সবচেয়ে প্রিয় ছবি ছিল সারেং বৌ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ-এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধশঙ্খ ঘোষ নিঃশব্দের শব্দচিহ্ন