কংগ্রেস-মুসলিম লীগের চেয়েও আওয়ামী লীগের সাফল্য বেশি

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ১৭ আগস্ট, ২০২৩ at ৮:৩৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমীর হোসেন দোভাষের পুত্র আবদুল লতিফ দোভাষ ও আবদুর রহমান দোভাষ আওয়ামী লীগ করতেন। কিন্তু দু’জনই আজ পরপারে। এখন নবী দোভাষ আছেন, রাজনীতির সাথে তাঁর সংস্রব নেই, পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী তিনি। বাচনি বাপের (আমীর হোসেন দোভাষ) নাতি বদরপাতির আনোয়ার হোসেন মামুন (সাবেক কমিশনার) আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন। বাংলাবাজারের মুসলিম লীগ নেতা জলিল চৌধুরীর নাকের ডগায় আওয়ামী লীগের ঘাঁটি গড়ে তুলেছিলেন ত্রিরত্নবজল মিয়া, বালির বাপ ও আবুল খায়ের চৌধুরী; চানবালি ঘাটের ইজারাদার আমীর হোসেন দোভাষকে নিয়ে একটা চতুর্ভুজ তৈরি হয়েছিলো। বাংলাবাজারের বজল মিয়ার পুত্র রফিক আহমদ লায়ন জেলার প্রাক্তন গভর্নর, উন্নয়ন সংগঠন ‘মমতা’র প্রধান নির্বাহী তিনি। ‘লন্ডন সমশু’খ্যাত ডা. শামসুল আলম চৌধুরীর পুত্র কানাডা প্রবাসী আবদুস সালাম, যিনি ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি আদায়ের অন্যতম উদ্যোক্তা। অধ্যাপক মওলানা নুরুল ইসলাম, চৌধুরী এনজি মাহমুদ কামাল, এমএ গণি, তারিক আহমদ চৌধুরী, ইউনুছ খান, মওলানা আবদুর রহমান চৌধুরী, মওলানা ছালে জহুর, মওলানা নুরুল ইসলাম জেহাদীর উত্তর পুরুষদের কথাও উল্লেখ করা যায়। বাদুরতলার খড়ম ছালেহ’র ভ্রাতুষ্পুত্র চকবাজার ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর। আলকরণের এমইউসি মোহাম্মদ ছালেহ’র জ্যেষ্ঠ পুত্র সাবেক ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতা তারেক সোলেমান সেলিম অকালে পরলোকগমন করেছেন; তাঁর অন্য ছেলেরাও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী। হামজারবাগের এজাহার মিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোহাম্মদ কামরুজ্জামান তাঁর পিতার নামে হামজারবাগে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা এজাহার মিয়া নিবাস’ নামে একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। মুরাগনগরের কবি বদন মিয়া দীদারির পুত্র বহুদিন বিদেশে থেকে বর্তমানে দেশে আছেন। হালিশহরের এজাহার মিয়ার এমএ আজিজ ও চান্দগাঁওর ইউনুছ খানের খালাতো ভাই। তিনি মাইক ব্যবসায়ী, কিন্তু তাঁর মাইকটি আওয়ামী রাজনীতির প্রচারেই বেশি কাজে লাগিয়েছেন তিনি।

চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা আর একটা কাজ করতে পারেন, সেটা হচ্ছে এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, শহীদ শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, আবদুল্লাহ আল হারুন, এমএ মান্নান, শহীদ মুরিদুল আলম, ইদ্রিস বি কম, এ কে এম আবদুল মন্নান, সৈয়দ ফজলুল হক বিএসসি, এম এ ওহাবএইসব নেতাদের কবর সংস্কার (পাকা) করে সেখানে ফলক স্থাপন করে তাদের সম্পর্কে কিছু কথা লিখে রাখতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সেটা হলো আওয়ামী লীগ সমর্থক বা আওয়ামী লীগের প্রতি সহানুভূতিশীল লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরাও কি সম্মান পেতে পারেন না। বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি আওয়ামী লীগের সদস্য না হয়েও এই দলটির বিকাশে এবং দুঃসময়ে তাদের লেখনি দিয়ে সৃজনকলা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দেয়ার পর, যতদিন পর্যন্ত ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মিয়া ৬ দফা সমর্থন করেননি, ‘মুসাফির’ ছদ্মনামে লেখা রাজনৈতিক কলামে তাঁর ক্ষুরধার কলম দিয়ে ৬ দফার সমর্থনে যুক্তিতর্ক দিয়ে লেখনি আরম্ভ করেননি এবং সারাদেশে ৬ দফার সমর্থনে অনুষ্ঠিত সভাসমিতি ও বক্তৃতা বিবৃতির সংবাদ ইত্তেফাকের পাতায় ফলাও করে ছাপা শুরু করেননি, ততদিন পর্যন্ত ৬ দফার পালে বাতাস লাগেনি।

বুদ্ধিজীবীরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ সমুন্নত রেখে সমাজ থেকে অন্ধত্ব, কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদ, ফতোয়াবাজি নির্মূল করে সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। সেজন্য আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা ছাড়া তাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা থাকে না। বিএনপি, জামায়াত বা অন্য কোনো পশ্চাৎপদ শক্তি ক্ষমতায় আসলে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ, মুক্তবুদ্ধি চর্চা, মানবাধিকার তথা সমাজ প্রগতির প্রবহমান ধারা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এ কারণে সর্বাবস্থায় আওয়ামী লীগ বুদ্ধিজীবীদের সমর্থন পেয়ে যায়। সংখ্যালঘুদের যে আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করা হয়, তারও উৎস এটাই। এ এক নিদারুণ পরিস্থিতি। এটা লক্ষ্য করেই কবি শামসুর রাহমান এবং সাহিত্যিক আহমদ ছফা বলেছিলেন-‘শেখের বেটি হারলে বাংলাদেশ হেরে যায়। আর শেখের বেটি জিতলে শুধু আওয়ামী লীগই জেতে’।

পঁচাত্তরে আওয়ামী লীগ সীমাহীন বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কিছু গ্রেফতার হন, অন্যেরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন। এই সময় অন্ধকারের শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে; রাজাকার, আলবদর, আল শামস, শান্তি কমিটি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী গর্ত থেকে বের হয়ে এসে আস্ফালন শুরু করে। আওয়ামী লীগে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা সুযোগ সন্ধানীরা সুযোগ বুঝে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্ষমতাসীনদের সাথে হাত মেলায়। এসএম ইউসুফ, মৌলভী সৈয়দ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, গোলাম রব্বান, কাজী ইনামুল হক দানু, আনোয়ারুল আজিম, সীতাকুণ্ডের দিদারুল আলম, অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন হারুন, বাড়বকুণ্ডের চেয়ারম্যান মহসিন জাহাঙ্গীর, নায়েক শফিউল আলম, নগরের অমল মিত্র, ফকির জামাল, শফিকুল আহসান, সৈয়দ মাহমুদুল হকতাঁর পিতা ও ভাই, হাটহাজারীর অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুদ্দিন, মোহাম্মদ ইউনুছ, দীপেশ চৌধুরী, বোয়ালখালীর পীষুষ রক্ষিত, কেশব সেন, আবুল মনসুর ছিদ্দিকী, এসএম সেলিম, আহমদ হোসেন, বাঁশখালীর সুভাষ আচার্য, শফিকুল ইসলাম, পটিয়ার শামসুদ্দিন আহমদ প্রমুখ সূর্য সৈনিক, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতাকর্মীরা বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য ৭১এর ন্যায় ভারতে গিয়ে অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে আবার যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তাঁরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের দুর্দিনের সাহসী সৈনিক।

লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সংস্কৃতি সংগঠক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅসচ্ছল, দরিদ্র ও বেকার কর্মক্ষম নারীদের অগ্রযাত্রায় চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম