একলা চলো, বুদ্ধি খোলো

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ২১ মে, ২০২২ at ৮:২০ পূর্বাহ্ণ

কখনো কখনো কিছু করতে ইচ্ছে করে না। কখনো কখনো কিছু শুনতে, দেখতে বা বলতে ইচ্ছে করে না। কখনো কখনো সবকিছু খুব ক্লান্ত লাগে, সবকিছু খুব মিথ্যে লাগে। জীবন, সংসার সবকিছুই অর্থহীন লাগে।

এমন এক কোন কিছু করতে ইচ্ছে না করার দিনে মোবাইল জানান দিলো নতুন কোন ইমেইল এসেছে। এমন দিনে ইমেইল চেক করতেও ইচ্ছে করে না। তারপরেও মোবাইলে চোখ বুলাতেই বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। স্পাইসিরোড থেকে ইমেইল করেছে। স্পাইসিরোড হল সেই ভ্রমণকারীর দল যারা শরণার্থী অধিকার সমর্থন এবং নারীবাদ প্রচারের লক্ষ্য নিয়ে হিচহাইকিং এবং কাউচসার্ফিং এর মাধম্যে সেই জার্মানি থেকে ভ্রমণে বের হয়েছে, যারা তাদের এই ভ্রমণ শেষ করতে চায় ভিয়েতনামে গিয়ে। ওদের মূলত চার জনের দল হলেও, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে আরও ভ্রমণকারী যারা শরণার্থীর অধিকার এবং নারীবাদ সমর্থন করে, তারাও সঙ্গী হয়েছে। আমি তাদের সাথে ভ্রমণে আগ্রহী জানিয়ে ইমেইল করেছিলাম। অনেকদিন পার হয়ে যাওয়াতে, সেই ইমেইলের উত্তরের আশা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম। তাই ওদের ইমেইল দেখে চমকে উঠলাম। ওরা জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে আমার প্রোফাইল ওদের পছন্দ হয়েছে, তারপরেও আমাকে একটা ইন্টারভিউ দিতে হবে। অনেকেই ভাবতে পারে, নিজের পয়সায়, নিজের ইচ্ছেয় ঘুরবো, তার জন্য আমার ইন্টারভিউ দিতে হবে কেন? এখানেই ব্যাপারটা। ভ্রমণে ভ্রমণ সঙ্গী খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা কথা প্রচলিত আছে ভ্রমণকারীদের মাঝে, কোন মানুষকে যাচাই করতে হলে তার সাথে ভ্রমণে যেতে হবে। ভ্রমণে বের হলে দেখা যায় অনেক পুরাতন বন্ধুর অচেনা রূপ ধরা পড়ে, আবার সদ্য পরিচিতরা হয়ে উঠে নির্ভরযোগ্য ভ্রমণসঙ্গী। তাই প্রাথমিকভাবে ভ্রমনসঙ্গী যাচাইবাছাই করা এক প্রকার জরুরী কাজ, তার উপর সম্পূর্ণ অচেনা দেশের, অচেনা সংস্কৃতির, অচেনা ভাষার মানুষ যখন সবাই এবং বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে পথে বের হয়েছে, সেখানে ঠিকঠাক মিল না হলে ভীষণ মুশকিল।

আমি প্রথম অচেনা ভ্রমণকারীদের সাথে ভ্রমণ শুরু করি সম্ভবত ২০১২ সালে ‘এডভেঞ্চার ক্লাব অফ চিটাগং’ (এসিসি)’র সাথে। সীতাকুন্ডে ঝর্না দেখতে গিয়েছিলাম। সারাদিনের ভ্রমণ ছিল সেবারসকালে গিয়ে বিকেলে ফেরত আসা। তবে, প্রথম অচেনা ভ্রমণকারীদের সাথে পরিচয় হয়েছিল ‘ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ’ (টিওবি)’র মাধম্যে। সেখান থেকেই এসিসি’র সদস্যদের সাথে পরিচয় হয়েছিল। এখনও মনে আছে, প্রথমবারের ট্রিপে আমি ছাড়া আর কোন মেয়ে ছিল না দলে। পুরো চট্টগ্রামেই তখন খুব বেশি নারী ভ্রমণকারী ছিল না, আর অচেনা মানুষের সাথে ভ্রমণে যাওয়াটাও দুঃসাহস বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। আমি দলের সাথে ঘুরাঘুরি শুরু করার পর মেয়েদের সংখ্যা আস্তে আস্তে বেড়েছিল। সাইকেল চালানোও যে এক ধরনের খেলা, এই বিষয়টিও চট্টগ্রামে প্রচলন করেছিল এসিসি। এখন তো শুধু নারী ভ্রমণকারীদেরই আলাদা আলাদা ভ্রমণের দল আছে। আবার অনলাইন ভিত্তিক এমন দল রয়েছে অসংখ্য। যতদূর জানি, বাংলাদেশে ভ্রমণকারীদের এমন প্রথম দল ‘ভ্রমণ বাংলাদেশ’। ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ এর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে ব্যাকপ্যাকিং ভ্রমণের প্রচলন করা এবং একটি সহযোগিতাপূর্ণ প্লাটফর্ম তৈরি করা যেখানে ভ্রমণকারীরা এসে অপরকে সহায়তা করতে পারবে। দুটো দলই ছিল ঢাকা ভিত্তিক। চট্টগ্রামে এমন দল ছিল এডভেঞ্চার ক্লাব অফ চিটাগং। সম্ভবত ২০১৩এ প্রথম কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে যাই টিওবি’র সাথে বান্দারবানে। ভ্রমণে যাওয়ার আগে, অনলাইনের বাইরে উদ্যোক্তাদের দুই/এক জনের সাথে অফলাইনে পরিচয় করে নিয়েছিলাম। ভ্রমণের দিন পরিচয় হয়েছিল অচেনা প্রায় ১০/১২ জন ভ্রমণকারীর সাথে। আমার পরিচিত খুব বেশি মানুষের এ বিষয়ে কোন ধারণা ছিল না। যারাই শুনত যে চেনা নাই জানা নাই মানুষের সাথে ঘুরতে যাচ্ছি, সবাই একবাক্যে বলত এটা অনেক ঝুঁকির কাজ। এর উত্তর আমার কাছে তৈরি করাই ছিল, এ দেশে নিকট আত্মীয়ের হাতে ৫৪% মানুষ যৌন হয়রানির শিকার হয়। সেখানে ঝুঁকি বিবেচনায় ঘর আর বাহিরের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাহলে ঘরে বসে থেকে হয়রানির শিকার হওয়ার চেয়ে, ঝুঁকি নিয়ে বাইরে গেলে নতুন জগত দেখা যাবে, নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবে, জীবনে নতুন নতুন দরজা খুলবে। তবে কি এই অচেনা ভ্রমণকারীরা সবাই খুব নিরাপদ? উত্তর খুব সহজ, ঘরের মানুষই নিরাপদ নয়, তাহলে বাইরের মানুষ কেন হবে? ভ্রমণকারী বলে কি ওরা সাধুসন্ত হয়ে গেছে! তবে হ্যাঁ, যেহেতু দলগুলো নতুন ছিল, সবাই সবাইকে চিনতো তাই অভব্যতা করার আগে সবাইকে ভাবতে হত। তাই ভ্রমণে গেলে কোন পুরুষের নারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়া, বা কোন নারী পুরুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ ছিল না। তবে এসব দলে হয়রানির রূপ আলাদা, সেটা যৌন হয়রানি, আর্থিক হয়রানি বা অন্য যেকোনো হয়রানি হোক, সেগুলো হয়রানি বলে চিহ্নিত করা সহজ ছিল না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাকরিসূত্রে অনেক জায়গায় একা একা গিয়েছি, থেকেছি; যার ফলে অচেনা কারো সাথে ভ্রমণের বিষয়ে নিরাপত্তা নিয়ে আমার কোন ভয় লাগত না, লাগে না। ভয় লাগে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানুষদের। একবার এদেশের এক পার্বত্য অঞ্চলে এক রাত থানায় কাটাতে হয়েছিল। আমাদের ভ্রমণকারীর দলটি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরাগভাজন হয়েছিল, কারণ পাহাড়ের মানুষের সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক ছিল। এ কারণে তো আর কাউকে থানায় আটকে রাখা যায় না। তখনই বাহিনীর কেউ খেয়াল করল, সাতজন অনাত্মীয় ছেলের সাথে একজন মেয়ে ঘুরতে গিয়েছে। ওরা ‘অসামাজিকতার’ দায়ে থানায় নিয়ে গেল। ঘটনার দিন কাছাকাছি আরেক জায়গার বাহিনীর লোকেরা আমার বাড়িতে ফোন করে বাবার কাছে জানতে চেয়েছিল, তার মেয়ে যে অনাত্মীয় পুরুষদের সাথে ঘুরতে গিয়েছে, সেটা উনি জানেন কী না। বাবার শক্ত গলায় তার অবগতির কথা শুনে, ওরা কোন ঝামেলা করার সুযোগ পায়নি। যাই হোক, সেই রাতে অবশ্য শেষ পর্যন্ত ওরা আর ‘অসামাজিক কর্মকাণ্ড’ প্রমাণ করতে পারেনি। শুধু আমি নই, ঘুরতে গিয়ে এমন হয়রানির স্বীকার এদেশে কমবেশি সব একা নারী ভ্রমণকারীকেই হতে হয়। অবস্থার উন্নতি হয়নি বরং অবনতি হয়েছে। এদেশের মানুষ গর্ব করে হিমালয় আরোহী নিশাত মজুমদার বা ওয়াজফিয়া নাজরীনকে নিয়ে। থানার লোকদের প্রশ্ন করেছিলাম, নিশাত বা ওয়াজফিয়া কি ঘরের আত্মীয় স্বজনকে সাথে নিয়ে হিমালয়ে উঠেছিল? প্রশ্নের কোন উত্তর পাওয়ার কথা না। সে রাতে আমার উছিলায় থানার ওসি এবং অন্যান্যরা সুযোগ পেয়েছিল একা ঘরের বাইরে যাওয়া নারীদের চরিত্র কত খারাপ তা বিশ্লেষণের। কঙবাজারে চাকরির সুবাদে প্রায়শই চট্রগ্রাম আসা যাওয়া করতে হত একা একা। এখানেও একা হওয়ার বিপত্তি। পথের মাঝে চেক করবার জন্য বাহিনীর লোকেরা উঠে। তাদের প্রথম প্রশ্ন, ‘একা?’। এই প্রশ্ন করার মধ্যে কোন সভ্যতা ভব্যতা নেই। একা মানেই খারাপ মেয়ে, একা মানেই মাদকপাচারকারী, একা মানেই আতিপাতি করে ব্যাগ চেক করা, যেন একা নারী ব্যাগের ভেতর বহন করে বিধ্বংসী সব জিনিস। রেফারেন্স ছাড়া একা নারীর হোটেলে রুম পাওয়ার তো কোন প্রশ্নই আসে না। এখানে মেয়েদের একা ভ্রমণে হয়রানির রকম এবং ধরন আলাদা। তাতে কি আর ঘরে আটকে রাখা গেছে? না। নারী ভ্রমণকারীর সংখ্যা আশাব্যঞ্জকভাবে বেড়েছে। ভ্রমণকারীরাও বুঝে গেছে কখন, কোথায়, কীভাবে হয়রানি মোকাবেলা করতে হয়। আর একা ভ্রমণ করতে গেলে একটু হিসেব নিকেশ করে পরিকল্পনা করলেই হয়।

স্পাইসিরোডের সদস্যরা ইন্টারভিউ নেয়ার পর আমাকে তাদের ভ্রমণসঙ্গী করে নিল, ওদের সাথে দেখা হবে থাইল্যান্ডের উত্তরের শহর চ্যাংমাই এ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমা, টিচার কি কিডন্যাপ হতে পারে?
পরবর্তী নিবন্ধর‌্যাংকস এফসির ব্রীজি ট্যারেস প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু