মা, টিচার কি কিডন্যাপ হতে পারে?

অভিজ্ঞতা

নুসরাত সুলতানা | শনিবার , ২১ মে, ২০২২ at ৮:১৯ পূর্বাহ্ণ

মার্চের ৫ তারিখ সন্ধ্যায় বাচ্চাদেরকে পড়াতে বসলাম। আমার মনে হচ্ছিলো ওরা আমার কথা একটু কম শুনছে ইদানিং। পড়ার সময় গল্প করতে শুরু করে। তাই খুব রাগের মাথায় বললাম, তোমাদেরকে টিউটর দিবো, তখন তোমরা সময় ধরে পড়তে বসবে, সময়ের অপচয় হবে না, নিয়মিত তোমাদের পড়া আদায় হবে, এতে আমার চাপও অনেক কমবে। আমি সকাল হোক কিংবা সন্ধ্যা, দিন হোক অথবা রাত, যখনই সুযোগ হয় তোমাদেরকে অল্প অল্প করে পড়ানোর চেষ্টা করি। এতে তোমাদের কোনো চাপ হয় না কিন্তু তোমরা আমার গুরুত্ব বুঝতে পারছো না… !

সে সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে স্ক্রল করতে গিয়ে একটি হোম টিউটর মিডিয়ার খোঁজ পেলাম, যোগাযোগ করলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সাথে কথা হলো, পেজটা তাদের। তিনি অনেকক্ষণ কথা বললেন, ডিটেলস নিলেন। বললেন, আমার লোকেশনের কাছাকাছি টিচার ম্যানেজ করা যাবে, /৪ দিন সময় লাগবে। এরপর ২০ তারিখ তিনি ফোন করলেন, জানালেন একজন টিচার আমাদের বাসার খুব কাছেই আছে। তিনিও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজির চতুর্থ বর্ষের স্টুডেন্ট। সেই লেডি টিউটরের সাথে আমার কথা হলো। বললাম, বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে। এখন একটা ধারাতে ওরা চলছে। ২৮ তারিখে ওদের পরীক্ষা শেষ হবে। এরপর যোগাযোগ করে আসতে হবে।

এপ্রিলের ১ তারিখ সেই লেডি টিউটর আমাকে ফোন করলেন, আমি বললাম আজ তো শুক্রবার আজ পড়ানোর দরকার নেই। তবে আজ আপনি এসে বাসা চিনে যেতে পারেন, ডিটেইলস কথা বলে যেতে পারেন, ঠিক চারটায় আসবেন। তিনিও যথাসময়ে বাসায় আসলেন। প্রায় ৩০/৩৫ মিনিট আমার উনার সাথে কথা হলো, আমার মেয়েদেরকে পরিচয় করিয়ে দিলাম। মেয়েদের সিলেবাস দেখলেন। অন্যান্য কথাবার্তা রিকোয়ারমেন্ট স্যাটেল্ড হল। তিনি কনফার্ম করলেন, আগামীকাল থেকে আসবেন। সন্ধ্যায় টিউটর মিডিয়ার সেই ছাত্রের সাথে কথা হলো। উনি বললেন, টিউটর সপ্তাহে ৫ দিনের পরিবর্তে ৪ দিন পড়াতে চাচ্ছেন। আমি বললাম, তিনি তো কনফার্ম করে গেছেন তিনি আসবেন। আর স্কুল গোয়িং বাচ্চাদের চার দিন পড়ালে পড়া জমে যাবে, দিনের পড়া দিনে শেষ করে ফেললে পড়া জমবে না। আমার মেয়েদের স্কুল এমনিতেই সপ্তাহে দুই দিন বন্ধ থাকে। তাছাড়া অন্যান্য দিন যেগুলোতে স্কুল ছুটি থাকে সেসব দিনেও তিনি ছুটি পাবেন। আর আমি প্রায় সময়ই আমার বাচ্চাদেরকে নিয়ে ঘুরতে যাই তখনও তিনি ছুটি পাবেন। এখানে চাপাচাপির কোনো বিষয় নেই। বাচ্চাদেরকে আনন্দের সাথে পড়াতে হবে, এটাই আসল বিষয়। আমার উদ্দেশ্য একটাই তারা নির্দিষ্ট সময় ধরে পড়ার টেবিলে বসে পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলুক।

এখানে একটা কথা বলতেই হয়, আমি টিউটর মিডিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই ছাত্র এবং লেডি টিউটর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সেই ছাত্রীতাদের দু’জনকেই বলেছি, ‘আমি নিজেও অনেক টিউশনি করেছি, অনেক স্টুডেন্ট পড়িয়েছি, স্কুলে শিক্ষকতা করেছি এবং এখন পর্যন্ত আমার সন্তানদের কোনো টিউটর দেয়া হয় নি। যিনি এখন তাদের টিউটর হবেন তিনিই তাদের প্রথম হোম টিউটর হবেন।’

ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, স্টুডেন্টদেরকে আন্তরিকতার সাথে পড়ালে রিলেশনশিপ ডেভলপমেন্ট হয় এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাও পাওয়া যায়। একজায়গায় ভালো করে পড়ালে টিউশনির অভাব হয় না, স্টুডেন্টের অভাব হয় না এবং ছাত্রছাত্রীর সাথে সম্পর্ক আজীবন থাকে, স্টুডেন্টরা শ্রদ্ধাভরে শিক্ষককে স্মরণ রাখে সারা জীবন। আমরা ছোটবেলায় যে সকল শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেট পড়েছি প্রত্যেককে এখনো পরম শ্রদ্ধার সাথে মনে রেখেছি এবং আমি যত স্টুডেন্ট পড়িয়েছি প্রত্যেকের পরিবারের সাথে আমার দীর্ঘ সময় ধরে এখনো সুসম্পর্ক আছে।

টিউটর মিডিয়ার সেই ছাত্র বললেন, ঠিক আছে ম্যাম আপনার সাথে আগামী দিন সন্ধ্যায় কথা হবে।

২ তারিখ শনিবার সকাল থেকেই আমাদের ঘরে উৎসব। আজ টিচার আসবেন। আমার বাচ্চাদের প্রথম হোম টিউটর। আমরা সকাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছি। অনেক আনন্দ সবার মনে। ঘরের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ করে যথাসময়ে বাচ্চাদেরকে পড়ার টেবিলে বসিয়ে দিলাম। তাদেরকে বুঝালাম টিচার কিন্তু টাইম মেনটেন করবেন। গতকাল দেখেছো তিনি ঠিক চারটায় বাসায় এসেছেন। তোমরা পড়তে বসে যাও। মামনিরা প্রস্তুতি নিয়ে, স্কুলের ব্যাগে করে বইপত্র গুছিয়ে পড়ার টেবিলে অপেক্ষা করতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রম করে অনেকদূর গড়াতে লাগলো। নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার আরো ২৫ মিনিট পর আমি লেডি টিউটরের নাম্বারে কল করলাম । অত্যন্ত আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি তিনি সেই মুহূর্তে তার ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। তারপর টিউটর মিডিয়ার সেই ছাত্রের সাথে কথা বললাম, তিনি বললেন, ঠিক আছে আমি দেখছি, আপনাকে জানাচ্ছি। দিনে দিনে দিন পার হয়ে গেছে, তাদের তরফ থেকে আর কোনো ফোন আসেনি।

আমার মেয়েদের মনে অনেক জল্পনাকল্পনা। তারা বুঝতে পারছে না টিচার কেনো এলো না! কেনো তিনি ফোন বন্ধ করে রেখেছিলেন! একজন বলছে, মা, টিচার এক্সিডেন্ট করলো না তো? অন্যজন বলছে, মা, টিচার কি কিডন্যাপ হতে পারে? এই জায়গায় আমার দুঃখ একটাই তিনি আসবেন নাকি আসবেন না এটা তার ব্যক্তিগত অধিকার। কিন্তু তিনি যে কনফার্ম করে গেছেন, আসবেন বলে, সে কথার কি কোনো মূল্য নেই! একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া স্টুডেন্ট সে, তার কি উচিত ছিলো না স্বচ্ছতা বজায় রাখা! এতটুকু দায়িত্ব কি তার নেই? তিনি একজন শিক্ষক হয়ে যে কাজটা করলেন এটা কি তার অজ্ঞতার পরিচয় নয়? তিনি ছাত্রছাত্রীদেরকে কি শিক্ষা দিবেন! আমি আসলে জানি না তিনি কি কারণে আসলেন না।

যে বয়সে আমি কিংবা আমার সমবয়সী যারা আছে তারা মনের আনন্দে শিখার আগ্রহ নিয়ে স্টুডেন্ট পড়িয়েছি, কোনো অর্থের প্রয়োজনে কিংবা অর্থের লোভে নয়। সেবয়সে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা শুধুমাত্র অর্থের বিনিময়ে সময় ধরে, সময় মেপে পড়াতে চায়, এদের মধ্যে শিক্ষাদানের চেয়ে অর্থের মূল্য অনেক বেশি। অপেক্ষাকৃত কম মেধাবী ছাত্রছাত্রীরাই টিউশনির দিকে ঝুঁকে গেছে বেশি। আমাদের শিক্ষা সংকটের মধ্যে এটাও একটা বড় সংকটএ থেকে উত্তরণের উপায় আছে কি?

…..অবশেষে আমি আবারও আমার একই বৃত্তে। সপ্তম শ্রেণী আর পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ুয়া আমাদের দুই মেয়েকে আমারই পড়াতে হচ্ছে। কিছুটা চাপ মুক্তির আশা করেছিলাম। কিন্তু বিধিবাম! এই রমজান মাসে স্কুল খোলা। প্রচণ্ড গরমে ঘন্টার পর ঘন্টা রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকতে হচ্ছে। এতে সবকিছু সামলাতে কি পরিমাণ হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাদের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএশিয়া সফরে বাইডেন, লক্ষ্য ইন্দো-প্যাসিফিক সম্পর্ক জোরদার
পরবর্তী নিবন্ধএকলা চলো, বুদ্ধি খোলো