একদিন সকালে

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

সাতসকালে মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে পড়িমরি করে ছুটে যাই নগরীর টেকনিক্যাল মোড়ের দিকে। সেখান থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়গামী বাস নিয়ে যায় আমায় কর্মক্ষেত্রে। পথিমধ্যে অনেক রিকশা, সবুজ ট্যাক্সি ছাড়াও অসংখ্য ঝকঝকে তকতকে গাড়িকে পাশ কাটিয়ে, জলকাদা মাড়িয়ে হাঁটতে থাকি। পাশে পাশে চলেছেন অগুনতি নারী পুরুষ; ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটছেন নিজ নিজ কাজে। নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখি। দুতিন মিনিটের পথ পেরোতে লেগে যায় পনের মিনিট। তাতে কি! বাস আসতে এখনও ঢের বাকী। তাকেও যে দীর্ঘ গাড়ির বহর আর পথচারীর মিছিল পাড়ি দিয়ে ধীরে ধীরেই চাকা ঘোরাতে হয় এই রাজপথে।

জীবনের দুইতৃতীয়াংশের বেশি সময় চট্টগ্রামে কাটিয়েও এতো কাছ থেকে চট্টলা নগরীকে আগে কখনও এভাবে দেখা হয়নি। পাহাড় ঘেরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ক্যাম্পাস ছেড়ে জীবনের প্রয়োজনে বসত গড়তে হয়েছে এই ব্যস্ত নগরীতে। সবকিছু তাই অন্যরকম লাগে। গাঁওগেরামের মানুষ শহর বন্দরে এলে যা হয় আর কী। প্রাণ কেঁপে ওঠে যখনই দেখিদ্রুতগামী গাড়ির সামনে দিয়ে অবলীলায় রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছেনপুরুষ নারী বৃদ্ধ শিশু। সবারই অনেক তাড়া। ছোট ছোট ব্যাগ কাঁধে বস্ত্রবালিকাদের মিছিল। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলেছে ওরা আমাদের জাতীয় অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে। কেউ এগিয়ে যাচ্ছে লাইন ধরে একজনের পেছনে একজন, আবার কেউবা হাতে হাত ধরে। শাঁখাসিঁদুর আর বোরকা পরা দুজনকে দেখলাম হাত ধরে রাস্তা পার হতে। কতইবা বা বয়স ওদের! কুড়ি/ বাইশ? কমও হতে পারে। মনে হল দুটিতে বেশ ভাব। সমপ্রীতির এমন সৌন্দর্য আমাদের চোখে পড়েনা। তাই প্রতিহিংসাই প্রচার ও প্রসার লাভ করে।

একদলা থু থু ফেলেন একজন খুব কাছ দিয়ে যাবার সময়। খুক খুক করে কেশে চলেছেন অনেকেই, হাতের বিড়িটা যদিও ধরে আছেন শক্ত করে। নানান কিসিমের গাড়িগুলো আর্তনাদ করে যাচ্ছে অবিরত। কারখানার ধোঁয়া আর গাড়ির শব্দ ও ধোঁয়া আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছে। এর মধ্যেই নির্বিকার ঘুমিয়ে আছেন একজন ফুটপাতে, একটা ছেঁড়া আর নোংরা লুঙ্গি পেঁচিয়ে। শরীরের অনাবৃত অংশগুলোতে ভন ভন করছে মশা মাছি। ওদেরই বা দোষ কি! খাবারের সন্ধানে ছুটতে হয় ওদেরও।

ফুটপাথের এক ভাঙা টাইলসের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে আছে এক বিকলাঙ্গ যুবক। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। পরনের জিন্সটাকে তেমন ময়লা মনে হয়নি। হয়তো গতকালই দয়ালু কোন ব্যক্তি দান করেছেন। যুবকের সামনের ভাঙা থালা বলে দেয় ভিক্ষাবৃত্তির জন্য কেউ তাকে রেখে গিয়েছে এখানে দিনের আলো ফোটারও আগে।

ট্যাম্পু’ নামের সহজলভ্য দ্রুতযানের সিঁড়িতে বিপদজ্জনক অথচ দুঃসাহসিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে সাত থেকে দশ বছর বয়সী শিশু। তাদের নির্ভীক ও দায়িত্ববান হাতে শক্ত করে ধরা অনেকগুলো কাগজের নোট। নানা স্কুলের পোশাক পরা ওদেরই সমবয়সী ছেলেমেয়েদের নামিয়ে দিচ্ছে নিরাপদ গন্তব্যে।

অনেক অপেক্ষার পর আমার বাসের দেখা মেলে। পরিচিত মুখদের সুপ্রভাত জানিয়ে আসন গ্রহণের পর এক দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। বুকের ভেতর খচখচ করে। আর কতকাল এভাবে চেয়ে চেয়ে দেখা! গা বাঁচিয়ে চলা!

এগিয়ে চলে আমার বাস। কখনও ধীর গতি আবার কখনওবা সুযোগ বুঝে দ্রুত গতি। রাস্তা কোথাও মসৃণ, কোথাওবা ভাঙাচোরা, এবড়ো থেবড়ো। দুই ধারে শিল্পকারখানা, মাঝে মাঝে আকাশছোঁয়া অট্টালিকা। পথিমধ্যে দুই, তিন গোলচত্বর। দেখেই বোঝা যায় কোটি টাকার বিনিময়ে নির্মিত এসব স্থাপনা (পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর গোলচত্বর বা রাউণ্ড এ্যাবাউট নির্মাণে এতো খরচ হয় না)। রাস্তার আইন অনুযায়ী গোল চত্বর পেরিয়ে যাবার সময় বামে চলার কথা থাকলেও তার তোয়াক্কা না করে ফাঁকফোকর গলে যেদিকে খুশি চলে যায় অনেকেই। ফলাফল অসহনীয় যানজট। এই জট সরানোর জন্য পোশাকি কর্মী দেখা যায় কালেভদ্রে, যদিও তাঁদের তেমন কিছু করার থাকেনা, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া।

সবার মতো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে আমার বাস। সামনেই দুর্দান্ত আরেকটা গোলচত্বর। বেশ বড় জায়গা নিয়ে নির্মিত এই স্থাপনা। চূড়ায় একটা প্রতীকী ভাস্কর্য; বিশাল একটা রূপোলী হাতের মধ্যে নীল রঙের মানচিত্রআমার প্রাণের বাংলাদেশ। চারপাশে ইস্পাতের হরফে খোদাই করা– “সবার ওপরে দেশ”। এই পরম সত্যটার জন্যই ফিরে আসা এখানে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বাসযোগ্য শহরে থিতু হবার হাতছানি উড়িয়ে দিয়ে।

প্রিয় পাঠক, আমার আজকের সকালের গল্প শেষ হয়ে এলো বলে। দয়া করে আরও কিছুক্ষণ থাকুন আমার সঙ্গে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড এর দৃষ্টিনন্দন কার্যালয় ফেলে এসে একটু পর বায়েজিদ বোস্তামির মাজার। বিশাল ফটকের দুই পাশে মানুষের পায়ে চলা পথের ওপর অসংখ্য দোকান, ঝুপড়ির মতো। এখনও ত্রিপল আর দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। ঘুমন্ত। তেমনই এক দোকানের সামনে মাটিতে শাড়ি পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে আছেন এক নারী। তাঁর পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে আরও একজন; একটি কালো কুকুর।

এই কর্মব্যস্ত শহরের কোলাহলে তাদের কিছুই এসে যায়না। দেশজুড়ে মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির সূচকের লাফিয়ে লাফিয়ে ওপরে ওঠা, ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতা, অমানবিক বীভৎস উগ্রতা, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বৈশ্বিক সন্ত্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, সর্বোপরি মানবাধিকার, নারীর ক্ষমতায়নএতোসব ভারী ভারী কথায় তাদের এসে যায়না কিছুই। দালানকোঠার আরামদায়ক নিরাপদ আবাসে ঘুম আসেনা আমাদের। মোড়ের দোকান থেকে কিনে নিতে হয় ঘুমের ওষুধ। অথচ কি নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে তারা! সত্যিই কি নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে ?

পোকামাকড়ের জীবন পাওয়া কুকুরের পাশে শুয়ে থাকা সেই নারী, স্কুলে না গিয়ে সংসারের জোয়াল কাঁধে নিয়ে ‘ট্যাম্পু’র পাদানিতে ঝুলে থাকা শিশু, ফুটপাথে পড়ে থাকা বিকলাঙ্গ যুবক, মশা মাছিতে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে থাকা মানবসন্তানওরা সবাইতো এই দেশেরই নাগরিক। অনেক দাম দিয়ে কেনা বাংলাদেশের মধ্যম আয়ের দেশ হয়ে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট হওয়ার যাত্রাপথে ওদের কথা কি আমরা ভাববো না? সমাজপতি, নগরাধিপতি, জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গের ভাবনার সমন্বয় ঘটিয়ে হাতে হাত রেখে কাজ করলে আমাদের সকালগুলো অন্যরকম হতে পারে। সেইসঙ্গে দিন রাত্রি বছরগুলোও। আমরা কি তা করবোনা ?

পূর্ববর্তী নিবন্ধউন্নয়নের ধারা রক্ষায় শেখ হাসিনাকে আবারও প্রধানমন্ত্রী করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধনারী যদি জামিন অযোগ্য অপরাধ করে থাকে