উৎসবে মেতেছিল চট্টগ্রামবাসী

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

ঋতুর পালাবদলে আবার এসেছে বৈশাখ। গাছে গাছে আম, রুদ্র আকাশ, লু হাওয়া আবার সন্ধ্যায় ঝড়ো হাওয়ায় গত বৃহস্পতিবার বাঙালি বরণ করে নিয়েছে নতুন বছরকে। দীর্ঘ দুই বছর করোনার আগ্রাসন স্থবির করে দিয়েছিল বাঙালি তথা বিশ্ববাসীকে। দুই বছর পর আবারও বাংলা বর্ষবরণের উচ্ছ্বাসে মেতেছে চট্টগ্রামবাসী। বহু বছর ধরে বাংলা সংস্কৃতিতে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের ব্যাপারটি চলে এলেও কালের পরিক্রমায় উদ্‌যাপনের ধরণে পরিবর্তন এসেছে ; কিন্তু বাঙালির প্রাণের উৎসব হিসেবে বৈশাখ আজও তার আবেদন ধরে রেখেছে। এ দিনটিতে সকলকে যেন বাঙালিয়ানায় পেয়ে বসে। প্রাণের এ উৎসবকে ঘিরে স্বপ্ন রচিত হয় সবার চোখে। পরিকল্পনাতেও থাকে স্বপ্ন মঙ্গল কাব্যের বহিঃপ্রকাশ। আটপৌরে বাঙালি জীবনে নববর্ষের প্রভাব বহুমাত্রিক। আমাদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও লৌকিকতায় এর প্রভাব বিস্তৃত হয়ে আছে।
বাঙালির জীবনে প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। শুধুই কি বাঙালি? বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভযাত্রা সূচিত হয়েছে এই বৈশাখে। আবহমান কাল থেকেই আমাদের সত্তায়, চেতনায় ও অনুভবে গভীরতর মধুর সম্পর্ক নিয়ে বিরাজ করছে পহেলা বৈশাখ। নগরীর ডিসি হিল, সিআরবির শিরীষতলা, শিল্পকলা একাডেমি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভিন্ন স্থানে নানা আয়োজনে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো’ গানে বরণ করে নেন বাংলা নববর্ষকে। তবে রমজান মাস হওয়ায় এবার বসেনি মেলা, ছিল না ভুভুজেলার উৎপাতও। গ্রহণ করা হয়েছিল বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিভিন্ন এলাকা সিসিটিভির আওতায় ছিল। পুলিশ, র‌্যাবের পাশাপাশি সাদা পোশাকে নিয়োজিত ছিলেন নিরাপত্তা কর্মীরা। নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল যান চলাচল। বর্ষবরণ উৎসবের সকল আয়োজন সংক্ষিপ্ত করা হয়। আয়োজকগণ দুপুরের মধ্যেই অনুষ্ঠানের ইতি টানেন।
ডিসি হিলে বর্ষবরণ : ‘পহেলা বৈশাখ বাঙালির, সবার যোগে জয়যুক্ত হোক’- স্লোগানে নগরীর ডিসি হিলে সকাল থেকে শুরু হয় পহেলা বৈশাখ বরণ। নাচে-গানে জমজমাট পুরো এলাকা। অনেক দিন পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে ছুটে এসেছেন সবাই। বাঙালি নারীর ঐতিহ্য শাড়ি, পুরুষরা পাঞ্জাবি পরে এসেছিলেন অনুষ্ঠানস্থলে। শিশুরা মুখে বা হাতে রং-তুলি দিয়ে আঁকিয়ে নেয় ‘শুভ নববর্ষ’। পহেলা বৈশাখের সবচেয়ে পুরনো আয়োজনটি হয়ে থাকে ডিসি হিল এলাকায়। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে ‘সংগীত ভবন, জয়ন্তী, ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, গুরুকুল সংগীত একাডেমি, সুর-সাধনা সংগীতালয়, গীতধ্বনি, ইমন কল্যাণ সংগীত বিদ্যাপীঠ, সৃজামি সাংস্কৃতিক অংগন, নটরাজ নৃত্যাঙ্গন একাডেমি, স্কুল অব ওরিয়েন্টাল ডান্স, ওডিসি অ্যান্ড টেগোর ডান্স মুভমেন্ট সেন্টার, নৃত্যম একাডেমি, ঘুঙুর নৃত্যকলা কেন্দ্র, সঞ্চারী নৃত্যকলা একাডেমি, নৃত্য নিকেতন, দি স্কুল অব ফোক ডান্স, বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, স্বরনন্দন প্রমিত বাংলা চর্চা কেন্দ্র ও বিভাস আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র, রাজেশ্রী, সুন্দরম শিল্পী গোষ্ঠী, উপমা সাংস্কৃতিক অংগন, বংশী শিল্পকলা একাডেমি, ফতেয়াবাদ সংগীত নিকেতন, শহীদ মিলন সংগীত বিদ্যালয়, বাণী মঞ্জুরী ললিতকলা একাডেমি, সপ্তডিঙ্গা শিল্পাঙ্গন, সপ্তসুর বিদ্যানিকেতন, মনোরমা নৃত্যাঙ্গন, অপ্সরী ডান্স একাডেমি, উদিত নৃত্য একাডেমি ও নরেন আবৃত্তি একাডেমি সংগঠনের শিল্পীরা সাংস্কৃতিক পরিবেশনায় অংশগ্রহণ করেন। এ সব পরিবেশনা মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছেন দর্শনার্থীরা।
ডিসি হিলে প্রবেশের আশপাশের সড়কগুলোতে ভোর থেকে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় সিএমপি। ডিসি হিল, চেরাগি পাহাড়, বোস ব্রাদার্সের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে মুক্তমঞ্চের দিকে। পুলিশের কড়াকড়িতে গরমের মধ্যে ভোগান্তিতে পড়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন অনেকে।
চট্টগ্রাম সম্মিলিত পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক আহমেদ ইকবাল হায়দার আজাদীকে বলেন, গত দুই বছর বন্ধ ছিল নববর্ষ বরণের উৎসব। তবে এবার রমজানের কারণে সংক্ষিপ্ত পরিসরে উৎসব চলছে।
সিআরবির শিরীষতলায় বর্ষবরণ : সিআরবির শিরীষতলায় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল বৈশাখের প্রথম দিনে। সেখানেও এসেছে নানান বয়সীরা। তবে এবার সেখানে বলীখেলা হয়নি। ভায়োলিনিস্ট চিটাগংয়ের শিল্পীরা সমবেতভাবে বেহালার মূর্ছনায় রাঙিয়ে দেন নববর্ষের সকালটা। ‘এসো হে বৈশাখ’ গানের সুরে সুরে শুরু হয় বাংলা নববর্ষ আবাহন। এরপর দলীয় পরিবেশনায় অংশ নেয় সংগীত ভবন, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ, বোধন আবৃত্তি স্কুল, অবকাশ ধারা শিল্পী সংস্থা, সুন্দরম শিল্পীগোষ্ঠী, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, চারুতা নৃত্যকলা একাডেমি, উচ্চারক আবৃত্তি কুঞ্জ, শ্যামা নৃত্যাঙ্গন, নৃত্যনন্দন, চট্টল কুঁড়ি, নির্মাণ আবৃত্তি অঙ্গন, শাশ্বত ললিতকলা একাডেমি, গোধুলী সংগীত একাডেমি, নিক্কন একাডেমি, নৃত্য নিকেতন, সাধনা সঙ্গীত একাডেমি, আওয়ামী শিল্পীগোষ্ঠী, তারুণ্যের উচ্ছ্বাস, শব্দনোঙর, ছন্দানন্দ সাংস্কৃতিক পরিষদ, সুর সাধনা সঙ্গীতালয়, স্লোগান সাংস্কৃতিক স্কোয়াড, সপ্তস্বর সঙ্গীত বিদ্যালয় ও সৃজামি।
বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে আগের দিন রাতেই সিএমপির পক্ষ থেকে সিআরবির শিরীষতলার অন্তঃত এক কিলোমিটার দূরে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রের সামনে প্রতিবন্ধক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সিআরবিতে প্রবেশের তিনদিকেও গাড়ি প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে শিরীষতলায় যেতে লোকজনকে গরমের মধ্যে হেঁটে পথ পাড়ি দিতে হয়েছে অনেক দূর। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ভোগান্তিও ছিল। বিশেষ করে যেসব শিল্পীরা মঞ্চে অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন, তাদেরও পায়ে হেঁটে যেতে হয়েছে।
চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা : চবি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে সকাল ১০টায় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়। রমজান মাসের কারণে মঙ্গল শোভাযাত্রা কাজীর দেউড়ি পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসে। চারুকলা অনুষদে এবারের আয়োজন চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরীকে উৎসর্গ করা হয়। সেই প্রেক্ষিতে চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরীর স্লোগান ‘শিল্পের প্রয়োজন; বিবেকের জন্য, জীবনের জন্য’কে প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আক্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেণু কুমার দে এবং চারুকলা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক প্রণব মিত্র চৌধুরী শোভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন। শোভাযাত্রায় আবহমান বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীকী উপস্থাপনের নানান বিষয় স্থান পেয়েছে। শোভাযাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন স্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। ইলিশ মাছ, মুরগী, টুনটুনি পাখি, ঘোড়ার প্রতিকৃতি, সিংহ, পেঁচাসহ বিভিন্ন প্রাণীর মুখোশ এবং রঙ-বেরঙের সরাচিত্র স্থান পায় শোভাযাত্রায়। এছাড়া পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে পুরো বাদশা মিয়া সড়ক আলপনায় ভরিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রীষ্মের তাপদাহ উপেক্ষা করে উৎসবপ্রিয় বাঙালি শোভাযাত্রায় অংশ নেন। ২০১৬ সালে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় বাঙালির এই শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘিরে নগরীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছিল। মোতায়েন ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য।
চারুকলা অনুষদে এবারের আয়োজন চিত্রশিল্পী রশিদ চৌধুরীর ৯০তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে উৎসর্গ করা হয়েছে। চারুকলা চত্বরে দিনব্যাপী লোকজ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন আয়োজন ছিল।
শিল্পকলা একাডেমির আয়োজন : এদিকে বাংলা বর্ষবরণ-১৪২৯ উপলক্ষে ‘মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে সকাল ৯টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে বাদ্যের তালে তালে বাংলা ঐতিহ্যের উপকরণ পালকি, পুতুল, ঘোড়ার গাড়ি, প্ল্যাকার্ড ও অন্যান্য উপকরণ নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি দামপাড়া এম এম আলী সড়ক ঘুরে পুনরায় শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শেষ হয়।
বর্ষবরণ উপলক্ষে সকাল ১০টায় শিল্পকলা একাডেমির মুক্তমঞ্চে আলোচনা সভা ও পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমানের সভাপতিত্বে ও আবৃত্তিকার ফারুক তাহেরের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী ও জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এস.এম রশিদুল হক। উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (স্থানীয় সরকার) মো. বদিউল আলম, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নাজমুল আহসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহাম্মদ মাহমুদ উল্লাহ মারূফ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (ভূমি অধিগ্রহণ) মো. মাসুদ কামাল, শিল্পকলা একাডেমির জেলা কালচারাল অফিসার মোসলেম উদ্দিন সিকদার, শিশু একাডেমির জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা মুহাম্মদ নুরুল আবছার ভূইয়া প্রমুখ। শেষে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রাংকন ও কুইজ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। সবশেষে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে জেলা শিল্পকলা একাডেমিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের শিল্পীরা মনোমুগ্ধকর দলীয় নৃত্য ও সংগীত পরিবেশন করেন।
এছাড়াও বৈশাখকে বরণ করে নিতে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনও। এবার রমজান মাস হওয়ায় পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের আয়োজন নেই। তবে নববর্ষ বরণে মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাটলে যৌন হয়রানির অভিযোগ চবি ছাত্রীর
পরবর্তী নিবন্ধমাহে রমজানের সওগাত