উন্নয়নের যন্ত্রণা, অসহায় মানুষ এবং রশি টানাটানি

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

কলেজছাত্রী শেহেরীন মাহমুদ সাদিয়ার কথা মনে আছে? ফুটফুটে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল আগ্রাবাদে নালায় পড়ে। গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর ঘটা এই মর্মান্তিক ঘটনাটির স্মৃতি এক বছর না যেতেই আমরা ভুলতে বসেছিলাম। শুধু এই ঘটনাটিই নয় এমন অনেক বিয়োগাত্মক ও মর্মান্তিক ঘটনা আমরা কিছুদিন যেতে না যেতেই ভুলে যাই। ভুলে যাই কারণ এমন আরেকটি ঘটনা আগের ঘটনাটিকে চাপা দিয়ে যায়। প্রতিনিয়ত এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে আমাদের অনুভূতি ভোতা হয়ে যায়, দুঃখগুলো গা সওয়া হয়ে যায়। অথবা এটাও হতে পারে যে, বেশি মানুষের দেশ বলে হয়ত দুচারজন মানুষের মৃত্যু আমাদের খুব বেশি ব্যথিত করে না। এমনকি কারো অবহেলায় মৃত্যু হলেও।
ভুলে যাওয়া ঘটনাটি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে বলে আবার আলোচনায় এসেছে। সে ঘটনার একটি তদত রিপোর্ট নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হওয়ায় মনে পড়েছে হতভাগা মেয়েটির কথা। গত বছর ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদে নবী টাওয়ারের কাছাকাছি নাছিরছড়া খালে পড়ে তলিয়ে যান শিক্ষার্থী সাদিয়া। পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় তার লাশ উদ্ধার হয়। এরপর ১৯ অক্টোবর এ বিষয়ে আইনি নোটিশ পাঠানো হয়। ২৫ নভেম্বর হাই কোর্টে সাদিয়ার মৃত্যুর জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করে সাদিয়ার পরিবার এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্র।
ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাই কোর্ট রুল জারি করেন। পাশাপাশি কার অবহেলায় সাদিয়ার মৃত্যু, তা অনুসন্ধান করে হাই কোর্টে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। সে অনুসারে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সিনিয়র অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার তানভীর হাসান চৌধুরীকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেন। অনুসন্ধান শেষে প্রতিবেদন হাই কোর্টে দাখিল করা হয়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী মো. শাহীনুজ্জামান গণমাধ্যমকে বলেন, প্রতিবেদটি দাখিলের পর আদালত নথিভুক্ত করে রেখেছেন। পরবর্তীতে এ বিষয়ে আদালত আদেশ দেবেন। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের সে তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় সিডিএর ফুটপাত সংস্কারের সময় নালার ওপরের অংশ সংস্কার করে অথবা নালাটির সম্মুখ অংশ সুরক্ষিত করে এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।’
গত রবিবার আজাদীতে তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে সংবাদ ছাপা হয়েছে। এটা পড়ে আমাদের অনেকের মনে পড়েছে। তা না হলে এই লেখাটিরও অবতারণা হতো না হয়ত। সাদিয়ার ঘটনাটির মাসখানেক আগে ২৫ আগস্ট মুরাদপুর এলাকায় খালে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক ব্যক্তি।
এমন দুর্ঘটনা নতুন নয়। এর আগে একই বছরের ৩০ জুন ষোলশহর ২ নম্বর গেইটের মেয়র গলিতে বৃষ্টির সময় সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নালায় পড়ে গেলে তাতে দুইজনের মৃত্যু হয়। এ সময় আহত হন আরও তিনজন। তারও আগে ২০১৯ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সামনে স্ল্যাবহীন নালায় পড়ে ভেসে গিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত এক সরকারী কর্মকর্তা। পরে তার লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল বাকলিয়া থেকে।
এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে প্রত্যেকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে। যদি নালায় স্ল্যাব বা যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকতো তাহলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতো না। এখন প্রশ্ন হলো এই কর্তৃপক্ষ কে বা কোনটি? নিঃসন্দেহে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। কারণ নালা-খাল পরিষ্কার রাখা, নিরাপদ রাখা সর্বোপরি নগরবাসীকে সেবা প্রদানের দায়িত্ব তো সিটি করপোরেশনের। তাই এই ব্যর্থতার ভার, জীবনহানির দায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনকেই নিতে হবে। নিতে হবে বললাম বটে, নিতে বাধ্য করবে কে? সে সংস্থার জবাবদিহি কে নিশ্চিত করবে? এমন ঘটনার পর দায় নিয়ে কেউ দুঃখ প্রকাশ করেছে বলে শুনিনি। ব্যর্থতা বা কর্তব্যে গাফেলতির কারণে কাউকে অভিযুক্ত করা তো দূরের কথা প্রশ্নও তোলা হয়নি। অর্থাৎ নাগরিকদের জীবন কতটা নিরাপদ তা নিয়ে ভাববারও সময় নেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, যাঁরা নির্বাচনের আগে সবার দুয়ারে এসে ভোট ভিক্ষা করেন।
সাদিয়া, সালেহ আহমদরা সাধারণ মানুষ। এমন দুচারজন সাদিয়া, সালেহ আহমদ বানের তোড়ে ভেসে গেলেও তাতে রাষ্ট্রযন্ত্রের কিছু হয় না। প্রশাসনের খুুব বেশি টনক নড়ে না। কাউকে কোথাও জবাবদিহিও করতে হয় না। সেবা সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দিয়ে রেহাই পেতে চান। এ যেন ব্যাডমিন্টন খেলা। টেনিস বা ভলিবলও বলতে পারেন। নগরবাসীকে কর্ক কিংবা বলের মতো একপক্ষ তীব্রভাবে ঠেলে দিচ্ছে বিপরীত কোর্টে। ও পক্ষ ঠেলে দিচ্ছেন এ কোর্টে। প্রকৃত বিচারটি হবে না। দায়িত্বহীনতার সংস্কৃতি বন্ধ হবে না। মাঝখানে কর্তৃপক্ষের গাফেলতির কারণে জীবন যাবে, ক্ষতিপূরণ কখনো পাবে না। কারণ এ দেশে সে সংস্কৃতি গড়েই ওঠেনি। ভাগবাটোয়ারার পর যতটুকু উন্নয়ন হয় তা-ই আমাদের চরম সৌভাগ্য বলে ধরে নিয়ে মহান নেতাদের মাথায় তুলে রাখি।
অথচ বিশ্বের যেকোনো সভ্য দেশে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ক্ষতিপূরণ না দিয়ে পার পেতো না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
এবার উন্নয়নের ভোগান্তি নিয়ে বলতে চাই। দু-তিনদিন আগে আমার অনুজপ্রতীম এক লেখক দুঃখ করে বললেন, ভাইয়া কাঠগড় বাসস্ট্যান্ড থেকে লালখান বাজার মোড় পর্যন্ত আসতে লেগেছে আড়াই ঘণ্টা। আবার যেতে লাগবে কম করেও আড়াই ঘণ্টা। প্রতিদিন সড়কেই যদি পাঁচ ঘণ্টা চলে যায় তাহলে আর কাজ করব কয় ঘণ্টা? স্বাভাবিক সময়ে এটা ছিল ত্রিশ মিনিটের পথ।
লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলছে প্রায় দু বছর ধরে। এই দুই বছর ওই পথে চলাচলকারী, ওই স্থানে বসবাসকারী, অথবা চাকরি, ব্যবসা ও কর্মসূত্রে প্রতিদিন যাতায়াতকারীরা জানেন কী এক দুর্বিষহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে সেখানে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ চলায় সড়কের মধ্যভাগে স্বাভাবিক নিয়মে চলাচল বন্ধ। এরপর সংকীর্ণ হয়ে পড়া সড়কটি দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়েছে তা-ও দীর্ঘ সময় আগে। অবস্থা এখন এতটা খারাপ হয়েছে যে, এটাকে সড়ক হিসেবে চিহ্নিত করারও উপায় নেই। বড় বড় গর্ত, খানাখন্দ কোথাও কোথাও ডোবার রূপ নিয়েছে। সেখানে গাড়ি পড়লে উঠতে পারে না। মানুষ পড়লে উঠতে পারে না। দুর্ঘটনা এখন সে এলাকার স্বাভাবিক ঘটনা। এই সড়কে চলতে গিয়ে বিকল হয়ে পড়ছে গাড়ি। তাতে প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। রোগীদের হাসপাতালে আনার আগে পথেই মৃত্যু ঘটছে। শিশু, নারী, প্রসূতি ও বয়স্কদের পক্ষে হেঁটে বা যানবাহনে যাতায়াত করাও সম্ভব হচ্ছে না। পথিমধ্যেই অনেকে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন, কেউবা পথিমধ্যেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিদিন এই সড়ক দিয়ে আসা-যাওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সল্টগোলা থেকে কাঠগড় পর্যন্ত সড়কে নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হলেও তার প্রভাব পড়েছে বিশাল এলাকাজুড়ে। আসলে এই উন্নয়নকাজের খেসারত দিতে গিয়ে এই এলাকায় বসবাসকারী সবার জীবনযাত্রাও পাল্টে গেছে। সামাজিকতা ব্যহত হয়েছে। সামাজিক জীবন অচলাবস্থায় পড়েছে।
এই অবস্থা নতুন নয়। এর আগে বহদ্দারহাট ওভারপাস ও আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভার নির্মাণের সময়েও নগরবাসী এমন দুরাবস্থা দেখেছে। যতদিন ওপরে কাজ চলেছে ততদিন নিচের সড়ক ছিল বেহাল। সে সময় সিটি করপোরেশন দোষ চাপিয়েছে সিডিএ-এর ওপর, সিডিএ চাপিয়েছে সিটি করপোরেশনের ওপর। মাঝখানে পড়ে বছরের পর বছর নাগরিকদের অবর্ণনীয় ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বেলাতেও একই ঘটনা। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রকল্পের কাজের জন্য সড়কের দায়িত্ব এখন সিডিএ-এর। ওরা কাজ শেষে সড়ক আমাদের কাছে বুঝিয়ে দিলে তখন আমরা কাজ করতে পারব। আর সিডিএ বলছে, আমরা ওপরে কাজ করছি, নিচের সড়কের দায়-দায়িত্ব আমাদের না। দুই সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানের ‘টাগ অব ওয়ার’ বা রশি টানাটানিতে পড়ে স্থানীয়দের এখন নাভিশ্বাস উঠেছে। উন্নয়নের জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতা হারিয়েছে নাগরিকরা।
প্রশ্ন হলো এই ভোগান্তি কেন দিচ্ছেন তারা? সাধারণ মানুষের প্রতি সামান্য মমতাও কি তাদের নেই? বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কিন্তু তা থেকে উত্তরণের প্রচেষ্টা বা উদ্যোগ কারো নেই কেন? সড়কটি সিটি করপোরেশনের। উন্নয়নকাজ করছে বর্তমানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বা সিডিএ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনের ম্যাঙ কোম্পানি। চীনারা বিদেশি। ওরা কাজ করতে এসেছে। কাজ শেষে চলে যাবে। কিন্তু চসিক বা সিডিএ তো চট্টগ্রামের। এই নগরের নাগরিকদের সেবা প্রদানের লক্ষেই তো এ দুটো প্রতিষ্ঠানের জন্ম। এই দুই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে সবাই তো এ দেশেরই সন্তান, চট্টগ্রামেরই সন্তান। কর্তাব্যক্তি হিসেবে বাদ দিলাম সাধারণ বিবেকবান মানুষ হিসেবেও কি তাদের সামান্য সহানুভূতি জন্মায় না কয়েকলাখ মানুষের প্রতি যারা দু বছর ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।তাঁরা এই দীর্ঘ সময়ে একবারও কি সে এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন? জনগণের সামনে নিজেদের অপারগতায় জন্য ক্ষমা চেয়েছেন? যে কোনো সভ্য দেশে তাই করা হতো।
শুধু সড়কের বেলায় নয় যে কোনো উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ও সুবিধা-অসুবিধার কথা একেবারেই ভাবা হয় না। কর্মক্ষেত্রেও দেখা যায় শ্রমিক-কর্মচারী, আশেপাশে বসবাসকারীদের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো ভাবনাচিন্তা নেই। আগ্রহ নেই। যারা উন্নয়নকাজ করেন তারা কোনো এক কারণে উৎপীড়নমূলক মনোভাবে ভোগেন। তারা মনে করেন, উন্নয়নের কাজ যখন করছি তার মূল্য তো দিতে হবে। কিন্তু তারা ভুলে যান যে, এই দেশের মালিক জনগণ। তারা মালিকের কাজ করার সামান্য দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধকৌতুক কণিকা
পরবর্তী নিবন্ধসাবান-ডিটারজেন্টের খুচরা মূল্য যাচাই হচ্ছে