উজাড় হচ্ছে বনভূমি : কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | বৃহস্পতিবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে প্রচুর বনাঞ্চল ও গাছপালা দেখতাম। সেসব বনে ছিল প্রচুর পাখি, হরিণ, সাপসহ অন্যান্য বন্য প্রাণী। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন নতুন ভবন তৈরী হচ্ছে। ফলে আশেপাশের বনাঞ্চল ও জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হচ্ছে। এটা যে শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে তা নয়। পুরো দেশেই প্রতিদিন হাজার হাজার গাছপালা বিলীন হচ্ছে। বিলীন হচ্ছে জলাশয়, টিলা ও পাহাড়। কিন্তু এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে আমরা সচেতন নই। আমাদের মনে রাখা দরকার চোখের সামনে যে পাহাড়টি দেখছি, সেটির বয়স কয়েক লাখ বছর। বিধাতা পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য এটি তৈরী করেছেন এবং এর সাথে বেড়ে ওঠা জীববৈচিত্র্য আমাদের জীবনে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে।এই জীববৈচিত্র্য বিলুপ্ত হলে পৃথিবী মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাবে। এরপরেও আমরা বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষ নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসে লিপ্ত।এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনে। সমপ্রতি সুন্দরবনকে নিয়ে ‘উন্নয়ন অন্বেষণে’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। খুলনার কয়রা উপজেলায় এই গবেষণাটি করা হয়েছে। নির্বাচিত এলাকার দৈর্ঘ্য ৪০ কিলোমিটার, প্রস্থ ৩০ কিলোমিটার। বনজীবীদের অংশগ্রহণমূলক ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থার মাধ্যমে এটি করা হয়েছে। আমেরিকার ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও ইউরোপীয় কমিশনের কোপার্নিকাস প্রোগ্রাম থেকে সংগৃহীত বেশ কয়েকটি রিমোট সেন্সিং চিত্রও এতে ব্যবহার করা হয়েছে।এতে বলা হয়, সুন্দরবনে গত বিশ বছরে ঘন বনের পরিমাণ কমেছে প্রায় অর্ধেক। এতে দেখা যায় প্রথম দশ বছরে ব্যাপক হারে ঘন বন উজাড় করা হয়েছে যাতে গাছ পালার ঘনত্ব কমে যায়, ফলে বনের বিস্তার কমতে থাকে। তবে এ সময়ে পতিত জমি বৃদ্ধির হার কম ছিল। পরবর্তী দশ বছরে প্রায় দ্বিগুণ হারে খালি জমির পরিমাণ বেড়েছে। অর্থাৎ একটা সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও সময় নিয়ে আস্তে আস্তে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করা হয়। আবার কোনো কোনো জায়গায় আগুন লাগিয়েও বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়। বর্তমানে বনের চারপাশে গাছপালা দেখা গেলেও ভেতরে ব্যাপক অঞ্চলজুড়ে ফাঁকা। বনের বিস্তার আগের তুলনায় কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৭৭৬ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশ ছিলো ১৭,০০০ বর্গকিলোমিটার আর ২০১৬ সালে ৬,৪৬৭ বর্গকিলোমিটার। ফলে সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন। বিশ্বে জীববৈচিত্র্য হ্রাসের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাব অনুসারে বিশ্বে ২০০০-২০১৫ সময়কালে প্রায় ১.৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে তবে একই সময়ে বাংলাদেশে বন উজাড় হয়েছে ২.৬ শতাংশ। জাতিসংঘের ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের ৮০ লাখ উদ্ভিদ প্রাণীর ১২.৫ শতাংশ বিলুপ্তির মুখোমুখি। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ইউনিয়ন আইইউসিএনের হিসাবে বিশ্বে ১৬১৯ প্রানপ্রজাতির ২৪% খুব শিগগির অদৃশ্য হয়ে যাবে। সুন্দরবনের বিস্তার ক্রমশ ছোট হয়ে আসায় অনেক উদ্ভিদ প্রজাতির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কমছে সুন্দরী গাছ। উদ্ভিদ বৈচিত্র্য হ্রাসের কারণে বিভিন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মুখীন।এতে গাছগুলোর গড় উচ্চতা হ্রাস পাচ্ছে। পাখি, বানর ও গাছে বসবাসকারী অনেক প্রাণীর বাসস্থান হুমকির মুখে পড়েছে। বৈশ্বিকভাবে বিপদগ্রস্ত বন্য প্রাণীর প্রায় ৩১টির বেশি প্রজাতি সুন্দরবনে রয়েছে। বন বিভাগের তথ্য মতে বিপদগ্রস্ত বন্য প্রাণীর মধ্যে রয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, রাজগোখরা, অজগর, এডজুটেন্ট স্টক পাখি, সাদা পেটের সমুদ্র, উদবিড়াল, ঈগল, মাসকেড ফিনফুট বা কালামুখ প্যারাপাখি, রিং লিজার্ড, মেছো বাঘ, স্যন্ড পাইপার,ইগল ও মদনটাক পাখি ইত্যাদি। আইইউসিএনের হিসাব অনুযায়ী মোট ৪০টিরও বেশি প্রজাতির উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীকে মহাবিপন্ন হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে আইইউসিএন ইতিমধ্যে বিপন্ন প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হবে বলে সর্তক করেছে। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সংখ্যাও দিনকে দিন কমছে। ২০০৪ সালে বাঘের সংখ্যা ছিলো ৪৪০টি আর ২০১৯ সালে বন বিভাগের সর্বশেষ জরিপে হলো ১১৪ টি। তাই সুন্দরবনে বাঘ সংরক্ষণ অতি জরুরি। অথচ নেপাল চার বছর আগেই বাঘের সংখ্যা দুই গুণ করেছে আর ভারতেও দুইগুণের কাছাকাছি চলে গেছে। তবে আশার কথা হলো বাংলাদেশ বন বিভাগ বাঘ রক্ষায় নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাও বাঘ সংরক্ষণে কাজ করছে।
মানুষসৃষ্ট চাপ,জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক কারণেই সুন্দরবন ও এর জীববৈচিত্র্য আজ চরম হুমকির সম্মুখীন। রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী অবৈধ ভাবে বন দখল করছে। বনের চারপাশে মানুষের বসতি বাড়ছে,অবৈধভাবে গাছ কাটার কারণে বন উজাড় হচ্ছে। বনের চারপাশে পরিবেশগত দিক দিয়ে সংকটময় এলাকায় দিন দিন নানা বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাচ্ছে। বনজ সম্পদের অতিরিক্ত আহরণের কারণে জীববৈচিত্র্য নষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিকর উপায়ে সম্পদ আহরণের কারণে নানা প্রজাতি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। অহরহ বিষ ও কারেন্ট জালের মাধ্যমে মাছ সংগ্রহ করা হচ্ছে। যারা লাইসেন্স নিয়ে বনের গাছ বা প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে তারা পরিমাণের অতিরিক্ত সম্পদ আহরণ করছে। অন্যদিকে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জীববৈচিত্র্য ক্ষতির মুখে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে নানা জৈব ও অজৈব উপাদান পরিবর্তিত হচ্ছে।
জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা (এফএও) ২০১৮ সালের ৯ জুলাই বনবিষয়ক এক প্রতিবেদনে (দ্য স্টেট অব গ্লোবাল ফরেস্ট-২০১৮)বলেছে বাংলাদেশের মোট ভূখণ্ডের ১৩ শতাংশ বনভূমি। তবে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এই তথ্য মানতে নারাজ। মন্ত্রণালয়ের দাবি, দেশের মোট আয়তনের ১৭ শতাংশ বনভূমি (বন ও বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা)। শুধু সুন্দরবন নয় দেশের অন্যান্য বনাঞ্চলেও প্রতিনিয়ন বনভূমি উজাড় করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা বসতি স্থাপনের জন্য ২০১৮ সালের প্রথম ছয় মাসে কঙবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে উজাড় হয়েছে ৫,০০০ একর বনভূমি। কঙবাজারের আরেক উপজেলা মহেশখালীর সংরক্ষিত বনের ২০০ একর জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়েছে অপরিশোধিত তেলের ডিপো ও পাইপলাইন স্থাপনের জন্য। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বনের জায়গায় গড়ে উঠছে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বিদ্যুৎকেন্দ্র। চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকায় গাছ কেটে করা হয়েছে শিপ ইয়ার্ড ও অন্যান্য স্থাপনা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে অবাধে কাটা হচ্ছে গাছপালা। বিভিন্ন গহীন অরণ্যে গাছপালা ধ্বংস করে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বনভূমি পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ (জিএফও) ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট (ডব্লিউআরআই) ২০১৮ সালের ২৭ জুন প্রকাশ করা প্রতিবেদনে, এতে বলা হয় গত সাত বছরে বাংলাদেশে ৩ লাখ ৩২ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর সারা বিশ্বে বাংলাদেশের সমপরিমাণ বনভূমি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় বনভূমি উজাড় হওয়ার দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল। ২০১০ সালে দেশের মোট বৃক্ষসম্পদের ৬০ শতাংশ ছিল এই এলাকায়। গত সাত বছরে তা কমে প্রায় ১০ শতাংশ হয়েছে। দুটি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে তুলে ধরা তথ্য সঠিক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলেন, বিভিন্ন সরকারি সংস্থার নামেই প্রায় দুই লাখ হেক্টর বনভূমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।যার বেশির ভাগ চট্টগ্রাম বিভাগে। তাঁদের দাবি, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলায় যেসব জেলা প্রশাসক দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা বন সংরক্ষণের বিষয়টি সঠিক ভাবে অনুধাবন করেননি। ফলে তাঁরা আবাসন থেকে শুরু করে নানা প্রকল্পে বনের জমি বেশি করে বরাদ্দ দিয়েছেন।এ ছাড়া পার্বত্য চুক্তির পর সেখানে সরকারি কোনো একক সংস্থা বন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নেই। ফলে পার্বত্য অঞ্চলেও দ্রুত বনভূমি কমছে।
এদিকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে গেলে বাংলাদেশকে বনভূমির পরিমাণ ২২ শতাংশে নিয়ে যেতে হবে। সরকার জাতিসংঘের কাছে এই অঙ্গীকার করেছে। তবে এভাবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বনভূমি বরাদ্দ দিতে থাকলে এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ দুরূহ হয়ে যাবে।
প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক জোট আইইউসিএন ২০১৭ সালে ফরেস্ট অ্যান্ড ওয়াটার (বন ও পানি) শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলেছে, বনভূমি শুধু জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের আধারই নয়, বৃক্ষ প্রচুর সুপেয় পানি ধরে রাখে। ফলে কোনো এলাকায় বনভূমি কমে গেলে সেখানে মরুকরণ ভূমিধস ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় বেড়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে যে কোনো দেশের মোট ভূখণ্ডের ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকতে হয়, বাংলাদেশে তা নেই। অধিকন্তু প্রতিবছরই বনভূমি উজাড় হচ্ছে। তাই বন রক্ষায় সবার আগে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। না হলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব হয়ে পড়বে হুমকির সম্মুখীন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজন্মদিনে নানা কর্মসূচি শেখ হাসিনার বিকল্প নেই
পরবর্তী নিবন্ধআগ্রহ যদি যোগাযোগ ও সাংবাদিকতায় চট্টগ্রামে ভরসা পোর্ট সিটি বিশ্ববিদ্যালয়