পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বাধিক আলোচিত অধ্যায়ের নাম ফরাসি বিপ্লব। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে সাম্য, মৈত্রী আর স্বাধীনতাকে মূলমন্ত্র হিসেবে বুকে ধারণ করে কয়েক শতক ধরে চলমান রাজতন্ত্রের অন্যায় ও সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটায় ফরাসি জাতি। তবে রাজতন্ত্রের অন্যায় অনাচারের প্রতি আঙুল তোলার সাহস ও শক্তিতো এমনি অর্জিত হয় না; তার জন্য চাই বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনা। অষ্টাদশ শতকের গোড়া থেকেই একটু একটু করে জাগতে শুরু করে ফ্রান্সের জনমানুষ। ভলতেয়ার, মণ্টেস্কু, দিদেরো, রুশোরা আলো ছড়াতে শুরু করেন কলম হাতে। অবশেষে ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাইয়ে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। নৃশংসতার প্রতীক বাস্তিল দুর্গকে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রথমবারের মতো রাজতন্ত্রের শৌর্যবীর্য প্রতিপত্তিকে উপেক্ষা করার মধ্য দিয়ে জনতার বিজয় ঘোষিত হয়। ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় এরপর। আধুনিকতার পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যায় মানব সভ্যতা।
ফরাসি বিপ্লবকে যুগে যুগে এভাবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে ইতিহাস গ্রন্থের পাতায় পাতায়, যদিও এর ব্যাপ্তি ও জটিলতা খুব সহজে অনুধাবন করা যায় না। দুনিয়া কাঁপানো এই কাহিনীতে নারীর অবস্থান বা ভূমিকা কী ? ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে একজন নারীরই নাম উচ্চারিত হয়, ইতিহাস বইতে যিনি খলনায়িকা বৈ অন্য কিছু নয়। তিনি ফরাসি রাজমহিষী মেরি আঁতোনেতে; পুরো নাম মারিয়া এন্টোনিয়া জোসেফা জোয়ানা। তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে প্রচলিত ও আলোচিত তথ্য তিনি রুটির দাবিতে বুভুক্ষ জনতার মিছিলের শব্দে ত্যথ্যবির হয়ে ভার্সাই প্রাসাদের বিলাস ব্যসনে মত্ত থেকে বলে উঠেছিলেন- ‘লেট দেম ইট কেক’ (রুটি না পেলে ওদেরকে কেক খেতে বল)। তিনি বাংলা ভাষা জানলে হয়তো বলতেন- ভাত নেই তো কি হয়েছে? ওদের পোলাও খেতে দাও।
সত্যিই কি মেরি আঁতোনেতে এমন উক্তি করেছিলেন? না, তাঁর এই বক্তব্যের পক্ষে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায় না। তারপরও ‘রানীর উক্তি’ হিসেবে ইতিহাস বইতে মুদ্রিত হয়ে যায় এই অমোঘ বাণী! এবং শত শত বছর ধরে পরবর্তী ইতিহাসবিদগণ তারই পুনরাবৃত্তি করে চলেছেন। বিপ্লবীদের বিক্ষুব্ধ ও উজ্জীবিত করার জন্য মোক্ষম অস্ত্র পেয়ে যায় অতিবিপ্লবী রাজনীতিবিদেরা। রানীর পোশাক, অলংকার, পাদুকা, চুলের সাজ ছাড়াও দাসদাসী সমভিব্যহারে চির অবকাশ যাপনের খবর মানুষের মুখে মুখে। রানীর চরিত্রে কালিমা লেপনের জন্য উঠেপড়ে লাগে গণমাধ্যম। সফল হতে সময় লাগে না তাদের। তীব্র ঘৃণা অর্জন করেন রানী দেশজুড়ে। শত শত বছরের অপশাসন, অনাচার, আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, সরকারের দেউলিয়াপনা, ত্রুটিপূর্ণ বিচারব্যবস্থা, রাজপুরুষ, ধর্মযাজক ও অভিজাতদের অনৈতিক জীবনযাপন সবকিছুকে ছাপিয়ে রানী মেরির জনতাকে ‘কেক খেতে বলা’ তেই যেন জ্বলে উঠেছিল ফরাসি বিপ্লবের আগুন। সত্যিই কি সেই আগুনে পুড়ে অভ্যুদয় হয়েছিল নতুন মানবিক সভ্যতার?
সভ্যতায় মানবিকতার উত্থান হল কি হল না, সে-প্রশ্নের মীমাংসা আজও না হলেও রানী মেরিকে অনেক গঞ্জনা অপমানের মহড়া শেষে গিলোটিন নামক যন্ত্রের তলায় মাথা পেতে দিতে হয়েছিল উন্মুক্ত মঞ্চে (১৬অক্টোবর, ১৭৯৩)। তাঁর কাটা মস্তক নিয়ে উল্লাসে ফেটে পড়েছিল ফরাসি জনতা। হাজার হাজার মানুষ গিলোটিনের যাত্রী হয় পরের কয়েকটি বছরে। ধ্বংসস্তূপ হতে উত্থান হয় মহামতি (!) নেপোলিয়নের। রাজতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক পতনে স্বৈরতন্ত্রের চরিত্র আগের মতোই বহাল থাকে ফরাসি দেশে আরও কয়েক দশক জুড়ে।
কে ওই রানী মেরি? ১৭৫৫ সালের দোসরা নভেম্বরে ভিয়েনার রাজপ্রাসাদে তাঁর জন্ম। তাঁর বাবা ছিলেন হোলি রোমান এম্পায়ার প্রথম ফ্রান্সিস এবং মা উনিশ শতকের ইউরোপের সেরা শাসকদের একজন অষ্ট্রিয়ার সম্রাজ্ঞী মারিয়া থেরেসা, যাকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য হ্যাবসবার্গ রাজবংশকে আইন পরিবর্তন করতে হয়েছিল। ‘প্র্যাগমেটিক স্যাংশন’ (১৭১৩) নামের এ যুগান্তকারী আইন সত্যিই কি নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রথম মাইলফলক ছিল, নাকি মারিয়া থেরেসা প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের রাজনীতির দাবার গুটিতে পরিণত হলেন? এটাও কিন্তু ইতিহাসের এক জটিল প্রশ্ন। নারীর ক্ষমতায়নের যথার্থ রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে নারীকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার পেছনে রাজনৈতিক কারণই প্রধান ভূমিকা পালন করে। নারীর মেধা, যোগ্যতা- এসব খুব একটা বিচার্য বিষয় নয়। মধ্যযুগের মতো একালেও নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গটি নারীর অগ্রগতির বিজ্ঞাপন এবং চলমান ব্যবস্থার গৌরবের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। তবে মারিয়া থেরেসা একজন শক্তিশালী শাসক হিসেবে দেশ বিদেশে খ্যাতি লাভ করেছিলেন, সন্দেহ নেই।
ফিরে যাই মারিয়া থেরেসার ষোলজন সন্তানের মাঝে পঞ্চদশ মেরি আঁতোনেতের কাছে। দশটি কন্যার পর একাদশ কন্যা হিসেবে মায়ের কোলে আসে মেরি, যদিও কয়েকজনের অকালমৃত্যুর কারণে মেরির স্থান অষ্টমে উঠে আসে। অষ্ট্রিয়ার রাজকুমারী হিসেবে অনেক আনন্দময় শৈশব ছিল তাঁর। তবে লেখাপড়ায় নয়, নাচগান আর সাজসজ্জাতেই যত আগ্রহ। ব্যালে নাচে পারদর্শীতা অর্জন করেছিল। সাত বছর বয়সে সংগীত জগতের বিস্ময় বালক মোৎসার্টের সঙ্গে সুরসাধনা করার সুযোগ হয়েছিল তার। মেরির বয়স যখন এগার তখন তার মা সম্রাজ্ঞী মারিয়া তাঁর অসাধারণ কূটনৈতিক জ্ঞানের বদৌলতে ফরাসি বুরবোঁ রাজবংশের সঙ্গে অস্ট্রীয় হ্যাবসবার্গ রাজবংশের বন্ধন সুদৃঢ় করার বাসনায় তাঁর কনিষ্ঠা কন্যাটিকে ফরাসি যুবরাজের সঙ্গে বিবাহ দেওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেন। অতঃপর পনের বছর বয়সে ষোল বছর বয়সী এক অচেনা যুবরাজের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় মেরি।
ভিয়েনার প্রাসাদ ছেড়ে ভার্সাই প্রাসাদ। স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে- এ আর এমন কী! কিন্তু ফ্রান্সের মাটিতে পা দেবার সাথে সাথে মেরিকে অষ্ট্রিয়ার সব চিহ্ন পরিচয় ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়। পোশাক, গহনাতো বটেই, তার পোষা বেড়ালটিকেও সঙ্গে রাখার অনুমতি মেলেনি। বাবার বাড়ির পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে যায় মেরির জন্য। মা, ভাই-বোনদের সঙ্গে এই জীবনে আর দেখা হয়নি। ভাষা, সংস্কৃতি, খাবার সবকিছুই অন্যরকম। অচিনপুরিতে মানিয়ে নিতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয় নব পরিণীতাকে। সম্রাজ্ঞী মায়ের কন্যাকে কেন এভাবে দূরদেশে প্রেরণ করা হয়? কি এমন রাজকীয় দায়িত্ব বর্তায় সেই নিঃসঙ্গ কিশোরীর ওপর? এই পরিণয়ে কি ভালোবাসা ছিল?
মেরি’র কাজ একটাই- ফরাসি রাজপরিবারের জন্য উত্তরাধিকার, অর্থাৎ একজন ‘লুই’ উৎপাদন। প্রাসাদে পুত্রশিশুর কান্না শোনার জন্য চার চারটি বছর অপেক্ষা করতে হয় রাজতন্ত্রকে। অপেক্ষার দুঃসহ দিনগুলোতে মেরির পাশে কেউ থাকে না। মায়ের চিঠি আসে রাজকীয় দায়িত্ব পালনের কঠোর নির্দেশনা নিয়ে। কন্যার সুখ নয়, রাষ্ট্রের গৌরব আর দ্বিপাক্ষিক মৈত্রীই তাঁর প্রধান মোক্ষ। রাজনীতি আর রাজক্ষমতা বুঝিবা এমনই হয়। নিজের মতো কন্যাটিকেও তিনি ইউরোপের রাজনীতির দাবার গুটিতে পরিণত করলেন। ভাগ্য বলতে হয় সম্রাজ্ঞীর; কন্যার শেষ দিনগুলো তাঁকে দেখতে হয়নি। ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হবার আগের বছরই তিনি পরলোক গমন করেন।
এখন দেখা যাক- ফরাসি সমাজে কেমন করে ভাইরাল হয় ‘লেট দেম ইট কেক’। গবেষকগণের অভিমত- সম্ভবত জাঁ জ্যাক রুশো ১৭৬৬ সালে লিখিত একটি বইতে সর্বপ্রথম ‘লেট দেম ইট কেক’ কথাটির অবতারণা করেন, যদিও রুশো’র বর্ণিত ‘গ্রেট প্রিন্সেস’ ফরাসি রানী মেরি কি না, তা নিশ্চিত নয়। তবে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হবার পেছনে রুশোর ভূমিকাকেই সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়। তাঁর বিখ্যাত ‘সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট’ গ্রন্থের সেই মহান উক্তি Man is born free, but everywhere he is in chains” , যার বাংলা মর্মার্থ ‘মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, কিন্তু সমাজ তাকে প্রতিমুহূর্তে শৃঙ্খলিত করে’ – বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্র থেকে রাষ্ট্রে, আর পথ দেখিয়ে চলেছে মুক্তিকামী জনতাকে। কিন্তু রুশো’র Man যে আদতেই একজন পুরুষ সেকথা বোঝা যায় তাঁর অন্য রচনা হতে। ‘এমিলে’ নামক গ্রন্থে তিনি নতুন পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনে ছেলেদের লেখাপড়ার প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করেন। তাঁর মতে, মেয়েদের শিক্ষা হবে গৃহস্থালি ও সন্তান পালন বিষয়ক এবং তাদেরকে অবশ্যই স্বামীর বাধ্য ও অনুগামী হতে হবে। বড়ই পরিতাপের বিষয়, এই রুশোর দর্শনই আমাদের সমতার সমাজ প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করে চলেছে শত শত বছর ধরে।
পুরুষের বিজয় গাথায় ভরপুর ইতিহাসের ভারী ভারী গ্রন্থসমূহ। দিগ্বিজয়ী বীরগণের বন্দনায় ইতিহাসবিদের কালি ফুরোয় না। ইতিহাসের আশীর্বাদ বিরতিহীনভাবে বর্ষিত হয় মহানায়কগণের ওপর। আর নারী বরাবর পার্শ্বচরিত্র, অধিকাংশ ক্ষেত্রে খলভূমিকায়। আদিনারী হাওয়া বা ইভ হতে শুরু করে গ্রীক পুরাণের হেলেন, ফরাসি মেরি- সকলেই ইতিহাসের বলি হয়ে নেতিবাচক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় মানব সমাজে।