আশির দশকের চট্টগ্রাম কলেজে রাজনীতি ও সাহিত্য-সংস্কৃতি

ড. শিরীণ আখতার | শুক্রবার , ২৫ জুন, ২০২১ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

আমার শৈশব তারুণ্য কেটেছে দুই পিতার আদর্শ ও অনুপ্রেরণায়। একজন আদর্শিক পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আরেকজন আমার পিতা কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট আফসার কামাল চৌধুরী। দুজনই গত ও প্রয়াত। কিন্তু এখনও পর্যন্ত দুই পিতার আদর্শ ও অনুপ্রেরণাকে ধারণ করি।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন চট্টগ্রাম কলেজে বাংলা অনার্স পড়তে যাই, তখন সামরিক শাসন জিয়ার আমল। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে অবরুদ্ধ। চট্টগ্রাম কলেজের মেধা ও সংগ্রামের অতীত ইতিহাস রয়েছে। আমাদের সময়কার সতীর্থরা ছিল যোগ্য উত্তরসূরি। বঙ্গবন্ধু কিলিং-এর পর স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অবস্থা নাজুক ছিল। তখন ১৯৭৬-এর পরের দিকে অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠনের ক্যামোফ্লেজে কার্যক্রম শুরু করে। ‘বিবর্তন’ (সম্পাদক-কালাম চৌধুরী), ‘চন্দ্রবিন্দু’ (ইন্টারমিডিয়েট ছাত্রদের সংগঠন), ফারুক মঈনউদ্দীন এখানে লিখত। ‘শিহরণ’ (ছাত্র ইউনিয়ন পন্থীদের সংগঠন), ‘এক ঝাঁক পায়রা’ ইত্যাদি।
প্রিন্সিপাল আবু সুফিয়ান খুব কড়া প্রকৃতির লোক ছিল। তার ভাই আবু সালেহ এমএলএ ছিলেন। রাজনীতিতে তখন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ (বৈজ্ঞানিক), বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন (মৃদুল গুহ) সম্মিলিতভাবে ছাত্র ঐক্য পরিষদ গড়ে তোলে।
সেই সময় ওখানে বাংলা বিভাগের বেশকিছু মেধাবী সতীর্থদের আমরা পেয়েছিলাম। অভীক ওসমান ছাত্রলীগ (অন্য অংশ) চট্টগ্রাম কলেজের প্রেসিডেন্ট। এই সাদামাটা আবেগপ্রবণ তরুণের অনেক মেধা ছিল। তার কথায় পরে আসছি। তার আগে ষাটের দশক ও পরবর্তী সময়ের কিছু কৃতী ছাত্র ও উজ্জ্বল সময়ের স্মৃতিচিত্রপট তুলে ধরতে চাই।
১৯৬০ সালে প্রথমবার বাংলা অনার্স কোর্স চালু হলে তিনজন ছাত্র ও দুইজন ছাত্রী ভর্তি হন। এঁরা হলেন-শামসুল আলম সাঈদ, কাজী নাসির উদ্দিন ও কে এম আমীর খসরু, খালেদা খানম ও ফরিদা খানম। তার মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থজন ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন ও অধ্যাপক হিসেবে খ্যাতিমান হন। দ্বিতীয় ব্যাচে ১৯৬১ সালে ভর্তি হন নয়জন ছাত্র-ছাত্রী (৩ জন ছাত্র ও ৬ জন ছাত্রী)। এরা হলেন- শফিউল আলম, মোহাম্মদ হোসেন খান, এ কে এম রফিকুল ইসলাম, গৌরি চক্রবর্তী, রেণুকা দাশ, সালেহা খাতুন, দিল আফরোজ বেগম, উম্মেহানি আরা বেগম, ইলা মজুমদার, ছাত্রদের মধ্যে তিনজনই অধ্যাপনায় যোগ দেন ও সাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতিমান হন। ছাত্রীদের মধ্যে সালেহা খাতুন কাপাসগোলা গার্লস স্কুল ও কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং দিল আফরোজ বেগম বাংলাদেশের প্রথিতযশা ক্রিকেটার মিনহাজুল আবেদীন নান্নুর মা হিসেবে পরিচিত। রেনুকা দাশ ও ইলা মজুমদার পরবর্তীকালে কলকাতায় স্থায়ী হন।
১৯৬২ সালে তৃতীয় ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা হলেন- মনসুর মুসা, অর্ধেন্দু বিকাশ রূদ্র, মৃণাল চক্রবর্তী, নাজমা বেগম, মুহম্মদ শামসুল আলম, নিরঞ্জন দেবনাথ, হিরন্ময় চক্রবর্তী, আবদুল ওয়াহাব, দীপ্তি ভট্টাচার্য, দিলারা আলো, একে এম হারুনুর রশীদ, লীনা রায় (কানুনগো), হাসিনা বেগম, শাহজাহান মুনীরপ্রমুখ। ১৯৬৬ সালে ভর্তি হওয়া ব্যাচের কয়েকজন হলেন- মাহবুবুল হক, মো. আবুল কাসেম, শিপ্রা রক্ষিত দস্তিদার, আমিরুজ্জামান, এ ওয়াই এম জাফর, এম এ আউয়াল, জাহাঙ্গীর, সেলিম, হানিফ, একেএম আজিজ উদ্দিন, গোপা নন্দী, সহবুবা খাতুন, জেবুন্নাহার, শওকত আলী, দীপক বড়ুয়া, ফাতেমা বেগম, নুরুন্নাহার মেমী, স্বস্তিকা দেবী, শফিনা বেগম। তাঁদের মধ্যে ড. মাহবুবুল হক, ড. মো. আবুল কাসেম, ড. শিপ্রারক্ষিত দস্তিদার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবষণা ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ড. মো. আবুল কাসেম কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে ভর্তি হন শেখর দস্তিদার, হরিশংকর জলদাস, সনজীব চৌধুরী, রেশমা, হাসি, নিশা, হারুন, মহসিন, আশীষ প্রমুখ। শেখর দস্তিদার চট্টগ্রাম কলেজে ছাত্ররাজনীতি ও আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। অধ্যাপনা জীবনের শেষপর্বে এসে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ হন এবং চট্টগ্রাম কলেজের ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেন। হরিশংকর জলদাস শিক্ষকতা জীবনের শেষদিকে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের অধ্যক্ষ হন ও সাহিত্যিক হিসেবে সমাদৃত হন।
১৯৭৫ সালে কলেজের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন ওসমান গনি চৌধুরী, নেছার আবছার, ফয়েজ উল্লাহ, স্বরূপা, ফিরোজা বেগম, মনোয়ারা, শাহ সুলতানা, তাহেরা, সৈয়দা দুরবী শাহওয়ার, শাহিদা। ওসমান গনি চৌধুরী কলেজের ছাত্র রাজনীতিতে যেমন তৎপর ছিলেন তেমনই কর্মজীবনে চট্টগ্রাম চেম্বারের সচিব ও প্রধান নির্বাহী হিসেবে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। সাহিত্যক্ষেত্রে ‘অভীক ওসমান’ নামে খ্যাতি লাভ করেন।
১৯৭৬ সালে আমাদের ব্যাচের ছাত্রী আমিসহ জেবুন্নেসা, প্রতিমা, বোরহান উদ্দিন, মাহবুবুর রহমানসহ ৩২ জন মেয়ে ও দুজন মাত্র ছেলে ছিল। আমাদের উদ্দেশ্যে আ.ফ.ম. সিরাজ-উদ্‌-দৌলা স্যার রসিকতা করে বলতেন, ‘বত্রিশ গোলাপীর এই কৃষ্ণ । কিরে মাহবুব, বোরহান তোমাদের কী অবস্থা। সামলাবে কী করে ওদের।’ ১৯৭৭ সালের ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীরা হলেন সৈয়দ উমর ফারুক, সত্যব্রত খাস্তগীর, হাবিব রহমত উল্লাহ, ফাতেমা, জেসমিন আক্তার ও অন্যরা। সৈয়দ উমর ফারুক ছাত্রজীবনে সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি কলেজকেন্দ্রিক ছাত্র রাজনীতি করেন। দৈনিক ‘জমানা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, বর্তমানে বীর চট্টগ্রাম মঞ্চ-এর সম্পাদক। জেসমিন আক্তার পরে চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
পরবর্তী সময়ে ১৯৭৯ সালের ব্যাচের ছাত্র মহীবুল আজিজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করছেন। শিক্ষক, গবেষক ও লেখক হিসেবে মহীবুল আজিজ সুখ্যাতি লাভ করেন।
আশির দশকের মধ্য সময়ে কোনো কালচারাল কার্যক্রম করা যেত না। ছাত্র ঐক্য পরিষদের নেতারা রাতে জিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ালিং করতে গেলে তৎকালীন প্রিন্সিপাল তাদের পুলিশে সোপর্দ করেন। এরইমধ্যে শেখর দস্তিদার, অভীক ওসমান, মাহবুবুর রহমান, মোহাম্মদ ঈসা, ইউসুফ তালুকদার অন্যতম। গভীর রাতে অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত তাদের কোতোয়ালি থানায় দেখতে যান। অভীক ওসমানসহ এইসব ছাত্রনেতাদের তখন কী জনপ্রিয়তা ছিল! তারপর দিন চট্টগ্রাম কলেজ ছিল উত্তাল, থমথমে। প্রশাসন ছিল ভীত সন্ত্রস্ত। তারা দুয়েকদিনের মধ্যে মুক্তি পান।
তখন ‘বিবর্তন’ থেকে এসএম সোলায়মান রচিত একটা নাটকের রিহার্সেল চলছিল। পরে অভীক ওসমান জীবনের প্রথম নাটক লিখেন ‘তিরোহিত সুন্দর আমার’। জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে তিনি বাংলা নাটকে প্রথম ব্যবহার করেন। এটি ১৯৭৬ সালের ২ জুন বিবর্তন প্রযোজনায় মুসলিম হলে মঞ্চস্থ হয়। ১৯৭৬ ১৮জুন পূরবী ললিতকলা একাডেমির প্রযোজনায় সেন্ট মেরীজ হলে মঞ্চস্থ হয়। মূলত নাট্যকার অভীক ওসমানের উত্থান এখান থেকেই। অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে অভীক ওসমান রচনা করেন ‘রাত ফেরার’ (১৯৭৮)। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তার পথনাটক ‘অবশেষে জেনারেল’ পুরো বাংলাদেশ কাঁপিয়েছিল। মমতাজউদদীন আহমদ বলতেন, ‘আমাদের কালো ছেলেটা-ওসমান!’ মমতাজ স্যার ছিলেন সংস্কৃতির মহীরুহ। আমার স্বামী লতিফুল আলম চৌধুরী, দেবর সাইফুল আলম বাদল, ননদ আলো মোস্তফা তার হাত ধরেই নাটক তথা সংস্কৃতি জগতে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
চট্টগ্রাম কলেজে তখন ছাত্র সংসদ ছিল না, কোনো শহিদ মিনার ছিল না। উপর্যুক্ত ‘ছাত্র ঐক্য পরিষদ’এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম কলেজে কাঠ, চট দিয়ে শহিদ মিনার বানানো হতো। বাংলা ডিপার্টমেন্টের ফরিদা বেগম হাসির নেতৃত্বে সমস্ত নগর থেকে শিল্পীরা ধলপহরে জড়ো হতো। গরুর গাড়িসহ নগ্নপদে আমরা চট্টগ্রাম কলেজ থেকে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে যেতাম। ভাষা আন্দোলন, জাতীয়তাবাদ, স্বাধীনতার প্রতি আমাদের প্রজন্ম যে শ্রম, সম্মান ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তা বর্তমান প্রজন্মকে স্মরণ ও অনুসরণ করা বাঞ্ছনীয়।
অভীক ওসমান মেধাবী ছাত্র ছিলেন কিন্তু তিনি ডিপার্টমেন্টে তেমন আসতেন না। তিনি মিছিলে, তালেবের ক্যান্টিনে, স্টাডি সার্কেলে থাকতেন। কখনও-সখনও ডিপার্টমেন্টে আসলে তার সতীর্থ নওশীন-সেবা-পারভীন স্বগতোক্তি করতো ‘মেহমান এসেছেন’। অথচ তিনি অনার্সে মেধাতালিকায় স্থান নিয়ে পাস করেন। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা সংসদের এজিএস (জুলফিকার-সঞ্জীব) জিএস (সঞ্জীব-ওসমান), ভিপি (ওসমান-বোরহান) নির্বাচিত হন। তিন পদেই বাংলা সংসদে তিনি কৃতিত্বের পরিচয় দেন।
পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ফেরদৌসী মজুমদার, গোলাম মোস্তফার সেমিনার আয়োজন, মমতাজউদ্দীন আহমদ এর ‘হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার’ সিএন্ডবি হলে মঞ্চায়ন, আবুল ফজলের মৃত্যুর পর তার সংগ্রহ থেকে আবুল মোমেন প্রদত্ত বই দিয়ে গ্রন্থাগার সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি তখন মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথের উপর দুটো সমৃদ্ধ প্রবন্ধ রচনা করেন। শেখর দস্তিদার ও অভীক ওসমান রবীন্দ্রনাথের চাইতে সুধীন্দ্রনাথ দত্তকে বেশি পছন্দ করতেন। সুধীন দত্তের স্ত্রী পাঞ্জাবী মহিলা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী রাজেশ্বরী দত্তকে নিয়ে খুব আলাপ-আলোচনা করতেন। যেমন- ‘একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে/ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী’ অথবা ‘যে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে/আমি ভুলিব না, কভু ভুলিব না’ বাংলা বিভাগের করিডোরে হাঁটতে হাঁটতে ওসমান এগুলো আবৃত্তি করতেন। অথবা জীবনানন্দ দাশের ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’… । বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবে বোদলেয়ার, সুধীন দত্তের প্রভাবে হাইনরিখ হাইনে ওসমানের ওপর ভর করেছিল। ‘আজন্ম সলজ্জ স্বাধ আকাশে অনেক ফানুস উড়ায়’- অভীক ওসমান এ রকম স্বাপ্নিক ছিলেন। বিশ্বের ধ্রুপদী চলচ্চিত্রের ব্যাপারেও ওসমানের আগ্রহ ছিল। সোফিয়া লরেনের সানফ্লাওয়ার, টু ওমেন ইত্যাদি সে দেখত এবং আলোচনা করত। পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ে ছবি নির্মাণের স্বপ্ন ছিল, যা তার জীবনে হয়ে ওঠেনি। পলিটিক্স-কালচার-বাংলা সংসদ সব ক্ষেত্রে তার নেতৃত্ব ঃবংঃবফ ধহফ ঢ়ৎড়াবহ ছিল। অভীক ওসমানই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সংগঠন বাংলা সম্মিলনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট। এরপরে চট্টগ্রাম কলেজ কেন্দ্রিক ‘বাংলা উৎসব’ এর প্রাণপুরুষ।
তার সর্বশেষ ‘গুরুদক্ষিণা’ বইটির কারণে গদ্য-তথ্যে অমর হয়ে থাকবেন। ২০০০ সালে নজরুল জন্মবর্ষে আমাদের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘চির উন্নত শির’। বাংলা সংসদ থেকে একটা দেয়ালিকা প্রকাশিত হয় তাতে ‘চোখের অসুখ’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। এখানে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বিষাদের জার্নাল’ থেকে আরেকটি কবিতা উদ্ধৃত করছি।
ত্রয়ী

এক.
শরীর শাড়িতে ধরে রাখো সোনালী ফসলের ক্ষেত
কপালে উড়ছে শুধু সবুজ সবুজ শীষ।

তুমি কি দেখো না, দেখেও কি ভান কর?
দৃষ্টির পথে আলপথে ঘুরে ঘুরে আসে
এক শ্যামল কিশোর
কী আনন্দ উদোম ভিটের বুকে,
পাশের সুপারী বনে।

বলো দেবে বন্যাহীন এক বাসন্তী অঙ্গীকার
অঘ্রাণ এলেই কিষাণ পাবে তোমার শরীর শাড়ি সোনালী ফসলের একচ্ছত্র অধিকার।
দুই.
তুমি কি সোনালুর পাপড়ি অথবা ভ্রূণ বটফল ছুঁয়ে দিলে উড়ে যাবে অন্যের ছায়ায়
ভালোবাসার টিপ দিলে গলে যাবে নগ্ন ব্যর্থতায়
তুমি কি

তিন.
এত সহজে কথা বলো
চোখ মুখ চিবুক শরীর শাড়ি
গৈরিক নদীতে উজানী জলের মতো তুমি
এত সহজে কথা বলো

তুমি এত সহজে চোখে নদী আঁকো
এত সহজে কথা বলো
উজানী জলের মতো।
(১৯৭৬/ বিষাদের জার্নাল)

আমি শিক্ষকতার পথে চলে যাই। ওসমান শিক্ষকতার পথে গেলে নিঃসন্দেহে সে লিজেন্ডধারী শিক্ষক হতে পারতেন। সে পাণ্ডিত্য ও প্রজ্ঞা তার ছিল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের একজন ছাত্র হয়েও কর্পোরেট লাইফে ওসমানের সব সাফল্যের কথা আনিস স্যার, মনিরুজ্জামান স্যার জানতো এবং অকপটে স্বীকার করতো। আমাদের সমকালীন জীবনে শেখর দস্তিদার ও অভীক ওসমান ছিল উত্তম-সতীর্থ। সে আমার অনার্স-মাস্টার্স জীবনে একাডেমিক ফ্রেন্ড। এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ, আমার অভিসন্দর্ভ রচনায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আমরা যখন মাস্টার্স পড়ি তখন ড. মোস্তাইন বিল্লাহ’র একটা প্রবন্ধ ছাড়া সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কোনো রেফারেন্স ছিল না। ওসমান সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে খুব পছন্দ করতেন। ওয়ালিউল্লাহকে পড়তে গিয়ে সুরিয়ালিজম, দাদাইজম ওসমান খুব পড়ে নিয়েছিল। যার ফলে আমাদের মধ্যে ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে আগ্রহ গড়ে ওঠে। ওসমানের ‘গদ্যকথা’ (১৯৯৩) গ্রন্থে শওকত ওসমানের ‘জননী’, আবু ইসহাকের ‘জয়গুন’ একটা প্রবন্ধ ছিল। আমার অভিসন্দর্ভ নির্বাচনে তার ছায়াপাত রয়েছে।
তার সম্মাননা গ্রন্থ ‘প্রমা ও লাবণ্য’ অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম- ‘এক অনাথ যুবকের মেধার প্রতি আমাদের মায়া ছিল। আশির দশকে তিনি রোমান্টিক কবি হয়ে ওঠেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সতীর্থ থেকে একটা সামাজিক মানবিকতার আজীবন মিত্র হয়ে ওঠা বড় একটা ব্যাপার। ওসমান আমার বন্ধু, আমার মেয়ে ও নাতি-নাতনিদেরও বন্ধু হয়ে আছেন। আমার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা লতিফুল আলম চৌধুরীও তাকে খুব স্নেহ করতেন।’
আজকের সফল কর্পোরেট ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, কবি-নাট্যকার-গবেষক অভীক ওসমান প্রবীণ, ঋদ্ধ ও পরিচিত। অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও উন্নয়ন গবেষণায় চট্টগ্রামে খ্যাত। সাহিত্যের ছাত্র অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হয়ে ওঠা ব্যতিক্রম। গত ক’বছরে দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতিক সংস্কৃতি, আমাদের সুপ্রিমও শেখ হাসিনার টোটাল লিটারেচারের ওপর প্রথম তিনি আলোকপাত করেন।
শিক্ষামন্ত্রীর ডা. দীপু মনির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর এম.আব্দুল ওয়াদুদের বুক রিভিউ অত্যন্ত ইতিহাস-ঐতিহ্য সমৃদ্ধ হয়েছে। তাছাড়া অতীতে প্রকাশিত বৃহত্তর চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংক্রান্ত শেখ হাসিনার অবদান, ব্লু ইকনমি, নিউ নরমাল ইকোনমি এই প্রবন্ধগুলো সাহিত্যে ছাত্র ও শিক্ষকের অর্থনৈতিক বিশ্লেষক হয়ে ওঠার দক্ষ প্রমাণ। তার সুস্থ ও প্রজ্ঞাময় জীবন কামনা করছি। সেই সাথে তার কাছ থেকে জাতি আশা করছে আরও অনবদ্যসব সৃজনশীল সাহিত্য।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে সবাইকে সচেতন হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধজীবনযাপন