[ভূমিকা- ক্রাউন পাবলিশিং থেকে সমপ্রতি প্রকাশিত হয়েছে আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার লেখা স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থ ‘আ প্রমিজ্ড্ল্যান্ড’। এই গ্রন্থের প্রথম পর্বে তিনি লিখেছেন নিজের শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের কিছু স্মৃতিকথা। এখানে সেই পর্বটি অনুবাদ করেছেন ফারহানা আনন্দময়ী।]
নিজ পরিবারের বাইরেও অন্য একটা পরিচিত পৃথিবী ছিল আমার। কৈশোরের সহপাঠীরা আমাকে দেখতো অন্যভাবে। বড় হয়ে সামনের সারির উদীয়মান নেতাগোছের কেউ হবো, এমনটা ওদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। আমাকে ওরা বরং নিরুৎসাহী একজন ছাত্র হিসেবেই বেশি জানতো। সামান্য প্রতিভার একজন বাস্কেটবল খেলোয়াড় বা বন্ধুদের পার্টিতে গিয়ে অবিরাম হইহুল্লোর করা সাধারণ একটি ছেলে হয়েই মিশে থেকেছি। কোনো ঈগল স্কাউট বা আঞ্চলিক কংগ্রেসম্যান অফিসের ইন্টার্ণি হয়ে কাজ করতে যাইনি কখনো। এসবের চাইতে স্কুলে বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, গানবাজনা, খানাপিনা, মেয়েদের বিষয়ে গল্প-আড্ডা দিয়েই সময় কাটতো আমার।
এরপর যখন হাইস্কুলে পড়ি, তখন একটা সময়ে নিজের কাছেই নিজে কিছু প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। প্রশ্নগুলো ছিল অনেকটা এরকম, আমাদের সঙ্গে বাবা কেন থাকেন না, মায়ের সিদ্ধান্তগুলো এরকম হবার কারণ কী, কিংবা আমরা যেখানে বাস করছি সেখানে মাত্র অল্প কিছু মানুষ আমার মতো কৃষ্ণাঙ্গ কেন? আমার মাথার ভেতরের ভাবনাগুলো বর্ণকেন্দ্রিক হতে শুরু করলো। বাস্কেটবল দলে কৃষ্ণাঙ্গরা পেশাদার খেলোয়ার হিসেবে খেলছে, কিন্তু তারা কখনো কোচ হতে পারে না। কেন? স্কুলের সেই মেয়েটা কেন আমাকে জিজ্ঞেস করে, তোমাকে তো ঠিক অন্য কৃষ্ণাঙ্গদের মতো দেখতে লাগে না। মগজে আরো অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে, অ্যাকশন সিনেমাগুলোতে এই কালোদেরকেই কেন শুধু ভয়ঙ্কর আর অদ্ভুত চরিত্রে অভিনয় করতে দেখি? আর ভালোমানুষের চরিত্রে যদিও বা কখনো এদের দু-একজনকে দেখা যায়, তাও পার্শ্বচরিত্র আর শেষদৃশ্যে ওর মৃত্যু হয়! কেন?
প্রশ্নগুলো শুধু বর্ণকে কেন্দ্র করেই মাথায় আসছে, তা নয়; সমাজে শ্রেণিভেদ নিয়েও ভাবছি আমি তখন। ইন্দোনেশিয়ায় থাকার সময়ে এই শ্রেণিবৈষম্য আরো প্রকটরূপে দেখতে পেলাম; একশ্রেণি অবিশ্বাস্যরকম ধনী আর অপর এক শ্রেণি দরিদ্রতর জীবনযাপন করতো। আমার বাবার দেশেও এই শ্রেণিপার্থক্য খুব বেশি ছিল, সেটা অল্পবিস্তর জানা ছিল আমার। নানাবাড়ির যে পরিবেশ ছিল, সেটা আমাকে খুব বিষাদী করে তুলতো। তাদের মনজগতের হতাশাকে তারা পূরণ করার চেষ্টা করতো সারাদিন টিভি দেখে, মদ্যপান করে কিংবা ঘরের নতুন কোনো আসবাবপত্র কিনে। কী অদ্ভুত! তবে এসবের মধ্যেও মাকে দেখতাম একদম আলাদারকম। মা কষ্টার্জিত আয়গুলো তার বুদ্ধিবৃত্তিক উৎকর্ষতায় ব্যয় করতে অধিক আগ্রহী ছিলেন। আবার প্রিপারেটরি স্কুলে গিয়ে সেই শ্রেণিভেদ আবার সামনে চলে এলো। বেশিরভাগ শিশুরাই ধনী পরিবার থেকে এসেছিল এবং সেই ধাপে আমি নিজেকে মেশাতে পারতাম না। মা যদিও সবসময়ই বলতেন, এদের এইসব বড়লোকি হুমকি-ধমকি কিছুই জীবনে জায়গা পাবে না, কিন্তু বাস্তবের সাথে মায়ের এসব নীতিকথা কিছুই মিলতো না। বিনয়ী আর ভালো মানুষেরাই দেখতাম, সবখানে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তারাই।
বিপরীতমুখী এসব সমাজব্যবস্থা আমার ভাবনার গতিপথকে বদলে দিত বারবার। আমার বেড়ে-ওঠা, আমার বর্তমান জগত সবকিছুই খুবই জটিল আর ধোঁয়াশাপূর্ণ ছিল। আমার কেবলই মনে হতো, সবখানেই আমি আছি, আবার একইসঙ্গে কোথাও নেই আমি। প্ল্যাটিপাসের মতো মনে হতো নিজেকে কখনো। বিভিন্ন ধারা, বিভিন্ন ঐতিহ্য, বিভিন্ন সংস্কৃতির টুকরো টুকরো অংশ জোড়া লাগিয়ে যেন একটি পুরো আমি গড়ে উঠছি। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতির অবয়ব আমি ধারণ করতে পারছিলাম না। এটুকুই আমি, এটাই শুধু আমি… এমনটা ভাবতে চাইতাম, কিন্তু বাস্তবে সেরকমটা হতো না। আমি উপলব্ধি করতে পারছিলাম, একটি কোনো পূর্ণাঙ্গ সুনির্দিষ্ট ধারার মধ্যে নিজেকে বেঁধে ফেলাটা কোনোভাবেই হয়ে উঠছে না। আমি জানি না, কেন? আর এজন্যই আমাকে হয়তো একটা একাকী জীবন বেছে নিতে হবে।
আমার চিন্তাচেতনার জগতে এই যে দোলাচল চলছিল, এই বিষয়ে কারো সাথেই আলাপ করিনি আমি। পরিবারের কারো সাথে বা কোনো বন্ধুর সাথেও নয়। ওদের কারো অনুভূতিকে আমি আঘাত করতে চাইনি। অথচ ততদিনে ওদের ভাবনার জগত থেকে অনেকটাই দূরে সরে এসেছিলাম। ওদের মধ্যে থেকেও আমি যেন অন্য কোথাও বিচরণ করতাম, ভাবনার জগতটা ভিন্ন হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। তবে আমি আমার নিজেকে খুঁজে পেতাম বইয়ের জগতে। বই হয়ে উঠলো আমার পরম আশ্রয়ের জায়গা। এবং এই পাঠের নেশার বীজ আমার গভীরে বপন করে দিয়েছিলেন আমার মা। এক্কেবারে সেই ছোট্টবেলা থেকে শুরু করে শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে গিয়েও তিনি আমাকে এই বইয়ের দিকেই ঠেলে দিতেন। মা যখন কোনো কাজে বেরিয়ে যেতেন, আমি একা থাকার জন্য মাকে দোষ দিতাম, কিংবা আর্থিক টানাপোড়েনের জন্য ইন্দোনেশিয়ার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে যাওয়াটা অনিশ্চিত হলো, বা বেবিসিটার না থাকায় মায়ের সাথে আমি যখন ওঁর অফিসে গিয়ে বসে থাকতাম… প্রত্যেকটা সময়ই মা বই পড়ার জন্য তাগাদা দিতেন আমাকে। একটাই কথা ছিল মায়ের, “যাও, বই পড়ো গিয়ে। আর পড়া শেষ হলে আমাকে বলবে, কী তুমি জানলে বইটা পড়ে”।
আমার মা যখন কাজের সূত্রে ইন্দোনেশিয়ায় ছিলেন, আমার ছোট বোন মায়াকে নিয়ে, সেই সময়কালে কয়েক বছর হাওয়াইতে ছিলাম আমি; আমার নানা-নানীর সাথে। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, মা তখন আমাকে সারাক্ষণই ‘পড়ো, পড়ো’ বলার সুযোগ পেতেন না বলে, আমার শেখাটাও কেমন যেন গতি হারাল। তবে স্কুলে আমার একাডেমি গ্রেডগুলো ভালো হতো অবশ্য। সাহিত্যপাঠ আর স্কুলের বই পাঠ তো এক বিষয় নয়। এরপরে যখন আমি দশম শ্রেণিতে উঠলাম, পাঠ নিয়ে আমার অভ্যাস বদলে যেতে থাকলো। মায়ের সেই তাগাদা ছাড়াই বইয়ের জগতে বুঁদ হয়ে গেলাম। একবার সেন্ট্রাল ইউনিয়ন চার্চে একটা ছোট গারাজ-সেল চলছিল। নানা-নানির সাথে গিয়েছিলাম আমি সেখানে। বাসার অদূরেই ছিল সেই জায়গাটা। ওখানে পৌঁছে বড় একটা বাক্সভর্তি পুরনো বইয়ের সামনে গিয়ে আমি আটকে গেলাম। কত কত বই সেই বাক্সে! যে বইগুলোর শিরোনাম আমার চোখে বিশেষ মনে হচ্ছিল, বা যে নামগুলো বিখ্যাত বইয়ের নাম হিসেবে অল্পস্বল্প আগে শুনেছিলাম, সেই সমস্ত বই সব গুছিয়ে নিতে শুরু করলাম। রাল্ফ এলিসন, লংস্টন হিউজ, রবার্ট পেন ওয়ারেন, দস্তুয়ভস্কির বই নিলাম। আরো নিলাম ডি এইহ লরেন্স আর রাল্ফ ওয়াদো এমারসনের বই। এত এত বই একসাথে একইদিনে পেয়ে যাওয়ায় মনটা খুশিতে ভরে উঠলো আমার।
এদিকে নানা তার গল্ফ খেলার পুরনো সরঞ্জাম সব কিনে কাছে এসেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। এতগুলো বই সাথে নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি দেখে তিনি খুবই অবাক হলেন, একটু যেন বিরক্ত-ও।
“কোনো পাঠাগার খোলার পরিকল্পনা করছো নাকি তুমি?” জানতে চাইলেন তিনি।
আমার নানী তাকে থামিয়ে দিলেন একটা মৃদু ধমক দিয়ে। বইএর প্রতি আমার এই আগ্রহ বরং তাকে খুশি করলো, আমাকে সাধুবাদ জানালেন। তবে নানী এ-ও বললেন, স্কুলের অ্যাসাইনমেন্টের পড়ালেখা শেষ করবে আগে। তারপরে তুমি ডুব দিয়ো ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’-এ!”
এ সমস্ত বই আমি পড়ে শেষ করতাম বাস্কেটবল খেলার প্র্যাকটিস শেষ করে এসে, বন্ধুদের সাথে সিক্স-প্যাক অনুশীলনের পরে। কখনো শনিবারে সাঁতার কেটে ফিরে ভেজা গায়ে তোয়ালে পেচিয়ে নানার পুরনো ফোর্ড গাড়িটার ভেতরে বসে বসে বই পড়তাম। গাড়ির আসন যেন ভিজে না যায়, সেটাও খেয়ালে রাখতে হতো আমাকে। নেশা হয়ে উঠলো আমার বই পড়াটা। সেই সেল থেকে আনা বইগুলো পড়া শেষ হবার পরে আমি আবার আরেকটা গারাজ সেল খুঁজে সেখানে গেলাম। সব বই-ই যে খুব ভালো মতো বুঝে আমি পড়লাম, ওরকম নয়। অনেক শব্দের অর্থই বুঝতাম না। সেগুলো গোলদাগে দাগিয়ে রাখতাম। অভিধান দেখে পরে মিলিয়ে নিতাম। এমনও হতো কোনো কোনো শব্দ উচ্চারণই করতে পারতাম না আমি। তখন আমি বিশ ছুঁইনি। কিছুকিছু শব্দের অর্থ খুঁজে জেনে নিতাম, কিন্তু উচ্চারণ সম্পর্কে ধারণা ছিল না। ছন্দ বা পাঠের ধারা নিয়েও বেশি কিছু জানতাম না। পড়ার জন্যই পড়তাম। আমি হয়তো নানার গারাজের সেই ছোট্ট বালকটি ছিলাম, যে এখান সেখান থেকে পুরনো যন্ত্রপাতির টুকরো কুড়িয়ে এনে জোড়া লাগিয়ে নতুন আকারের একটা খেলনা বানানোর কাজে সময় কাটাতো। আর এই অভ্যাসটা আমার ভেতরে গেঁথেই গেল নিজের অজান্তে। এ ভাবনা, সে চিন্তা, ওই ধারণা… এসব সব মগজে জমা করে রাখতাম। কখনো কোনো একদিন এগুলোকেই কাজে লাগিয়ে দারুণ অর্থবহ কিছু একটা সৃষ্টি করতে পারবো, এমনটা ভাবতাম।
হাইস্কুলে থাকতে বইপড়ার এই নেশা আমাকে শুধু তখনই অন্যদের চেয়ে আলাদা করে তুলতো, তা নয়। এরপরে যখন আমি কলেজে ভর্তি হলাম, বইয়ের থেকে পাওয়া অল্পবিস্তর জ্ঞান, রাজনৈতিক ধারণা খুব সাহায্য করেছিল আমাকে।
ফারহানা আনন্দময়ী : কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক