আমার মা : কর্মকে যিনি ধর্ম মেনেছেন

শিউলী নাথ

| মঙ্গলবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

আমার মা। মায়া মজুমদার। যতদিন বেঁচেছিলেন শিক্ষকতা পেশাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। রায়পুর থানার সরকারি প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় যেন মায়ের আরেক আবাস। জীবনের ধ্যান, জ্ঞান সবই মায়ের ঐ স্কুল, সহকর্মী আর শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক। মাঝে মাঝে মনে হতো মা কাকে বেশি ভালোবাসেন? আমাদের নাকি তার কর্মস্থলকে? এ নিয়ে মায়ের সাথে কত মান- অভিমান চলতো। মা দুষ্টুমি করে বলতেন, ‘যদি শুক্রবারও স্কুল খোলা থাকতো’! আমরা অবাক হতাম! আমার যতদূর মনে পড়ে – শারীরিক অসুস্থতার জন্য মা স্কুলে যেতে পারেননি, এমনদিন কখনো আসেনি। মাকে কিছুক্ষণের জন্য না দেখলে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়তো। কী এমন সম্মোহনী শক্তি কিংবা ভালোবাসা ছিল যে সবাইকে স্নেহ মায়া- মমতায় জড়িয়ে রাখতেন। একই স্কুলে পড়তে গিয়ে বুঝলাম, মা শুধু একা আমার নয়, সহপাঠীদেরও মা। অভিভাবকেরা এসে মাকে খুঁজতেন। আমি যখন স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে গেলাম, তখনই আবিষ্কার করলাম একজন আদর্শ শিক্ষিকা মায়া মজুমদারকে। প্রাইমারি ও হাই স্কুলের মাঠ জুড়ে মায়ের যে হাসিমাখা মুখ দেখতে পেতাম, কলেজ মাঠে তাঁকে আর পাইনি। বাসায় ফিরে অপেক্ষা করতাম- মা কখন আসবে? গৃহকর্ম, নিত্য পূজা অর্চনা শেষে ৯টার মধ্যেই মা স্কুলে পৌঁছে যেত এবং ফিরতো ৪টার পরে। ততদিনে বুঝে গেছি মাকে সবাই কেন ভালোবাসে? তাই আগের মান- অভিমান ছেড়ে দিয়ে অভিযোগ করতাম। এত দেরি হলো কেন? জবাবে মিষ্টি হেসে বলতো, ‘যতই পূজা অর্চনা করি সব নিজেরও পরিবারের শান্তির জন্য কিন্তু যে কাজের দায়িত্ব আমি নিয়েছি তখন ওটাকেই আমি ধর্ম মনে করি। কর্ম জীবনে যে দায়িত্বই দেয়া হোক না কেন, মনে রাখবে তোমার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওটাকে তুমি তোমার আসল ধর্ম মনে করে সম্পন্ন করবে’। মাঝের দিন গুলোতে অনেক দূরে ছিলাম বলেই মায়ের স্কুলপ্রীতি দেখতে পাইনি।
মায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষার্থী ও সহকর্মীদের অগাধ ভালোবাসার প্রমাণ পেলাম মায়ের শেষ যাত্রার দিনে, ৬ সেপ্টেম্বর! যখন আমি পৌঁছলাম মা তখন প্রিয় ফুল গাছের তলায় শুয়ে। দলবদ্ধভাবে রাস্তায় শিক্ষার্থীদের ভিড়। সবার হাতে আগের দিন স্কুলে মায়ের সাইন করা শেষ কপিটার ছেঁড়া অংশ। সহকর্মীদের চোখের জল, আত্মীয় স্বজনদের বুক ভাঙা আর্তনাদে আমার শ্রেষ্ঠ শিক্ষিকা, যিনি কর্মকেই ধর্ম মেনেছেন, তিনি চির নিদ্রায় শায়িত হলেন। মায়ের এই ধ্যান, জ্ঞানকে আমরাও যেন চলমান জীবনের শক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিজের হৃদয়কে মানবিকতায় আবদ্ধ করুন
পরবর্তী নিবন্ধদাঁত নিয়ে কষ্ট, বলেছি স্পষ্ট