দাঁত নিয়ে কষ্ট, বলেছি স্পষ্ট

এমিলি মজুমদার

| মঙ্গলবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:৫৫ পূর্বাহ্ণ

বুট, বাদাম, চানাচুর, নারকেল, মাংসের নরম হাড়, মাছের মাথা, ডাসা পেয়ারা, পাকা পেয়ারা, আঁখ সব সব সবই খাওয়া মানা। চুইগামও চিবুই না যদি ক্যাপ চুইংগামে আটকে খুলে আসে! লজেন্সও মুখে নেই না ভুলে যদি কামড় পরে যায়! এরপরও ডেন্টিস্টের কাছে গেলেই বলবেন, ‘নিশ্চয়ই শক্ত কিছু খেয়েছেন, নাহলে ক্যাপ খুলল /ভাঙলো কিভাবে? হায় হায়, এবার তো দেখছি ক্যাপ ঠিক আছে, ভেতরের দাঁতটাই ভেঙে গেছে! কেমন করে হলো’? ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রশ্ন শুনলে মনে হয় আমি বোধহয় ইচ্ছে করে পাথর দিয়ে গুঁতো মেরে দাঁত ভেঙে ডাক্তারের কাছে পুরস্কৃত হতে এসেছি! কারি কারি টাকা যাচ্ছে আমার, হা-আ-আ’ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে ডাক্তারের ছুড়ি, কাঁচি, শাবল, খন্তা, সাঁড়াশি, হাতুড়ি, বাটাল, ফাইল, ড্রিল, ওয়েল্ডিং ইত্যাদি ভয়ঙ্কর যন্ত্র দিয়ে মুখগহ্বরে খোঁড়াখুঁড়ির যন্ত্রণাও সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে, আর কিছু হলে দোষটাও দেয়া হচ্ছে আমাকেই! বিয়ের পর স্ত্রী’কে যেমন স্বামী-শ্বশুর বাড়ির লোকজনের সাথে এ্যাডজাস্ট করতে হয়, দাঁতের কাজ করাবার পরও ওপরের পাটি দাঁতের সাথে নীচের পাটির দাঁত তেমনি এ্যাডজাস্ট করতে হয়। ঠিকভাবে না হলে ঠোকাঠুকি লেগে দাঁতের অবস্থা আরো শোচনীয় হতে পারে। দুঃখের কথা হচ্ছে দাঁতের কাজ করাতে গিয়ে ঘষাঘষি করে কখনো পুরানোর সাথে নতুনকে বা নতুনকে পুরানোর সাথে এ্যাডজাস্ট করতে করাতে আমার ঠোঁট-দাঁত-মুখের আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে এক অবস্থা। কোনোদিক চেপে বসেছে, কোনোদিক আবার ফুলে উঠেছে। হাসলে মনে হয় বক্র হাসি। সত্যি বলতে কী, দোষ অবশ্য আমারই, কারণ দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা আমি বুঝি নি। তাই সবার উদ্দেশ্যে আমার নিবেদন, ‘প্লিজ দাঁত থাকতে দাঁতের যত্ন নিন’, নইলে আমার মত, নতুবা আমার চাইতেও শোচনীয় অবস্থা হবে একদিন।
শুরুটা ছিল এইরকম – একটা দাঁত খারাপ হয়ে গিয়েছিল, তাই ডাক্তারের পরামর্শে দাঁতটা তুলে একটা ফল্‌স দাঁত লাগানো হলো। বেশ ক’বছর যাবার পর, একসময় ডাক্তার বললেন, এখন কেউ আর ফল্‌স দাঁত ব্যবহার করে না। খোলা মেলা, ঢিলা হয়ে যাওয়া, পেটে চলে যাওয়া অনেক অঘটন ঘটে থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। পারমানেন্ট সলিউশন ব্রিজ করা। এর জন্য দু’পাশের দুটো দাঁত রুটক্যানেল করাতে হবে, তিনটে দাঁত মিলে একটা ব্রিজ। একেবারে ঝামেলা শেষ। আমি পুরো কনভিন্সড। ডাক্তারের পরামর্শকে শিরোধার্য করে এগিয়ে যাই। সব হারিয়ে অনেক দেরিতে বুঝেছি, তিনটে দাঁতই শেষ! রুট ক্যানেল করা দাঁত ভেঙে যাওয়ার পর যে ব্যাখা পেয়েছি, তা তুলে দিলাম – ‘রুট ক্যানেল করা মানে দাঁতটাকে মেরে ফেলা, আর মরা দাঁত হচ্ছে মরা গাছের মত। মরা গাছ অনেকদিন হলে যেমন ভঙ্গুর হয়ে ভেঙে পড়ে, দাঁতের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই, এটা তো মরা দাঁত, যত দিন যাবে টেম্পার কমতে কমতে একসময় তো ভাঙবেই;। এ এক্সপ্ল্যানেশন পেয়েছি দাঁত ভাঙার পর –
কাজ করাবার আগে কিন্তু একটাবারের জন্যও ডাক্তার কিংবা টেকনিশিয়ান কেউ বলেননি, ‘এই দাঁত নরমাল দাঁতের মত ব্যবহার করা যাবে না, শক্ত কিছু তো কোনোভাবেই দাঁতে কাটা যাবে না ইত্যাদি’ সব বিধিনিষেধ জানতে পারবেন অঘটন ঘটে যাবার পর। তখন ডাক্তার বলবেন, এটা করেননি কেনো? ওটা করেছেন কেনো? ইত্যাদি ইত্যাদি। যত দিন যাচ্ছে, তত নিত্যনতূন চিকিৎসা আসছে, চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলোতে আমাদের দেশের যারা বসবাস করেন, অনেকে দেশে আসলে দাঁতের কাজ প্ল্যান করে আসেন ওই দেশগুলোতে দাঁতের চিকিৎসা আরও বেশী ব্যয়বহুল বলে।
দন্ত চিকিৎসায় নতুন সংযোজন ‘ইমপ্ল্যান্ট’ (আমাদের দেশে)। শব্দটা তেমন কঠিন না হলেও কর্মপদ্ধতি ভয়ঙ্কর। ডাক্তার সাবলিল ভাবেই বলে গিয়েছেন, তবে শোনার পর আমার দাঁতকপাটি লাগার জো! ডাক্তারের বর্ণনায় আমার চোখে ভাসছিল আমার ফ্ল্যাটের পাশের বহুতল ভবনের কাজ শুরুর আগের খোড়াখুড়ি পাইলিং।
মাড়ি কেটে মাঝে ফাঁক করে, চোয়ালের হাড় ড্রিল করে তাতে পাইলিং করা হবে। হাড় যদি কমজুরি হয় তাতেও সমস্যা নেই, ড্রাফটিং পাউডার ব্যবহার করে হাড়ের পুরুত্ব বাড়ানো হবে, কিছুদিন পর তাতে ড্রিল করে পাইলিং করা হবে। এরপর কমপক্ষে দু’মাস মুখে স্ক্রু’ লাগিয়ে বসে থাকতে হবে পাইলিং হাড়ে পাকাপাকিভাবে গেড়ে বসার জন্য। এরপর নাট বল্টু দিয়ে বসানো হবে দন্ত। খরচের কথা শোনার পর মনে হয়েছে ছেলেমেয়ে জন্মাবার সাথে সাথে দন্ত চিকিৎসা বাবত সবার একটা ডি.পি.এস করে রাখা দরকার। মা-বাবা বাচ্চার উচ্চ শিক্ষার জন্য, মেয়ে বিয়ের জন্য অর্থ সঞ্চয় প্ল্যান করে থাকে, তার সাথে দাঁতের চিকিৎসা ব্যয় বাবদও কিছু সঞ্চয় প্ল্যান প্রয়োজন!
ছোটবেলা থেকে ডেন্টিস্টের যন্ত্রপাতি যমের মত ভয় করি। এখনো যতক্ষণ চেয়ারে হা করে শোয়া থাকি, চোখ খুলি না। তারপরও টুং টাং, খচ্‌ খচ্‌, ঘষাঘষ্‌, ঝিস্‌ স্‌ স্‌, খেরর, ঠাং ঠাং হরেক রকম আওয়াজ কানে সেধিয়ে ভয়ে আতংকে আমার হাত পা বরফের মত ঠাণ্ডা করে দেয়।
ক’দিন আগে দেখা গেল ক্যাপ খুলে এসেছে, ডাক্তার দেখে বললেন, ‘সর্বনাশ, ক্যাপের ভেতরের দাঁত ভেঙে গিয়েছে এবার’। শোনার পর আমার অবস্থা আশা করি আপনাদের সবার অনুমেয়! যাই হোক নতুন ক্যাপের টাকা দিয়ে আবার ক্যাপ লাগিয়ে এসেছি। লাগানোর সময় ডাক্তার বলে দিয়েছে, ভাঙা খুঁটিতে কোনোভাবে বসিয়ে দেয়া হয়েছে, যে কোনো সময় খুলে কিংবা ভেঙে আসতে পারে। উপায় জিজ্ঞেস করলে ডাক্তারের জবাব, ‘আপনি নিজেই জানেন কী করতে হবে’। এর মানে হচ্ছে ‘ইমপ্লান্ট’ ছাড়া আর কোনো গতি নেই। নামটা মনে আসতেই আমার হার্টবিট কাজ করা বন্ধ করে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ে। কোনো শক্ত খাবার তো দূরের কথা মুড়ি মুখে নিয়ে সাথে সাথে চা মুখে নিয়ে মুড়ি নরম করে খাচ্ছি, হঠাৎ মুড়ির ভেতরকার একটা শক্ত চাল দাঁতের নীচে কটাস্‌ করে পড়লেই চমকে উঠি, সাথে সাথে কানে বাজে ‘ইমপ্লান্ট’।
যখন দাঁত ছিল, কম অত্যাচার চালাইনি ওগুলোর উপরে। বড়ই খেয়ে বিচি দাঁতে ভেঙে ভেতরের শাঁস খেয়ে তবে শান্তি। আলুবোখরাও তাই, বিচি কটাস্‌ করে দাঁতের নীচে ফেলে তবেই না ভেতরের বাদাম খেয়ছি। মাংসের শক্ত শক্ত হাড় ছাতু না করলে যেন মজাই পাওয়া যেতো না। এছাড়াও কোকের বোতলের ক্যাপ খোলা, ইলেকট্রিকের তার কাটা, দড়ি কাটা, কাপড় ছেঁড়া ইত্যাদি ইত্যাদি কত কাজেই না ব্যবহৃত হয়েছে আমার এই দাঁত!
ছুড়ি, কাঁচি, প্লায়ার, হামানদিস্তা সবকিছুর পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে দন্ত মহাশয়। এখন ভাবি আরেকটু যত্ন করলেই পারতাম। কষ্টের কষ্ট, সাথে অর্থনাশ সময় হারিয়ে দুটোই মেনে নেয়া সত্যিই খুব কষ্টের।
লেখক : প্রাবন্ধিক, ছড়াকার, গল্পকার

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার মা : কর্মকে যিনি ধর্ম মেনেছেন
পরবর্তী নিবন্ধওষুধের অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি রোধে করণীয় প্রসঙ্গে