আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সুন্দর সৃজনশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ

রিজোয়ান মাহমুদ | বৃহস্পতিবার , ৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

অনুন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের ধারণা আমেরিকা যেতেই হবে। ব্যাপারটা এরকম আমেরিকায় না গেলে যেন অভিজাত নাগরিক হওয়া যাবে না। কেউ স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে যাওয়ার ধান্দায় ব্যতিব্যস্ত থাকে। কেউ বা জমিজমা বিক্রি করে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে চলছে অনবরত। সবচেয়ে হাস্যকর, সমাজের দুইতৃতীয়াংশ সচেতন জনগোষ্ঠীর অকাট্য যুক্তি উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার জায়গা আমেরিকা। আমেরিকা একটা স্বপ্নের দেশ। কারো কারো কাছে স্বর্গের দেশ। মুক্ত বুদ্ধি চর্চা ও গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা। এ সিদ্ধান্ত আজ নানা প্রতিকূল প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। প্রতিদিন আমেরিকার যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর তরুণরা নিজের দেশ সংস্কৃতি ঐতিহ্য ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের স্বপ্ন দেখে। বাংলাদেশের মুক্তবুদ্ধি চর্চায় অগ্রসর অর্থাৎ কট্টর বামপন্থা রাজনীতির মান্যবর রাজনীতিবিদের অনেকেই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী খিস্তিখেউড় করে প্রায়শই মাঠ গরম করে রাখেন। যদি তা না করতে পারেন তাহলে বামপন্থী নেতার জৌলুস খুব একটা থাকে না, তাদের ধারণা। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের সমালোচনা না করলে বামপন্থী বিপ্লবীও হওয়া যাবে না। অথচ তলে তলে এসব স্বাপ্নিক বামপন্থী নেতারা প্রথমেই যেতে ইচ্ছে প্রকাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কেউ কেউ অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল তরঙ্গের মরণচিৎকার উপেক্ষা করে ইউরোপ আমেরিকা পাড়ি জমাতে চায়। এ অবৈধ অদূরদর্শী ভয়ংকর যাত্রায় কারো কারো সলিলসমাধি ঘটছে প্রতিবছর। কেউ লাশ হয়ে সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে। কেউ কেউ সমুদ্র তীরবর্তী সীমানায় একটুকরো মাটি ও পাথরে ঠাঁই পাচ্ছে। খুব কম সংখ্যক মানুষের ডেডবডি দেশে আসতে পেরেছে। অবৈধভাবে যাওয়া মানুষদের দেশে ফেরত পাঠানোর গরজ কারো নেই বলতে গেলে। এসব দেখা ও জানাশোনা সত্ত্বেও প্রতিবছর দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দালালদের খপ্পরে পড়ে অনেক তরুণ অকালে মৃত্যুবরণ করছে। তবু উদ্ভ্রান্ত তরুণরা আমেরিকা ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হতে থাকে। শত ঝুঁকি বাধা প্রতিকূল মুহূর্ত থাকা সত্ত্বেও যেতে হবে মার্কিন মুল্লুকে, এটি জাতির জন্য ভীষণ দুর্ভাগ্যজনক।

এটি শুধু আমাদের দেশের সমস্যা নয়, বলা যায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার জনগোষ্ঠীর সমস্যা। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার এগারো দেশের মধ্যে যে সমস্ত দেশ অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ যেমন মালেয়েশিয়া সিঙ্গাপুর থাইল্যান্ড এর জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন, তবে সংখ্যায় নগণ্য। কারণ উল্লিখিত দেশসমূহ শিক্ষা সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিকভাবে সবল ও টেকসই। দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ এসব দেশের জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী বসবাসের আগ্রহ প্রকাশ করেন। উল্লিখিত এই দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটা অংশ শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত তার দেশীয় শ্রেণি অবস্থানের বিপরীতে নিম্নতম অবস্থান মেনেও চলে যেতে চায়। একেতো এই দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ নয়, ভারত ছাড়া। ভূরাজনৈতিক অবস্থাও টালমাটাল। অগণতান্ত্রিক সংস্কৃতি দুর্নীতিতে আকণ্ঠমগ্ন। দেশের জনগোষ্ঠী বেকারত্বের অভিশাপ অস্থির দোদুল্যমান। সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপণা থেকে মুক্ত হওয়ার মানসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া স্বপ্ন থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারে না জনগোষ্ঠীর একাংশ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে অভিবাসন রীতিনীতিতে বেশ নমনীয় ছিল। ইদানীং কঠিন করে ফেলেছে। হঠাৎ অনেকটা ঔপনিবেশিক ও আধিপত্যবাদী খবরদারি সুলভ আচরণ করা শুরু করেছে, যা কিনা খুবই হাস্যকর। এমনিতেই দক্ষিণ এশিয়ার কিছু দেশের ওপর তীক্ষ্ণ নজরদারি মার্কিনীদের সবসময় ছিল। গত দশক থেকে ভিন্ন নজরদারিতে দেখা শুরু করেছে। তারই ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন মার্কিন ভিসা নীতি ঘোষিত হয়েছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইন্সিটিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বিবিসি কে বলেন, ‘এটা বেশ কঠোর একটা সিদ্ধান্ত এবং এখানে একটা স্পষ্ট বার্তা দেয়া হয়েছে। মার্কিন প্রশাসন দেখতে চায় নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হতে পারে। এবং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থেকে গণতান্ত্রিক আচরণে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ ও ফলপ্রসু করতে পারে। মাইক্যাল কুগেলম্যানের ধারণা; বাইডেন প্রশাসন একটা মূল্যবোধভিত্তিক পররাষ্ট্রনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশ একটা দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়ার ভেতরে পরবর্তী ক্ষমতা হস্তান্তর হোক, বাংলাদেশের আপামর জনগণ তা দেখতে চায়। তবে সাতজন র‌্যাব কর্মকর্তার ওপর স্যাংশন দেয়া এবং বিশেষ নতুন ভিসা নীতি প্রয়োগ অন্য কোনো কৌশল কিনা ভেবে দেখার দরকার আছে। এরইমধ্যে বাংলাদেশের সাথে জাপান ও চীন নতুন বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। অবশ্য এসব দেশের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক পুরনো। এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের সফরের আগে ইন্দোপ্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য রূপরেখা ঘোষণা করে ঢাকা। বাংলাদেশ যেহেতু দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সক্রিয় গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র সেহেতু একটা গুরুত্বপূর্ণ সুন্দর সম্পর্ক এই অঞ্চলে অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। চীনের সাথে বিবিধ বিষয় নিয়ে সম্পর্ক জোরদার করতে হবে। যদি চীন ও রাশিয়া এই দুই শক্তি আমাদের সাথে না থাকে তাহলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সফল ফেরত পাঠানোতে বাধা সৃষ্টি হতে পারে। এই অঞ্চলের শান্তি সমৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নশীলতার জন্য দরকার দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার একটা শক্ত বন্ধন। একটা নির্ভরশীল আর্থিক প্রতিষ্ঠান। যাতে এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে কাজে লাগে। যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা বাংলাদেশকে চীনের প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখতে চায়। কারণ চীন এশিয়ার বড়ো একটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তি। এখন বিশ্বের দুইতৃতীয়াংশ ব্যবসা বাণিজ্য চীনের সাথে অপরাপর বন্ধু রাষ্ট্রের সফলভাবে হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, ‘কে আমাদের ভিসা দেবে না, কে আমাদের নিষেধাজ্ঞা দেবে, তা নিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ নেই। ২০ ঘণ্টা জার্নি করে আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকা না গেলে কিচ্ছু যায় আসে না। পৃথিবীতে আরও অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে। সেই মহাদেশের সঙ্গে আমরা যাতায়াত করব, বন্ধুত্ব করব; আমাদের অর্থনীতি আরও মজবুত হবে, উন্নত হবে, আরও চাঙ্গা হবে’। প্রধানমন্ত্রীর এই দৃঢ়তা এবং অকুতোভয় উচ্চারণকে একজন লেখক কবি ও সচেতন নাগরিক হিসেবে সম্মান জানাই। বাংলাদেশ পৃথিবীর উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি। দৃশ্যমান অনেক উন্নয়নের সাক্ষী আমাদের দেশ সমাজ সংস্কৃতি দর্শন। বিশ্বব্যাংকের সাথে চ্যালেঞ্জ করে নিজস্ব অর্থায়নে খরস্রোতা পদ্মানদীতে সেতু করে দেখার দেশ বাংলাদেশ। সফল কোভিড ১৯, মোকাবিলা করার দেশ বাংলাদেশ। এতো উন্নয়ন ম্লান ও নিস্প্রভ হয়ে যেতে পারে না। আমাদের পর্যাপ্ত অর্থ না থাকতে পারে কিন্তু দৃঢ় মনোবল ও সাহস আছে। এ জাতি যেকোনো মূল্যে সংকট মোকাবিলা করে পরিস্থিতি উত্তরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

অতএব স্যাংশন ও ভিসা পদ্ধতি পরিবর্তনে জুজুর ভয় দেখিয়ে লাভ হবে না। বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংকট সমাধানে যৌক্তিক পরামর্শ প্রদানে এগিয়ে এলে দুই দেশের গত পঞ্চাশ বছরের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সুন্দর সৃজনশীল বন্ধুত্বপূর্ণ।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅদম্য ইচ্ছাশক্তি
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম