অদম্য ইচ্ছাশক্তি

ঝর্না বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

ইচ্ছাশক্তি হচ্ছেআত্মমনোবলে উজ্জীবিত হওয়া, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘বি পজেটিভ’। সত্যলক্ষ্যে মনের মধ্যে বিরাট দ্বিধাদ্বন্দ্ব উপেক্ষা করে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা ‘আমার দ্বারাই সম্ভব, আমাকেই করতে হবে’এই আত্মমনোবল হলো ইচ্ছাশক্তি। কোনো কিছু আমাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না, অদম্য শক্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাই কালীপ্রসন্ন ঘোষ এর অনুপ্রেরণামূলক কবিতায় অদম্য ইচ্ছাশক্তি, জীবনীশক্তির উন্মেষ ঘটার জন্য বলেছেন: ‘পারিব না একথাটি বলিও না আর/ কেন পারিব না তাহা ভাব একবার/ পাঁচজনে পারে যাহা, তুমিও পারিবে তাহা, পার কি না পার কর যতন আবার, একবার না পারিলে দেখ শতবার।’

জীবনের জয়ের লক্ষ্য পৌঁছার জন্য মানুষ বড় বড় স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে চলে। মানবের যাপিত জীবন শতভাগ মসৃণ কখনো হয় না, কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথে অজস্র বাধা ডিঙিয়ে সাফল্যের যাদুর ছোঁয়া হাতের মুটোতে ধরা দেয়। মেনে নিতে হয়, জীবন সর্বদা পরিবর্তনশীল আবার নশ্বরও বটে। তারপরও দুঃখকষ্ট, পরাজয়ব্যর্থতা জীবনেরই অংশ, তাকে একমাত্র নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে সম্যকপথে নিজেকে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাই হলো ইচ্ছাশক্তি বা প্রাণশক্তির সফলতা।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে দুইটি পদার্থের ঘর্ষণে ঘর্ষণে আগুন আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানবের আত্মোন্নয়নের জয়যাত্রা শুরু হয়। তারপর কৃষি ও চাষাবাদের মধ্য দিয়ে খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়। ধীরে ধীরে মানব জাতির ঐক্যতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে বাস করার অভ্যাস গড়ে উঠলে হিংস্র জীবজন্তুর হাত থেকে আত্মরক্ষা করে নিজেদের জীবন নিরাপদ করে তুলেছেন। পৃথিবীর সকল জীবের চেয়ে মানুষ তার বুদ্ধিদীপ্ত জ্ঞানের বিকাশ সাধন করে, চিন্তাশীল, উন্নত ও সমৃদ্ধ বিশ্ব তৈরী করেছেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে আজ শুধু পৃথিবী নয়, মহাশূন্যে পাড়ি দিয়েছেন, মহাসাগরের তলদেশ জয় করেছেন। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় মানুষের মননশীল চিন্তাশক্তি, আত্মমনোবল আর মানুষের বিশ্বাস ‘আমি পারবো’ এমন একাগ্রচিত্তে গবেষণা একবিংশ শতাব্দীর এক নতুন বিস্ময়কর বিশ্বায়ন।

শতশত প্রতিকূলতা আর নানাবাধা ডিঙিয়ে স্বপ্নের চেয়ে বড় হয়েছেন বহু বিখ্যাত ব্যক্তি। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট জেমস আল কার্টার জুনিয়র যিনি জিমি কার্টার নামে সর্বাধিক সুপরিচিত, তিনি নিজ জমিতে চীনাবাদামের চাষ করে তা পাইকারী বিক্রি করতেন। নিজের অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে বাদাম ব্যবসায়ী থেকে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়ক হয়ে ইতিহাস রচনা করেছেন। আমাদের দেশে প্রখ্যাত দার্শনিক ও পণ্ডিত বিদ্বান ব্যক্তি আরজ আলী মাতুব্বর একজন কৃষক থেকে সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন দেশবরেণ্য দার্শনিক হিসাবে, কথিত আছে, যিনি জীবনের ৮৬ বছরে মধ্যে ৭০ বছর লাইব্রেরিতে বই পড়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান একজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদ হয়ে বাংলাদেশকে সম্মানিত করেছেন, যিনি অতি সাধারণ কৃষক পরিবারে রাখাল বালকের দায়িত্ব পালন করে পড়ালেখার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে গামছা বিছিয়ে বাজার থেকে দান সংগ্রহ করে ক্যাডেট কলেজে পড়ে নিজেকে সফল মানুষে পরিণত করেছেন। আমি শ্রদ্ধাবনত হই বারংবার যিনি এতো সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েও তিনি জীবনের প্রতিটি ঘাতপ্রতিঘাত, দুঃখকষ্ট, পাওয়া না পাওয়ার স্মৃতিকথা সবসময় অকপটে জনসম্মুখে ব্যক্ত করেন। সাধারণত দেখা যায়, মানুষ আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে অতীত ভুলে যায়। যাঁরা সত্যানুরাগী, নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে নিজেদের স্বপ্নের চেয়ে অধিকতর বিশাল বা পরম লক্ষ্যে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁরা অতীতের অবস্থাকে জীবন সংগ্রামের অংশ মনে করেন তা প্রজন্মের কাছে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসাবে প্রাণশক্তি রূপে অনুপ্রেরণা বা উৎসাহ দান করে। একজন নৌকা মাঝির দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়ে দুর্দান্ত মেধা, মনোবল ও পরিশ্রমে একজন পরমাণু বিজ্ঞানী হয়ে ২০০২ সালে মহাভারতের একাদশ রাষ্টপতি এ পি জে আবদুল কালাম ইতিহাস রচনা করেছেন। দারিদ্রতা ও জাতিগত বৈষম্যনীতি নিজের স্বকীয় বৈশিষ্ট্য দিয়ে আত্মজয় করেছেন। বিশ্ববিখ্যাত মনীষী স্টিভ জবস, চার্লি চ্যাপলিন এর মতো মনীষীদের জীবনও অদম্য ইচ্ছাশক্তি দিয়ে জীবনকে সার্থকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এমন বহু জীবন্ত উদাহরণ থাকলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে নারী জীবনের দুঃখকষ্ট, অপূর্ণতা ও সংগ্রাম ভাবতে গিয়ে মনের কোণে ভীড় করে একজন প্রতিবন্ধীর নারীর মাউন্ট এভারেস্ট জয় করার অদম্য সাহস, মনোবল ও ইচ্ছাশক্তি। একজন ইন্ডিয়ান আর্মির সন্তান হয়েও একজন জাতীয় পর্যায়ের এথেলেটিক ভলিবল, সাইক্লিং ও ফুটবল অনুরাগী ক্রীড়াবিদ অরুনিমা সিনহা ২০শে জুলাই ১৯৮৮ সালে ভারতের লক্ষ্মৌতে জন্মগ্রহণ করেন, মাতাও হেলথ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করতেন। ২০১১ সালে লক্ষ্মৌর ট্রেনে একদল ডাকাত তার জিনিসপত্র ছিনতাই করার সময় বাধা দিলে, একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে ট্রেন থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় অন্য ট্রেন চলার পথে। হসপিটালের বেডে নিজেকে আবিষ্কার করার সময় বুঝতে পারেন একটা পা হারিয়েছেন। নিজের সমস্ত ক্যারিয়ার অসময়ে কবরবন্দী হয়ে গেলো তা ভাবতেই মন প্রচণ্ড হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়লো। তখনই ভারতের বিখ্যাত ক্রিকেটার যুবরাজ সিং ক্যান্সারকে জয় করে ভারতকে দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন করতে বিশেষ ভূমিকা প্রতিপালন করেছেন। তাঁর জীবনদর্শন থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে হাসপাতালের বেডে বসেই নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন, কৃত্রিম পা দিয়ে হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ আরোহন করবেন। সেই থেকে অদম্য ইচ্ছাশক্তি একাগ্রচিত্তে সাধনা করে পা হারানোর দুই বছরের মাথায় মাত্র ৫২ দিনের কঠোর পরিশ্রমের ফলে তিনি সর্বপ্রথম প্রতিবন্ধী নারী হিসাবে ২১শে মে ২০১৩ সালে সকাল ১০.৫৫ মিনিটে এভারেস্ট জয় করে বিশ্বরেকর্ড করেন। এই অনন্য অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য অরুনিমা সিনহা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন। আমরা যারা সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ আজও আধুনিক বিজ্ঞান মনস্ক উন্নত বিশ্বায়নের যুগে এভারেস্ট জয়ের ভাবনা কল্পনাতেও ভাবতে পারি না, তা অরুনিমা সিনহা শারীরিক সমস্যাকে শক্তি ও সাহসের প্রতীক ভেবে প্রতিবন্ধী হিসাবে সর্বপ্রথম একমাত্র মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন অদম্য সাহসিকতা ও প্রবল আত্মমনোবল বা ইচ্ছাশক্তির বদৌলতে। এ প্রসঙ্গে মহাত্মা গান্ধীর উক্তিটি মনে পড়ছে, ‘শক্তি কখনো শারীরিক গঠন থেকে আসে না, শক্তি আসে ইচ্ছাশক্তি থেকে’।

প্রকৃতি আমাদের আদি ও প্রধান শিক্ষক। প্রকৃতির নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ পাহাড়, নদী, সাগর, বালুকা বীচ, সবুজ বাহারি গাছপালা আর পাহাড়ের গাঁ বেয়ে নেমে আসা সুশীতল পানির ছন্দময় পথচলার প্রাকৃতিক ঝর্নার জলধারার অবলোকন করলে নয়ন সুখ, দেহমনের প্রশান্তি ও শরীরের ক্লান্তি দূর করে মনকে শুদ্ধ, পবিত্র ও উদার করে তোলে। এভাবে প্রতিটি মানুষের আইকন বা অনুপ্রেরণাকারী ব্যক্তিত্ব নির্দিষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়, এমন ব্যক্তিদের জীবনদর্শন, জীবনবোধ, নীতিআদর্শ ও উপদেশ মনোযোগ দিয়ে শোনা, ধারণ করা ও আচরণে অভ্যস্ত হওয়া। সর্বোপরি জীবনের চরম লক্ষ্যে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বশর্তগুলো অনুশীলনে নিজেকে কষ্টিপাথর রূপে সততা, বিনয়ী, নিষ্ঠাবান, শিষ্ঠাচারী, পরিশ্রমী ও নির্মোহ চরিত্রের যাপিত জীবনচরিতে ধাবমান করতে পারলে অবশ্যই জীবনের সমস্ত চাহিদাকে পাওয়ার পরিণত করা মানব জীবনে অবশ্যই সম্ভব। আর এর শৃঙ্খলাবদ্ধ পরিমিত জীবনবোধ একসময় অসাধারণ জীবনের অধিকারী করে তোলে, তা আবার অন্যের কাছে উপরোল্লিখিত কীর্তিমান মানুষের জীবনদর্শন রূপে প্রজন্মের কাছে আদর্শ রূপে আবর্তিত হয়। প্রবাদ আছেইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। তাই আমাদের সকলের ইচ্ছাশক্তি জাগ্রত হোক আমি সফল আলোকিত মানুষ হবো, সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলবো, মানব সভ্যতা, মানবিকতা রক্ষা করবো। সর্বোপরি একজন ভালো মানুষ হবো।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও প্রাক্তন এনজিও কর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার বুকের পাঁজরে তুমি
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের পররাষ্ট্রনীতি সুন্দর সৃজনশীল ও বন্ধুত্বপূর্ণ