আবার মার্কেটে আগুন পুড়ল ৬শ দোকান

বঙ্গবাজার দেখেও সতর্ক হয়নি নিউ সুপার মার্কেট শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন, নাশকতার তদন্ত

আজাদী ডেস্ক | রবিবার , ১৬ এপ্রিল, ২০২৩ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট অগ্নি ঝুঁকিতে; বঙ্গবাজারে ভয়াবহ আগুনের অভিজ্ঞতার পরও ফায়ার সার্ভিসের এই মূল্যায়ন জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, তারা নির্দেশনা মেনে কিছু যন্ত্রপাতি কিনেছিলেন। তবে সেগুলো সংযোজন করার আগেই লেগে যায় আগুন।

এই ঘটনায় তিনতলা ওই মার্কেটটিতে বসানো শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও প্রশ্নের মুখে পড়েছে। বছর তিনেক আগে যেভাবে তা করা হয়েছে, তা যথাযথ মনে করছে না ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গতকাল মার্কেটটিতে আগুন লেগে ব্যবসায়ীদের হিসাবে প্রায় ৬০০ দোকান পুড়ে যাওয়ার পর এই বিষয়গুলো সামনে এসেছে। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, এক থেকে দেড় সপ্তাহ আগে পরিদর্শনের পর মার্কেটটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে ব্যবসায়ীরা সেই নোটিশে খুব গুরুত্ব দিয়ে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে জানা যায়নি। খবর বিডিনিউজের। গত ৪ এপ্রিল বঙ্গবাজারে আগুনের পর জানা গিয়েছিল, মার্কেটটিকে ২০১৯ সালেই ঝুঁকিপূর্ণ করেছিল ফায়ার সার্ভিস। এরপর চার বছরে নোটিশ করা হয় আরও ১০ বার। ব্যবসায়ীরা কোনো গুরুত্ব দেননি। উল্টো টিনের মার্কেটটি ভেঙে বহুতল মার্কেট করার উদ্যোগ তারা ঠেকিয়ে দেন হাই কোর্টে গিয়ে। সেই আগুন নিয়ে আলোচনা থামতে না থামতে সকাল পৌনে ৬টার দিকে নিউ মার্কেট ফুটব্রিজ সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটে (দক্ষিণ অংশ) আগুন লাগে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আগুনের সূত্রপাত তিন তলায় হলেও পরে তা দোতলাতেও ছড়ায়।

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট (দক্ষিণ অংশ) বণিক সমিতির আহ্বায়ক মারুফ হাসান বলছেন, এই মার্কেটে এক হাজার ৩০০ দোকান রয়েছে। এর মধ্যে আগুনে প্রায় ৬০০ দোকান পুড়ে গেছে। আগুনের তাপ ও আগুন নেভানোর জন্য ব্যবহৃত পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আরও শ’খানেক দোকানের মালামাল।

অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ফায়ার সার্ভিসের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই মার্কেটটি পরিদর্শন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। মার্কেটটিতে অগ্নি ঝুঁকি কমাতে কী কী করতে হবে, সে বিষয়ে তাদের কিছু নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছিল।

ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার বিষয়টি নিয়ে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট বণিক সমিতির আহ্বায়ক মারুফ হোসেন বলেন, ফায়ার সার্ভিস নোটিশ দিছিল। আমরা ধীরে ধীরে তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ আগায়ে নিচ্ছিলাম। কিছু জিনিসপত্র কেনাও হয়েছে। তবে পুরোপুরি তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নিউ সুপার মার্কেটের দোতলার ব্যবসায়ী আবু ইউসুফ ফেইসবুকে মার্কেটের নামে একটি পেইজ চালান। দোতলায় তার কাপড়ের দোকান। তিনিও বলছেন, ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু সরঞ্জাম সংগ্রহও করেছিলেন তারা।

শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন : ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মালিকানাধীন নিউ সুপার মার্কেট যখন করা হয়, তখন তা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছিল না। ব্যবসায়ী আবু ইউসুফ বলেন, আগে মার্কেটটি এমনিই খোলামেলা ছিল। ৫৬ বছর আগে দোতলার মার্কেটটি এসি করা হয়। পরে দুই বছর আগে নিচতলার মার্কেটটিও পুরোটা এসি করা হয়। তিনতলায় কোনো এসি ছিল না। খোলামেলা মার্কেটে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা আটকে এসি করায় তা হিতে বিপরীত হয়েছে বলে মনে করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।

বাহিনীটির পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম বলছেন, মার্কেটটির দোকানগুলোর ফ্লোরে প্রচুর পরিমাণে মালামাল স্তূপ করে রাখা হয়। সেগুলো থেকে থেমে আগুন উঠছে, যার কারণে প্রচণ্ড ধোঁয়া হচ্ছে। কিন্তু সেখানে ভেন্টিলেশনের অবস্থা খুব খারাপ। ব্রিদিং অ্যাপারেটাস (অঙিজেন সিলিন্ডারমাস্ক) নিয়েও ভেতরে বেশিক্ষণ থাকতে পারছেন না ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

নিউ মার্কেট দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম শাহীন বলছেন, নিউ সুপার মার্কেটের যে অংশটিতে আগুন লেগেছিল, সেটি কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করতে বায়ু চলাচল ব্যবস্থা জিপসাম বোর্ড দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে। আগুন যেখান থেকেই লাগুক না কেন, জিপসাম বোর্ডের কারণে তা দ্রুত পুরো মার্কেটে ছড়িয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে ফজরে নূর তাপস ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, এখানে আমাদের যে মূল নকশা ও কাঠামো ছিল, তাতে অনেক পরিবর্তন করা হয়েছে। এখানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সব মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যে জায়গাগুলো উন্মুক্ত রাখার কথা, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে এটার মূল নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। এভাবে সব বন্ধ করে দিলে পরিণতি কী ভয়াবহ হতে পারে সেটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। আমি সবাইকে বলব আপনারা দেখেছেন আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অবৈধ নকশা বহির্ভূত অনেক ভাঙচুর করেছি। এখনও অনেক ভাঙা বাকি আছে। আমি সংশ্লিষ্টদের বলব অবৈধভাবে নকশা পরিবর্তন করবেন না, নকশা বহির্ভূত কোনো স্থাপনা করবেন না।

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাতের চার ঘণ্টা পর আগুনের শিখা আর দেখা না গেলেও এখনও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল বিপণি বিতানটি। গতকাল সকাল পৌনে ৬টা দিকে নিউ মার্কেট লাগোয়া তিনতলা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

বিপণি বিতানের দোতলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। মার্কেটের দোতলা ও তিন তলায় সবই পোশাকের দোকান। আগুন নেভাতে ভেতরে গিয়ে ধোঁয়ায় ফায়ার সার্ভিসের ১২ জন কর্মী এবং একজন স্বেচ্ছাসেবক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার মইন। আগুন লাগার প্রকৃত কারণ তদন্ত না করে বলা যাবে না বলে জানান তিনি। ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটগুলোর বিষয়ে আজ রোববার প্রেস ব্রিফিং করা হবে বলে জানান তিনি।

আগুনে পুড়ে কারও হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গভীর রাতে মার্কেট বন্ধ করে দেওয়ার পর ভেতরে কারও থাকার কথা না। আর মার্কেট খোলার আগেই ভোরে আগুন লাগে।

রোজার ঈদের আগে নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা নতুন পণ্য তুলেছিলেন দোকানে। আগুন লাগার পর ব্যবসায়ীদের হাহাকার শোনা যায় মার্কেটের সামনে। আগুনের খবর পেয়েই যেসব দোকানি আসতে পেরেছেন, তাদের মরিয়া হয়ে ঈদের আগে দোকানে তোলা কাপড় সরাতে দেখা গেছে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৮টি ইউনিট কাজ করে। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী এবং বিজিবির সদস্যরাও।

আগুনে নাশকতার তদন্ত শুরু র‌্যাবের : ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতা আছে কিনা সেই তদন্ত শুরু করেছে র‌্যাব। গতকাল রাতে পুলিশের বিশেষ এ ইউনিটের আইন ও গণমাধ্যম পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, তারা ইতোমধ্যে নিউ সুপার মার্কেটে আগুনের পেছনের কারণ অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছেন। কোনো ধরনের নাশকতা রয়েছে কিনা এ বিষয়ে র‌্যাবের গোয়েন্দারা কাজ করছেন।

নাশকতার প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা : রাজধানীতে ঘটে যাওয়া প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের কারণ খতিয়ে দেখার কথা জানিয়েছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আলমামুন। তিনি বলেছেন, নাশকতার প্রমাণ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বারবার কেন অগ্নিকাণ্ড, খতিয়ে দেখুন : ঈদের আগে পুরান ঢাকার বঙ্গবাজার ও নবাবপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগার ঘটনায় নাশকতার সন্দেহ করছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মইন উদ্দিন। তাই অগ্নিকাণ্ডের এই ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভিন্নরূপে অগ্নি সন্ত্রাস? সন্দেহ প্রধানমন্ত্রীর
পরবর্তী নিবন্ধনির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি আবারও চক্রান্ত শুরু করেছে