আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস : প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস

বিশ্বজিত গুপ্ত বিশু | শুক্রবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

আজ আমাদের অন্যতম স্মরণযোগ্য দিন ৩ ডিসেম্বর। স্মরণযোগ্য কারণ এ দিন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে ২৯ বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। তাই এবারের প্রতিবন্ধী দিবসে একটি বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। ১৯৯২ সালে জাতি সংঘের সাধারণ পরিষদ ডিসেম্বরের তৃতীয় দিনে প্রতিবন্ধী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সংস্থার সদস্যদেশগুলির প্রতি দিনটি পালনের আহ্বান জানান। সে হিসেবে এবার আমাদের দেশে ২৩তম জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস হিসেবে পরিচিত।
বিশাল এই পৃথিবীতে সব মানুষই চায় ভালোভাবে, সুন্দর ও মুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতে। সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন পাঁচটি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সুন্দর ও মুক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকার সুযোগ এখন পর্যন্ত সবার নেই। সমগ্র মানবসমাজের মাত্র ১০ শতাংশ এই সুবিধা পাচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে একটি নির্ভরযোগ্য সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যেতে পারে। পরিসংখ্যানটি জানাচ্ছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ প্রতিবন্ধিতার শিকার। আর বাংলাদেশের ১২ শতাংশ জনগোষ্ঠী অর্থাৎ প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ প্রতিবন্ধী। বৃহৎ এই জনগোষ্ঠী শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, বৈষম্য, দয়া-দাক্ষিণ্য, করুণা ও অনুকম্পার ওপর ভর করে জীবন নির্বাহ করে। তবে ২০০৭ সালে জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী সনদ পাওয়ার পর আমাদের দেশে এ সম্পর্কে ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। ২০১৩ সাল ১৬ জুলাই এই সম্পর্কে একটি বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়, ৩ অক্টোবর পাস হয়। ৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির সম্মতি দেন। এই মৌলিক অধিকারের মধ্যে প্রতিবন্ধীদের জনসম্পদে রূপান্তর করতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য এখনো যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য নিচের বিষয়গুলো খুবই উল্লেখযোগ্য।
শনাক্তকরণ: সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির পরিসংখ্যান ও উপাত্ত সংগ্রহের নিমিত্ত জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়নি। না জানার কারণগুলো চিহ্নিত করা দরকার। প্রতিবন্ধী শিকার হতে পারে এমন শিশুকে শিশু শনাক্তকরণে ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ২০১৬ সালে সরকারিভাবে জরিপ হলে ও ১নং ওয়ার্ড চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরশেনের সুবর্ণ নাগরিক কার্ড অনেক প্রতিবন্ধীর হাতে আসেনি। রাষ্ট্রীয়ভাবে তার তদারকি করা প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় প্রতিবন্ধীদের সামগ্রিক উন্নয়ন ক্ষেত্রে সরকার খুবই আন্তরিক। জেলা-উপজেলা কর্তব্যরত সমাজসেবা কার্যালয় প্রতিবন্ধী সংগঠনসহ মানসিক ও মানবিকভাবে এগিয়ে আসলে শনাক্ত কাজ করা সহজ হয়ে উঠবে।
চলন: প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং কর্মরত সহায়ক কর্মীদেরকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চলনের কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দানের প্রদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রবেশ গম্যতা: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নিজেরা যাতে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্বাধীনভাবে চলাচল করতে পারে সেজন্য অবকাঠামোভাবে সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে উঁচু ভবন ও অফিসগুলোয় রেম্প সুযোগ নেই বললেই চলে। দেশের সমাজসেবা কার্যালয়, জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিস, জেলা পরিষদ কার্যালয়সহ বিভিন্ন প্রশাসনিক কার্যালয়ে প্রতিবন্ধী বিষয়ক সভা-সেমিনার হলেও যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় শারীরিক প্রতিবন্ধীদের স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে অংশ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ভবন, সড়ক, যানবাহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসন, কর্মস্থলসহ সর্বক্ষেত্রে যাতে প্রতিবন্ধীরা সুবিধাবঞ্চিত না হয় এটিতে বিশেষভাবে নজরদারি জরুরি।
শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যক্তিত্ব, মেধা, সৃজনশীলতা, মানসিক ও শারীরিক সামর্থ্যের একটি মুক্ত সমাজে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণের জন্য সার্বিক একীভূত শিক্ষার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে কার্যকর ব্যক্তি-নির্দিষ্ট সহায়তা প্রদান করে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। যেটি সর্বোচ্চ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগত ও সামাজিক বিকাশ ঘটায়। প্রতিবন্ধীতার ধরণ ও লিঙ্গ অনুযায়ী চাহিদার ভিন্নতা বিবেচনায় সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু করা এবং বিদ্যমান কারিগরি-বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধীদের দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে হবে।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বৃত্তিমূলক ও পেশাগত পুনর্বাসন, কর্ম ধরে রাখা এবং পুনরায় কাজে যোগ দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।
কর্মসংস্থান: যথাযথ নীতিমালার আওতায় সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে শিক্ষিত প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য উপর্যুক্ত কর্মক্ষেত্র শনাক্তকরণসহ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। কর্মস্থলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চাহিাদর ভিন্নতা বিবেচনায় প্রয়োজনীয় স্বাচ্ছন্দ্যের উপযোগী পরিবেশ ও ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা বাস্তবায়ন করতে হবে। ধনী-গরিব প্রতিবন্ধীদের বৈষম্য যাতে সৃষ্টি না হয় সেজন্য সরকারে সতর্ক দৃষ্টি রাখাও আবশ্যক। কারণ আমাদের দেশে স্বাভাবিক সুস্থ মানুষের ধনী-গরিব বৈষম্য দিন দিন বাড়ছে। এই অসুস্থ মানসিকতা সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ মেধাবী প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে পড়ালেখার সুযোগ গেজেটে বিশেষভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। বিশ্বের সব রাষ্ট্রে আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ঘটা করে পালন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশে দিবসটি পালন করতে গিয়ে সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। কারণ ওই সময়ে সব স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা চলে। এ কারণে অনেক প্রতিবন্ধী দিবসটিতে অংশ নিতে পারে না। তাই সরকারের কাছে আবেদন, জাতীয় প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষে সরকারি ছুটি বাধ্যতামূলক করার কিংবা ওই দিন পরীক্ষা না রাখা। এতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও দিবসটিতে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবে।
সামাজিক নিরাপত্তা: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের, বিশেষ করে প্রতিবন্ধী নারী ও কন্যাশিশু এবং প্রবীনদের সামাজিক-রাষ্ট্রীয় সুরক্ষামূলক ও দারিদ্র্য বিমোচনমূলক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করলে আর্থিক সক্ষমতা অর্জন করা সহজ হবে।
ক্রীড়া-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড ও বিনোদন: প্রতিবন্ধিতার ধরণ উপযোগী নাটক, মঞ্চনাটক, চলচ্চিত্র, শিক্ষামূলক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান সংবাদ প্রস্তুত ও সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা। একইসঙ্গে খেলাধুলার মাধ্যমে চিকিৎসার (Play Therapy) প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। বিশেষ সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে প্রতিটি উপজেলায় প্রতিবন্ধী ক্রীড়া প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থাপন করা সময়ের দাবি।
সচেতনতা: শৈশব থেকে সব শিশুর মধ্যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকারের প্রতি সম্মানমূলক মনোভাব গড়ে তুলতে পাঠ্য-পুস্তকে বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্তিসহ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটি স্তরে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংগঠন: প্রতিবন্ধী ব্যক্তির নেতৃত্ব বিকাশের জন্য জাতীয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ক্রমে যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংগঠন ও স্ব-সহায়ক সংগঠন প্রতিষ্ঠায় উৎসাহদান এবং সংগঠনসমূহের প্রতিবন্ধীদের জন্য আর্থিক সহায়তা রাষ্ট্রীয়ভাবে করতে হবে। প্রতিবন্ধী বিষয়ক সংগঠনে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। একইসঙ্গে প্রতিবন্ধীদের যেকোনো শিক্ষা কার্যক্রম যাতে বাণিজ্যিক লক্ষ্য থেকে মুক্ত রাখতে হবে। হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীদের দারিদ্র দূরীকরণেও প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আধুনিক বৃত্তিমূলক শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। সত্যিকার ও সুন্দরভাবে তাদের জন্য সুচারু কাজ করা গেলে সর্বক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা প্রতিযোগী হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবেই হবে। বাংলাদেশ সরকার ও হতদরিদ্র প্রতিবন্ধীদের দারিদ্র দূরীকরণের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। নানারকম সমস্যাভারে দেশটি জর্জরিত। তাই হয়তো এ অপরিহার্য কাজগুলো এগিয়ে নিতে একটু দেরি হচ্ছে। আগের তুলনায় আমাদের সরকার প্রতিবন্ধী হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অনেক মানবিক ও মানসিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এসব প্রতিবন্ধীদের মধ্যে নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউবা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও কেউবা অটিষ্টিক কেউবা শারীরিক এদের মধ্যে কেউ কেউ জন্মগতভাবে, কেউ রোগাক্রান্ত, কেউবা দুর্ঘটনার কারণে প্রতিবন্ধী হয়েছে। তাদের মনকষ্ট সার্বিক ক্ষেত্রে কষ্ট থেকেও কষ্টকর। সৃষ্টিকর্তার সবাই সৃষ্টমানব। কেউ নানা ভাবে প্রতিবন্ধীত্বের শিকার। আগামী কাল সূর্য উদয়ের আগে আমি যে প্রতিবন্ধী হবোনা কেউ বলতে পারবে না। প্রতিবন্ধী নিয়ে সবাইকে আজ নয় কাল না ফেরার দেশে একদিন যাত্রা করতে হবে। এই চির সত্যকে সবাই আজ ভাবার বিষয়। তাঁদের উন্নয়নে সবাইকে সত্যিকার অর্থে কাজ করতে হবে। পাশ্চাত্যের প্রতিবন্ধী ও দক্ষিণ এশিয়ার আমাদের ক্ষুদ্র একটি দেশের প্রতিবন্ধীদের সুযোগ-সুবিধার বিস্তর ফারাক রয়েছে। খ্রীষ্টপূর্ব মহাকবি হোমার ছিলেন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, এই যুগে এসেও আমরা পেয়েছি বৈজ্ঞানিক স্টিপেন হকিংসকে। প্রতিবন্ধীদের কাজে, কর্মে ও প্রশিক্ষণে একটি পরিবেশ ও প্রতিবেশ বড়ই ফেক্টর। এরা সুযোগ পেলে অফুরন্ত জীবনীশক্তি, কারো না-কারো মত বড় হবার ইচ্ছাশক্তি ফিরে পাবে। কোভিড-১৯ এ সামগ্রিক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী মানুষরা দেশ উন্নয়নে বেঁচে আছি। আমাদের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যথাবিহীত কাজ গুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সম্মিলিত ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে। ‘একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, গ্রহণযোগ্য এবং টেকসই কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বের দিকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নেতৃত্ব এবং অংশগ্রহণ’ ত্রিশটি লক্ষ্য অর্জন করি।
লেখক: কনসার্ন সার্ভিসেস ফর ডিসঅ্যাবেলড সিএসডি’র সাধারণ সম্পাদক, সাবেক ক্রিকেটার

পূর্ববর্তী নিবন্ধআত্মপ্রেম বা নার্সিসিজম
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা