আত্মপ্রেম বা নার্সিসিজম

শামীমা সুমি | শুক্রবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

আত্মপ্রেম কি খুব খারাপ শব্দ? না মোটেও তা নয়, নিজেকে ভালোবাসা খারাপ কিছু নয়, তাতে যেহেতু অন্যের ক্ষতি হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো নিজেকে অতিরিক্ত ভালোবাসা মানুষগুলো দিনকে দিন স্বার্থপর হয়ে ওঠে। এরা আস্তে আস্তে অন্যকে ভালোবাসতে ভুলে যায়। অতিরিক্ত আত্মপ্রেম মানুষকে চরম হিপোক্রেটে পরিণত করে তারা অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল কম থাকে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে। আমি যখন এসব নিয়ে ভাবি তখন মনে হয়, কে আত্মপ্রেমিক নয়? আমি কি তা নই? প্রকারভেদে কিছু নার্সিসিস্ট অপরের মনোবেদনার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন বিষয়টা খারাপ পর্যায়ে যায়। নার্সিসিস্ট চেনেন তো! আচ্ছা আমি জানাচ্ছি -গ্রিকপুরাণে নার্সিসাস বিওশিয়ার থেসপি শহরের এক পুরুষ শিকারী যে নিজ অনুপম সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। সে জলপরী লিরিওপি এবং নদী দেবতা সেফিসাস এর সন্তান। স্বীয় সৌন্দর্যে সে এত গর্বিত ছিল যে যে-সব নারী তার প্রেমে পড়ত তাদেরকে সে প্রত্যাখ্যান করে দিত। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত এক নারীর আবেদনে দেবী নেমেসিস তার এ অহংকার দেখে নার্সিসাসকে একটি পুকুরের দিকে আকৃষ্ট করে। পুকুরে নার্সিসাস নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেয়ে তার প্রেমে পড়ে যায়। এটি যে কেউ নয়, তার নিজেরই প্রতিচ্ছবি মাত্র, তা সে বুঝতে পারে না। সে হাত বাড়িয়ে প্রতিবিম্বটি ধরতে চাইলে তা পানিতে হারিয়ে যায়।
নিজের সৌন্দর্যের মায়া কাটাতে না-পেরে একসময় সে বেঁচে থাকার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। মৃত্যু পর্যন্ত সে প্রতিচ্ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। নার্সিসাসের এই স্বভাব থেকে ‘আত্মকেন্দ্রিকতা’ বা ‘আত্মপ্রেম’ বোঝাতে ‘নার্সিসিজম’ শব্দটি চালু হয়েছে। তাই অধিক আত্মপ্রেম নিজেকেই বিনাশ করার উপায় ছাড়া আর কিছুই নয় কিন্ত একথা আমরা বুঝি ক’জন। ফেসবুকের এই যুগে মানুষের ভেতর নার্সিসিজম পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, প্রথমেই বলেছি নার্সিসিজম খারাপ কিছু নয়, বরং বড় বড় সেলিব্রেটি, লেখক-সাহিত্যিক, নায়ক-নায়িকা, খেলোয়াড়, রাজনীতিবিদ ইত্যাদি সবার ভেতরেই নার্সিসিজম বেশি লক্ষ্য করা যায়।
নার্সিসিস্ট মানে কি সফল ব্যক্তি?
মোটেও তা নয়, বরঞ্চ সফল ব্যক্তিদের মধ্যে নার্সিসিজম শতকরা হার বেশি দেখা যায়। বহু গবেষণা করে মনোবিজ্ঞানীরা আত্মপ্রেম বা নার্সিসিজমকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করেছেন যেমন : টঙিক নার্সিসিজম বা ক্ষতিকারক আত্মপ্রেমী। এরা সবচেয়ে ক্ষতিকারক আত্মপ্রেমী এরা খুব সহজে অন্যের ক্ষতি করে এবং তাতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনায় ভোগে না। এরা সবসময় গুরুত্ব পেতে পছন্দ করে আর প্রচুর সময় চায়। ওদের প্রতি গুরুত্ব প্রশংসা আর সময় কম পেলে এরা খুব বাজেভাবে রিয়্যাক্ট করে আর সবটাই করে বাহাদুরি দেখানোর জন্য। এরা নিজেকে লুকিয়ে রাখতে জানে না,বরঞ্চ তার সাথে যারা থাকে তার এসব অভ্যাস লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে।
ক্লজেট নার্সিসিস্ট বা গুপ্ত আত্মপ্রেমী : এই ধরনের আত্মপ্রেমী বোঝা বা শনাক্ত করা খুবই কঠিন। এরা অপরের সাথে খুব গুছিয়ে কথা বলে, এবং নিজের ধারণা অন্যের উপর খুব সুন্দর করে প্রতিফলিত করে দেয়। কিন্তু নিজের বিশ্বাস থেকে কখনওই একচুলও নড়ে না। এদের মধ্যে কারো কারো আবার পরোক্ষভাবে নিজের প্রশংসা বা গুণগান শুনতে বেশ আগ্রহ থাকে।
এঙিবিশনাল নার্সিসিস্ট বা লোক দেখানো আত্মপ্রেমী:
এরা গুপ্ত আত্মপ্রেমীর ঠিক উল্টো, এরা কাউকে কেয়ার করে না। বরং এরা অন্যের জন্য অনেক ভালো ভালো কাজ করে। কিন্তু উদ্দেশ্যটা থাকে ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের আত্মপ্রেমটা প্রচার করা। এধরণের আত্মপ্রেমীদের দ্বারা অনেক মানুষ উপকৃত হয় তাই এদেরকে কমিউনাল নার্সিসিস্ট বলা হয়। যেহেতু আত্মপ্রেমীরা মনোযোগ পছন্দ করে সেহেতু এদের মুল লক্ষ্য হলো আপনি পছন্দ করুন আর না করুন এড়িয়ে যেতে পারবেন না।
বুলি নার্সিসিস্ট বা মুখ খারাপ আত্মপ্রেমী : এরা নিরন্তর মানুষ হেয় করে ছোট করে বা পচিয়ে আনন্দ পায়। অন্যের দুরবস্থা দেখে বা বিব্রত করে মজা পায়। এরা অন্যকে যতো ইচ্ছে কটূ কথা বলে আনন্দ নিক, কিন্তু নিজের সমন্ধে একটা বাজে কথাও এরা সহ্য করতে পারে না। পরিশেষে একটা কথা বলি, আত্মপ্রেম কোন খারাপ কিছু নয়, কারণ সফল ও ভাগ্যবানরাই আত্মপ্রেমে মগ্ন থাকে। কিন্ত সমস্যা দেখা দেয় তখনই যখন কারো অধিক আত্মপ্রেমের কারণে আশপাশ সবাই ভোগান্তিতে পড়ে এবং বিব্রত হয়। জীবনে আত্মপ্রেম লবনের মতো হওয়া উচিত পরিমিত হলে রুচিকর বেশি হলে ক্ষতিকর। আত্মপ্রেম বেশি মগ্ন হবেন না তাতে দেশ জাতিকে চুলোয় রাখুন, নিজের বিনাশ ডেকে আনবেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে সচেতন হতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস : প্রতিবন্ধীদের অধিকার রক্ষা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন সম্মিলিত প্রয়াস