আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান

মোহাম্মদ তামিরুল ইসলাম | রবিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০২ পূর্বাহ্ণ

ইসলামী স্বর্ণযুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিম মনষীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। তাদের মধ্যে প্রথমে যার নাম আসে তিনি হচ্ছেন আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে যাকারিয়্যাহ আর রাযী। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি রাজেস বা রজিস নামে পরিচিত। তিনি ৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে পারস্যে অর্থাৎ ইরানের রে নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন।

 

আলবার্স পর্বত মালার দক্ষিণের ঢালে বিখ্যাত সিল্ক রোডের পাশে এই নগরীটি অবস্থিত। যা বর্তমানে বৃহত্বর তেহরানের অংশ। তার নামের শেষে আররাযী অংশটা আসে তার জন্মস্থান থেকে। যার অর্থ রের অধিবাসী। চিকিৎসা বিজ্ঞানে আররাযীর অবদান অবিস্মরণীয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তার অবদান বিবেচনা

করলে তুলনা করা যায় তার এক শতাব্দী পর জন্ম নেওয়া চিকিৎসাবিদ ইবনে সিনার সাথে। অনেক বুদ্ধিজীবী তাকে মধ্যযুগের তথা মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে গণ্য করেন। তবে তিনি শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না একাধারে ইসলামী ফক্বিহ তথা আইন গবেষক, গাণিতিক, পদার্থবিদ এবং দার্শনিক।

আররাযী প্রথম জীবনে কবিতা ও শিল্পকলায় আগ্রহী ছিলেন। তারপর রসায়ন, জ্যোতিবিদ্যা দর্শন গণিতসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করেন। প্রতিটি বিষয়ে তিনি সমান পাদর্শিতা দেখিয়ে ছিলেন। তাকে সে সময় সব চেয়ে সৃজনশীল লেখক বলে গণ্য করা হয়। তিনি তৎকালীন বিশ্বের জ্ঞান চর্চার নগরী রের বড়

মনীষীদের থেকে জ্ঞান অর্জন করে মেডিসিনে উচ্চ শিক্ষা লাভের জন্য জ্ঞানের ভূমি বাগদাদে চলে যান। বাগদাদের বায়মারিস্তান হাসপাতালে তিনি লেখাপড়া ও অনুশীলন করেন। এরপর চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী হিসেবে অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়ে দেশবিদেশে অনেক খ্যাতি অর্জন করেন। প্রথমে আররাযী

তৎকালীন সুলতানের চিকিৎসকের পাশাপাশি স্থানীয় হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দান করেন। পরে রের গভর্নর মানসুর বিন ইসহাক তাকে রে শহরে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানান। এরপর রাজকীয় রের হাসপাতালে নিযুক্ত হন। আররাযী মানসুর ইবনে ইসহাকের নামে দুটি বই উৎসর্গ করেন। একটি হচ্ছে

The spiritual Physick of Rhazes আর দ্বিতীয়টি মিডিসিনের উপর লেখা কিতাব ‘আল মানসুরি’। তারপর তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর পরীক্ষিত অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ‘আল হাওয়ি ফি ত্বীব লিররাযী’ তেইশ খণ্ডের গ্রন্থটি রচনা করেন। তিনিই সর্বপ্রথম রাসায়নিক যৌগকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুক্ত

করেন। তিনি নবজাতকের চিকিৎসা নিয়ে সর্বপ্রথম আলাদা গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি প্রাণীর অস্ত্র দিয়ে সার্জারির ক্ষেত্রে ব্যবহার করেন। সেসময় চিকিৎসক হিসেবে বেশ ভালোই সুনাম অর্জন করেন আররাযী। তিনি এতটাই খ্যাতি অর্জন করেছিলেন যে, তাকে বিভিন্ন দেশের শাসন কর্তা বা রাজাবাদশাদের

চিকিৎসার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হতো। সে সময় বাগদাদ থেকে আব্বাসীয় খলিফা আল মু’তাদিল তাকে আমন্ত্রণ জানান এবং আল মু’তাদিলের নামে একটি হাসপাতালের পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আররাযী আল মুতাদিদের পুত্র আল মুকতাফির শাসনামলে আব্বাসি খিলাফার সবচেয়ে বড় হাসপালন

নির্মাণের করার দায়িত্ব পান। হাসপাতাল নির্মাণে কোন স্থানটিকে নির্বাচন করবেন সে জন্য তিনি এক অভিনব কৌশল হাতে নেন। তিনি শহর জুড়ে কিছু জায়গায় টাটকা মাংসের টুকরো রেখে আসেন। যে স্থানে মাংস দীর্ঘস্থায়ী ছিলো অর্থাৎ দেরিতে পচতে শুরু করে সেখানেই তিনি হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। আর রাযী পেট্রিডিস, নিউরোসার্জারি ও অফথালমোলজি সংক্রমণ রোগ সহ অনেক চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন।

চিকিৎসা বিজ্ঞান, আলকেমি ও পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে তিনি ১৮৪টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। মধ্যযুগে অনুবাদের বদৌলতে ইউরোপে তাঁর অধিকাংশ গ্রন্থ চিকিৎসা বিজ্ঞানের শিক্ষায় পাঠ্য বই হিসেবে পঠিত হতে থাকে। মনোবিজ্ঞান ও সাইকোথেরাপির চিকিৎসার জনক হিসেবেও এই মুসলিম মনীষীকে ধরা হয়।

তিনি কিতাব আল হাওয়িতে গাইনিকলজি ও অফথালমিক সার্জারি বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই সব চিকিৎসায় তাঁকে ফাদার বা জনক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চোখ নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা ও গবেষণায় বেশি যুক্ত থাকায় তাঁকে এসবের পথপদর্শকও ধরে নেওয়া হয়। তিনি চোখের রেটিনার যে দশটি স্থর বা

লিয়ার আছে সেগুলোরও আবিষ্কার করেন। আল রাযী হাম এবং গুটি বসন্তকে আলাদা আলাদা রোগ হিসেবে সর্বপ্রথম বিশ্লেষণ করেন। আর স্মলপক্স বা গুটি বসন্ত ও হাম চিকিৎসা নিয়ে তিনি তাঁর রচিত গ্রন্থ আল জুদারিতে বিস্তর আলোচনা করেন। যা ইংরেজিতে অনুবাদ করে নাম রাখা হয় A Treatise On The Small Pox and Measles । তাঁর লেখা শিশুদের চিকিৎসা নিয়ে On The Treatment of Small Children চিকিৎসা বিজ্ঞানে শিশু চিকিৎসার

 

স্বতন্ত্র একটি শাখা হিসেবে বিবেচিত হয়। আল রাযী দ্যা ভ্যারচুয়াস লাইফ সাত খণ্ডের গ্রন্থে তিনি গ্রীক দার্শনিক এরিস্টেটল ও প্লেটোর আলোচনা সমালোচনা সহ তিনি বেশ কিছুতে অভিনব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন। তিনি এই বইয়ে তাঁর পড়া বিভিন্ন বইয়ের নোট সহ নানা রোগবিদ্যার বিষয়ে আলোচনা করেন। এই

বইটির জন্য তাঁকে অনেক পণ্ডিত মধ্যযুগীয় শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক হিসেবে বিবেচনা করেন। আল রাযীর আরেকটি মূল্যবান গ্রন্থ হচ্ছে ‘ডাওট এবাওট গ্যালেন্থ নামে গ্যালেনের সমালোচনার বইটি রচনা করেন। তিনি গ্যালেনের অনেক থিউরিকে ভুল প্রমাণ করেন। বিশেষ করে জ্বর উঠার বিষয়ে যেসব লক্ষণ তিনি বর্ণনা করেন তাতে আল রাযী কোনো মিল খুঁজে পান নি।

চিকিৎসার পাশাপাশি তিনি এ নিয়ে আলাদা শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন। তাঁর থেকে জ্ঞান লাভের আশায় দূর দূরান্ত থেকে জ্ঞানপিপাসুরা ছুটে আসতো। তিনি অনেক উদারমনা ছিলেন। গরিবদরিদ্রদের থেকে তিনি কোনো প্রকার ফি গ্রহণ করতেন না। তিনি প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়ে সর্বসাধারণের জন্য একটি গ্রন্থ

রচনা করেন। গ্রন্থটি হচ্ছে ‘মান লা ইয়াদুররুহু্থ। এই গ্রন্থটি প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য ব্যাপক সাড়া ফেলে। এই বই হলো পৃথিবীর সর্বপ্রথম বই ‘হোম মেডিকেল ম্যেনুয়াল’। এতে তিনি ডায়েট করা, জ্বর, সর্দিকাশি, মাথা ব্যাথা, অস্বস্তি, চোখ কান, পাকস্থলি রোগের জন্য ঘরে বসে ঔষধ তৈরির বর্ণনা

করেছেন। আর এইসব ঔষধ তৈরিতে ঘরে বা সামরিক শিবিরে সহজলভ্য এমন উপাদানের কথাই উল্ল্যেখ করেন। এছাড়া মানসিক রোগাক্রান্ত ব্যক্তি নির্দোষ এবং একে আলাদাভাবে যত্ন নেওয়ার কথাও তিনি সর্বপ্রথম বলেন।

আল রাযীকে রসায়নের যৌগের প্রবর্তক ছিলেন। তিনি প্রথম সালফিউরিক এসিড যৌগে লবণ আবিষ্কার করেন। তিনি ৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ ইথাইল এলকোহোল আবিষ্কার করেন এবং চিকিৎসায় এর ব্যবহারের ধরণও বাতলে দেন। তাছাড়া কেরোসিনের আবিষ্কারেও তিনি প্রথম ছিলেন। রসায়ন বিষয়ে তিনি অনেক গ্রন্থ

রচনা করেন। নবম শতাব্দিতে তিনি কিতাব আল আসরারে কেরোসিন উৎপাদনের দুটি পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁর বহু পরে ১৮৪৬ সাথে আব্রাহাম গেসনার পিচজাত কয়লা এবং তেল সীলা থেকে ঝরানো পাতানের সাহায্যে কেরোসিন শুধন করেন। কেরোসিনে বাণিজ্য শুরু হয় ১৮৫২ সালে। আল রাযী

রসায়নের পাশাপাশি কেরোসিন ল্যাম্প সহ আরো অনেক যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেন। আল রাযী ধাতু রূপান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পরশ পাথরের সাহায্যে সাধারণ ধাতুকে স্বর্ণে রূপান্তর করা সম্ভব। পরশ পাথরের সন্ধানে তিনি অনেক ভ্রমণও করেছিলেন। এই বিষয়ে তিনি দ্যা সিকরেটস এবং দ্যা

সিকরেটস অফ সিকরেটস দুটি বই লিখেন। কালের বিবর্তনে তাঁর বহু আবিষ্কার ও লেখিত গ্রন্থ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এসব মনীষীর আবিষ্কার জানিয়ে দেয় মধ্যযুগ বর্বরতার যুগ নয় বরং এটি আজকের আধুনিক বিশ্বের গোড়াপত্তনের যুগ। ইসলামই মানুষকে আধুনিকতার সবক পড়িয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅমর একুশে
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে