দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

দু মিনিট অপেক্ষা করবো বলেছিলাম, কিন্তু দু মিনিট হল নাকি তার চেয়ে কম বা বেশী হল তা তো আর বলতে পারবো না হলফ করে, কারণ হাতফোন হাতে ধরে তো বসে থাকিনি। হ্যাঁ সেটাই তো। আজকাল তো কেউ আর ঘড়ি ধরে সময় দেখে না, সময় তো দেখা হয় হাতফোনেই। সেটা তো আছে পকেটে। এদিকে ঐ দুই তরুণ তরুণী নিজ নিজ পিঠ থেকে ব্যাগ ট্যাগ নামিয়ে হাত পা খেলিয়ে, নিজেরা অনুচ্চস্বরে কথা কি যেন বলে উচ্চ হাস্য করে একজন আরকেজনকে

 

জড়িয়ে ধরতেই, বাঙাল মন আমার অস্বস্তিতে পড়ে গেল বড়ই। মনে হল ঐ দুই মিনিট বুঝি আর কাটছেই না, অতএব সাথে সাথেই হ্যাভ এ গ্রেট ডে বলে ঐ যুগলকে মহাপ্রাচিরের ঐ নির্জন ঘুমটি ঘরে, চারিদিকের প্রাকৃতিক আবহের মধ্যে আসলেই গ্রেট সময় কাটানোর ফুরসৎ করে দিয়ে ঐ ঘর থেকে দ্রুত সপুত্রক নিষ্ক্রান্ত হয়ে ফিরতি হাঁটা ধরতেই, পুত্র বলে উঠলো আচানক কথা

বাবা, আমার খিদে পেয়েছে।’

হ্যাঁ দীপ্রর মুখ থেকে ওরকম কথা শোনা একটা আচানক ঘটনাই। সাধারণত ওর মা’কেই সময় করে ওকে মনে করিয়ে দিতে হয় যে ওর খিদে পেয়েছে। শুধু কি তাই? অনেক সময় মনে করিয়ে দেবার পর ওর মা ওকে জোর করে খাইয়েও দেয়। সেরকম একটা অবস্থায় এক্ষণে ওর মুখে খিদের কথা শুনতেই বুজলাম

মহাপ্রাচিরে পায়ে হেঁটে উঠার ধকলটা ওর ভালই গেছে যেমন, তেমনি নিজেও হৃদয়ঙ্গম করলাম যে সময়ও গেছে অনেকটাই। কারণ নিজের পেটেও টের পাচ্ছি ঐ যে চিকিৎসা বিদ্যার ভাষায় যাকে বলে হাঙ্গার পেইন, তা।

ঠিক আছে, চল দৌড়ানোর দরকার নেই, বরং একটু জোরে এগুই। তোমার মায়ের ব্যাগে নিশ্চয় খাবার আছে।

না না, আমি ওসব খাবো না। নীচে নেমে ঐ বার্গার কিং এ খাবো।’

তা তো খাবেই। কিন্তু নীচে নামতেও তো বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। তাই বলছিলাম আর কী।

না, বার্গার কিং এ গিয়ে খেলেই চলবে আমার। আচ্ছা বাবা, তারপর আমরা কোথায় যাবো?’

সামার প্যালেসে যাওয়ার কথা।

ওটা কোথায়? কতো দূরে?’

তা তো জানি না। দেখি

বাবা, বাবা ঐ যে দেখো কী সুন্দর একটা পাখি? কী পাখি ওটা? ওটা কি কিং ফিশার?’

এতোক্ষণ গাছের পাতায় পাতায় হিম হাওয়ার ধাক্কা খাওয়ার ঠিক শো শো শব্দ না হলেও কেমন যেন একটা ঝিম ঝিম শব্দ বাদে, মাঝেমধ্যে কানে হঠাৎ হঠাৎ দু একটা পাখির ডাক শুনলেও, চোখে পড়েনি একটাও। দীপ্রর কথা অনুসরণ করে বাঁয়ে চোখ যাবার পরও পড়লো না পাখিটা চোখে। হাঁটার গতি কমিয়ে দিয়ে,

নিজের অজান্তেই ফিসফিসিয়ে ঘাড় নিচু করে পুত্রকে জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পাখিটা? ভাবটা এমন যেনবা আমি যে পাখিটির সঠিক অবস্থান বুঝতে চাচ্ছি পুত্রের কাছে একথা পাখিটির কানে গেলেই বুঝিবা ফুড়ুৎ করে উড়ে যাবে সে!

নিজের অবচেতন সেই সাবধানী দেহভঙ্গির সাথে করা আমার ফিসফিসানি এরই মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে পুত্রের গলায়ও। সেও তাই কানের কাছে মুখ নিয়ে সন্তর্পণে আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর সাথে ফিসফিস করে, বলল ‘ঐ যে গাছের ডালটা দেখছো না, ওখানেই তো বসে আছে। কি সুন্দর একটা মুকুট মাথায়। ওটা কি কিং ফিশার?’

পুত্রের অঙ্গুলি নির্দেশিত পথে চোখ রেখে ধীর পায়ে সপুত্রক মহাপ্রাচিরের রেলিং এর দিকে এগুতে এগুতে নজরে এলো পাখিটা। আসলেই চমৎকার। কিন্তু নাহ বড় আকারের মাছরাঙার চেয়ে আকারে বা কাঠ ঠোকরার চেয়েও একটু বড়ই হবে আকারে ওটা। ঠোঁটটাও কাঠ ঠোকরার ঠোঁটের চেয়ে তো অবশ্য এমন কি

মাছরাঙার ঠোঁটের চেয়েও বেশি লম্বা, আর একটু বাঁকানো। মাথার দিক থেকে বুক পর্যন্ত অর্ধেক শরীরের রংটাকেই হলদেটে বাদামিই বলা চলা। আর লেজ থেকে শুরু করে পিঠের বাকি অংশের রং সাদা আর কালোয় ডোরা কাটা। মেলেধরা জাপানি হাতপাখার মতো মাথায় আছে তার চমৎকার এক বাদামি রঙয়ের ঝুটি। ঝুটির পালকের উপরের দিকটা কালো। গাছের ডালে গভীর ধ্যানে বসে আছে পাখিটা। দেখছি আমরা তাকে পাশ থেকে।

এরই মধ্যে অতি সন্তর্পণে বাপবেটা দু’জনে রেলিং এর ঐ কামান রাখা অংশের খাঁজে দাঁড়িয়ে পাখিটির দিকে দেখতে দেখতে, পুত্রকে ফিসফিস করে জানালাম যে ওটা অবশ্যই কিং ফিশার না। এ এলাকায় কোনও লেইক বা ডোবা যেহেতু চোখে পড়ছে, এখানে মাছরাঙার থাকার কথা না। একবার ভাবলাম বলি যে ওটা

এখানকার কোন জাতের কাঠঠোকরা হতে পারে। পরক্ষণেই বহুকাল আগে পড়া প্রাণিবিদ্যার জ্ঞান হাতড়ে মনে হল এর ঠোঁটের গড়ন যা, তাতে এ কাঠ ঠোকরা হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। আমাদের দেশের নদীর চরে বা পানি শুকিয়ে যাওয়া বিলে ঝিলে যে কাঁদাখোঁচা পাখি দেখা যায়, তারই মতো এর ঠোঁট। যার মানে হল

এ নিশ্চয় এ ঠোঁট দিয়ে নরম মাটি খুঁচিয়ে পোকা মাকড় কেঁচো এসব ধরে খায়। তবে রং বলছে একে আমাদের দেশের কাঁদাখোঁচার মাসতুতো, পিসতুতো ভাই বা বোন বলাও চলবে না। অগত্যা পাখিটা চেনার ব্যাপারে ছেলের কাছে নিজের অজ্ঞতাই প্রকাশ করেই রেহাই পেতে হল। অবশ্য প্রাণিবিদ্যা তো পড়েছি পাশ

করার জন্য। তা পড়তে গিয়ে নানান পাখি সম্পর্কে পড়লেও আমি নিজে তো আর বিখ্যাত পাখি বিশারদ সলিম আলী হয়ে যাইনি।

দাঁড়াও বাবা, একটা ছবি তুলি পাখিটার’ বলেই দীপ্র এসময় তার হাতানো যন্ত্রটি ঐ দিকে তাক করতেই, আমাদের থেকে হাত পনের বিশ দূরের গাছের নিচু ডালে বসে থাকা সেই পাখিটা যেন মনে হল টের পেয়ে গেল আমাদের মতলব। অতএব ফুড়ুৎ করে উড়ে হারিয়ে গেল সামনের এক সবুজ ঝোপের আড়ালে।

 

আহ হা, ছবিটা তুলতে পারলাম না।’ তুমুল হতাশা প্রকাশ করলো এতে মনঃক্ষুণ্ন দীপ্র। এদিকে এই প্রথম আমি রেলিং এর খাঁজে দাঁড়িয়ে সোজা নীচের দিকে চোখ ফেলে আন্দাজ করার চেষ্টা করছি যে, ভূমি থেকে কতোটা উঁচু করে বানানো হয়েছে এই দেয়াল।

চোখ আন্দাজে মনে হল, হবে প্রায় কমপক্ষে আমাদের দেশের আড়াইতলা উঁচু প্রাচীরটা। তিন তলার সমানও হতে পারে। আচ্ছা সেই পুরাকালে পাহাড়ের উপর করা এতো উঁচু দেয়াল ডিঙানো তো আসলেই সম্ভব ছিল না কারো। আক্রমণকারীরা হস্তিবাহিনী নিয়েও যদি আসতো তাহলেও তো হাতির পিঠ থেকে লাফিয়ে

উঠেও সৈন্যদের পক্ষে এই দেয়ালের উপরে ওঠা সম্ভব হতো না। সেদিক থেকে এটা আসলেই দেশের প্রতিরক্ষার জন্য মিং রাজাদের এটা অত্যন্ত কার্যকর পন্থাই ছিল বলতে হয়। এই চিন্তার লেজ ধরে ফের মনে ঘাই মেরে উঠলো সেই বহুলশ্রুত কথাটা, যদিও জানি না সেই কথাটা কতোটা সত্য বা মিথ্যা। সেই কথাটা হল, চীনের শত্রুরা যে ক’বার এই দেয়াল টপকেছিল, সে ক’বারই নাকি টপকেছিল ঘুষের মই দিয়েই!

বাবা,চল আমরা যাই।’

দীপ্রর এই তাড়ায় সম্বিৎ ফিরে রেলিং ছেড়ে সামনের দিকে হাঁটার জন্য ঘুরতেই দেখি, ঐদিক থেকে এগিয়ে আসছে চার পাঁচ জন চায়নিজের একটা দল। ওদের দেখেই মনে হল, হায়রে পেছনের ঘুমটি ঘরে যে একটু আগে ঐ যুগলকে গ্রেটওয়ালে গ্রেট টাইম কাটানোর সুযোগ দিয়ে আসলাম, তা তো বেচারারদের

কপালে জুটল না দেখছি আর! আহারে, ইউরোপিয়ান আমেরিকানরা তো জানি জীবনকে উপভোগ করতে চায় তাড়িয়ে তাড়িয়ে। সে কারণেই তো সেরকম একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলাম ওদেরকে নির্জন এই মহাপ্রাচিরের এই অংশে; তাতে নিশ্চয় ওরা খুব কৃতার্থ হয়েছিল। এখন এরা তো সেখানে গিয়ে

অচিরেই তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে দেবে। কী দরকার ছিল এদের এখনই এদিকে আসার। যে কোনও কারণেই হোক, এই এলাকাটা তো এমনিতেই শুনশান ছিল এতোক্ষণ। আহ হা রে বেচারারা, জীবনের একটা স্মরণীয় রেকর্ড করার মোক্ষম সুযোগ পেয়েও হারাতে যাচ্ছে তা!

লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান
পরবর্তী নিবন্ধবিশ্বের সব ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন থাকুক