বিশ্বের সব ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন থাকুক

ছন্দা চক্রবর্ত্তী | রবিবার , ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৮:০৫ পূর্বাহ্ণ

যারে যেই ভাষে প্রভু করিল সৃজন / সেই ভাষা হয় তার অমূল্য রতন’। ষোড়শ শতকের সাধক কবি ‘সৈয়দ সুলতান’, যাঁর জন্ম চট্টগ্রামের পটিয়ায়, তিনি এই দুটি লাইন এর মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে অমূল্য রতন বলে বর্ণনা করেছেন। তাঁর এই দুটি লাইন এর মাধ্যমে বোঝা যায় সৃষ্টিকর্তা যাকে যেই ভাষায় সৃষ্টি

 

করেছেন সেই ভাষা তার কাছে অমূল্য। প্রভূ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তা আমাদেরকে এই বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কোলে আশ্রয় দিয়েছেন। জন্মের পর মায়ের ভাষা বাংলা তাই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা এবং আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলবো এবং আমাদের রাষ্ট্র ভাষা বাংলাই হবে বা এটাই হওয়া উচিৎ। কিন্তু না আমরা বাঙালিরা সেই অধিকার হারাতে বসেছিলাম, যখন আমরা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামে পাকিস্তান এর শাসনাধীন ছিলাম।

১৯৪৮ সাল থেকে মূলত আমাদের এই মাতৃভাষা রক্ষার আন্দোলন শুরু হয়। তদকালীন পাকিস্তান এর গভর্নর জেনারেল মি: জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের একটি ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তান এর রাষ্ট্রীয় ভাষা হবে উর্দু, অন্য কোনো ভাষা নয়, ইংরেজিতে দেওয়া সেই ভাষণে এও বললেন ‘আপনাদের

বলছি যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু এবং অন্য কোনো ভাষা নয়। কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে সে আসলে পাকিস্তানের শত্রু’। মূলত এই ভাষণের পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে এতদঞ্চলের জনগণ, এবং গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’।এই অঞ্চলের ছাত্র, শিক্ষক, লেখক,

বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সকলের সমন্বিত এই পরিষদ এর মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়ে আসছিলেন। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১১মার্চ ১৯৪৮ সাল সরকারি ভবনের সামনে বিক্ষোভ ও মিছিল হয়, ঐ মিছিলে কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আমাদের

মহান নেতা ববঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন তিনি শুধু মুজিব নামেই পরিচিত ছিলেন। এভাবে হরতাল, মিছিল, মিটিং এর মাধ্যমে এগিয়ে চলছিলো ভাষা আন্দোলন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ঢাকার স্থানীয় প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারী করে। এদিকে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ঠিক করলেন এই ১৪৪ ধারা তারা ভাঙবেন, সকালে তারা কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে এবং কয়েকজন ছাত্রী সহ মিছিল নিয়ে এগোলেই

 

কিছু দূর যাওয়ার পর কাঁদানো গ্যাস ছেড়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করলেন এবং কিছু ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়। বিক্ষোভরত ছাত্রদের একটি দল গণপরিষদ ভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেই পুলিশ গুলি বর্ষণ করে। এতে রফিক, শফিক, সালাম, বরকত সহ আরোও নাম না জানা অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

এভাবেই ভাষার দাবি আদায় করতে গিয়ে ঢাকার রাজপথ আমাদের ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হলো। এভাবেই শোকে মুহ্যমান বাঙালি জাতির জীবনে ২১শে ফেব্রুয়ারি শোক দিবস, শহীদ দিবস এবং ভাই হারানোর দিবস হিসেবে ইতিহাস এর শোকগাথা অংশ হয়ে আত্মপ্রকাশ ঘটলো।

ভাষা আন্দোলনের নিহতদের স্মরণে শহীদ মিনার নির্মাণ, একুশকে নিয়ে আবদুল গাফফার চৌধুরীর গান,‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি / আমি কি ভূলিতে পারি’? একুশের প্রথম কবিতা, ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ যার রচয়িতা ছিলেন চট্টগ্রামের কবি ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী’।

 

ভাষা আন্দোলন, একুশে ফেব্রুয়ারি, একুশের গান, কবিতা, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির আবেগী ভালোবাসার মর্যাদা কয়েক বছরের মধ্যেই বাঙালি সংস্কৃতির এক প্রতীকী সাংস্কৃতিক ঘটনায় পরিণত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার সংবিধানে বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে

বাধ্য হয়। এর পর থেকেই ক্রমে ক্রমে নানান বিষয়ে এই অঞ্চলের জনগণের চাহিদার ভিত্তিতে পাকিস্তান সরকার এর সাথে অসন্তোষ দানা বাঁধতে থাকে বাঙালিদের মনে, যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার আন্দোলনের সূত্রপাত হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মন মানসে এক ধরনের শোক গাথা ভাই হারানোর বদলে বাংলা ভাষার অধিকার আদায় দিবস হিসেবে স্থান পেল। মাতৃভাষার অধিকার আদায় হলো ভাইয়ের রক্তের বিনিময়ে।

বাংলাদেশ স্বাধীন ভাবে আত্মপ্রকাশ এর পর থেকে অর্থাৎ ১৯৭১ সাল এর পর থেকে আমাদের কাছে ২১শে ফেব্রুয়ারি, শহীদ দিবস, শোক দিবস, বাংলা ভাষার অধিকার আদায় দিবস হয়ে অন্তরে প্রোথিত হয়েছিল। ১৯৭২ সাল থেকে আমাদের স্কুলে সবগুলো জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হতো,

২১শে ফেব্রুয়ারির দিন খুব ভোরে খালি পায়ে হেঁটে স্কুলে এসে শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন পূর্বক পুষ্পার্ঘ্য প্রদান করা হতো। আমাদের সকল শিক্ষার্থী তখন স্কুলে উপস্থিত হতো। শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা সহজাত শোকের আবেগ কাজ করতো। পুরো গ্রামের পরিবেশ ও ভাষা শহীদদের

 

স্মরণ জনিত কারণে শোকার্ত ভাবে দোকানপাট বন্ধ রাখতো। খুব ভোরে গ্রামের রাস্তায় মিছিল নিয়ে মাইকের মাধ্যমে করুন সুরে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি! গান বাজানো হতো। স্কুলে একুশের স্মরণ ও শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদন উপলক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর আয়োজন করা হতো।

এভাবেই আমাদের মধ্যে একুশের চেতনা সঞ্চারিত হয়েছে। বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীদের উপস্থিত রাখতে কত রকমের ভাবনার কসরত করতে হয়। নানা রকম উপায় করেও অর্ধেক শিক্ষার্থী উপস্থিত করা যায় না। এই মাতৃভাষা আদায়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। রক্ত দিয়ে কেনা

এই ভাষা আমাদের। রক্তের বিনিময়ে পৃথিবীর আর কোথাও কেউ ভাষার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করেছে এমন নজির আর একটিও নেই। তাইতো রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ এই ভাষাকে আমরা তুমি বলে সম্বোধন করি।

এক জরীপ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, পৃথিবীতে সবচেয়ে মধুরতম প্রথম ভাষা হলো বাংলাভাষা। দ্বিতীয় স্প্যানিশ, তৃতীয় ডাচ। এই মধুরতম ভাষা আমাদের প্রাণের বাংলাভাষা আমাদের গর্ব, আমাদের আশা ও অমূল্য রতন। তাইতো কবি বলেছেন, ‘মোদের গরব মোদের আশা / আ মরি বাংলা ভাষা’পূর্ব প্রজন্ম

বাংলা ভাষার অধিকার আদায় করে দিয়েছেন, আমাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের উচিত এই ভাষার মান রক্ষা করা, এর যথাযথ মর্যাদায় ধারণ করা, লালন করা, শুদ্ধ বাংলার চর্চা করা।

সর্বজন শ্রদ্ধেয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের এক সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে ভাষার মর্যাদা সম্পর্কে এক প্রশ্নোত্তরে শুনেছিলাম, ‘পৃথিবীর ভাষার বাগানে ইংরেজি, বাংলা, উর্দু, হিন্দি, স্প্যানিশ, ডাচ বা আরোও যা যা ভাষা আছে, তার মধ্যে বাংলা ভাষার স্থান গোলাপের মতো’। সত্যিই তো পৃথিবীর মধুরতম স্থান অর্জিত

এই আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা, ফুলের রানী গোলাপ এর মতো হলে, ভাষার রাজ্যে বাংলা ভাষাকে ভাষার রাজা বলাই যুক্তি যুক্ত। রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলা ভাষা ও একুশে ফেব্রুয়ারি উভয়ই আমাদের আবেগী চেতনা তাইতো ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি বর্ণমালার চাষ শুরু করে দেয়, বই

লেখা, বই তৈরি, বই বাঁধানো সর্বোপরি বই মেলা। অক্ষর রক্ষার আবেগে দেশের লেখক সাহিত্যিক, কবি, ছড়াকার, গ্রন্থকাররা তো আছেন বিদেশ থেকেও বইমেলায় যোগ দেন বাংলাভাষার কবি, লেখক ও সাহিত্যিকগণ। সকলেই বাংলা ভাষার আবেগী চর্চায় মেতে উঠে এই ফেব্রুয়ারিতে।

ভাষার শোক আস্তে আস্তে শক্তিতে পরিণত হলো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘ ১৯৫২ সালের এই দিনের শহীদদের স্মৃতিকে সারা বিশ্বে স্মরণীয় করে রাখার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন এর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

২০০০সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্বব্যাপী ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হলো। বাংলাদেশ এর প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতিসংঘ ২১শে ফেব্রুয়ারিকে এই স্বীকৃতি দিয়েছিল যার একটা নতুন মাত্রা তৈরি হয়। পৃথিবীর মাতৃভাষা সমূহের উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং

পৃথিবীর কোনো ভাষা যাতে হারিয়ে না যায় তা রোধ করতে এই দিবস অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে উঠে। এখন বিশ্বের প্রতিটি দেশে প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়, এবং সাথে সাথে বাংলাদেশের ভাষা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার এই দিবস স্মরণ করে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন

করা হয়। ফলে বাঙালি জাতি, বাংলা ভাষা, এবং ভাষা শহীদগণ দেশে দেশে সম্মানিত হয়। আমাদের শোকগাথা ভাষার অধিকার দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি এখন বিশ্বের ঐতিহ্যের অংশ। বিশ্বের সব ভাষা যথাযোগ্য মর্যাদায় আসীন থাকুক কারণ কবির কথায় – ‘নানান দেশের নানান ভাষা, বিনা স্বদেশী ভাষা মিঠে কি আশা’। লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধস্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে দক্ষিণ জেলা যুবলীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে