আধুনিক চট্টগ্রামের জন্য চাই নগর পরিকল্পনা ও তদারকি

পুলক কান্তি বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ১১:১৭ পূর্বাহ্ণ


১৯৭১ সালে স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যোদয়। একটি বিপ্লবী রেনেসাঁস। একবার ভাবুন – একটি জরাজীর্ণ ভূ-খণ্ড, সাড়ে সাতকোটি মানুষ। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর ভিনদেশী ষড়যন্ত্র বাঙালির নিত্য দিনের সাথী। ভগ্নস্তূপে থুপড়ে পড়ে থাকা একটি রাষ্ট্র । সেই নবজন্ম প্রাপ্ত দেশটির নাম বাংলাদেশ। সেই দেশটির পঞ্চাশ বছর পূর্তি মানে সুবর্ণ আলোক রেখায় উদ্ভাসিত স্বাধীনতার সুবর্ণ শিখা। তাই বাংলাদেশ এখন কৃষিযুগ থেকে শিল্পযুগ হয়ে প্রযুক্তির যুগে বাংলাদেশের জন্মকে সার্থক করা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা এবং মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর ভিশনকে বাস্তবায়ন করা বর্তমান প্রজন্মের প্রধান দায়িত্ব।
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে জাতির জনকের প্রত্যাশা ছিল, এ বাংলাদেশ হবে স্বপ্নের সুইজারল্যান্ড। দুশো-আড়াইশো বছর পূর্বে সুইজারল্যান্ডের অবস্থা আজকের মতো ছিল না। ছিল না, কোন সম্পদ। জীবিকার তাড়নায় সে দেশের মানুষ তখন বিদেশে পাড়ি জমাতো। ধীরে ধীরে দারিদ্র অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালো সুইজারল্যান্ড। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে এবং প্রযুক্তি আহরণে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করে তাক লাগিয়ে দিল বিশ্বকে। বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধুর কন্যার ভিশন শতাব্দির লক্ষে এগিয়ে যাবার পথক্রমায় সুবর্ণ উজ্জ্বল। বঙ্গবন্ধুর স্থির বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশেরও এমনিতর উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
২০২১ সালে এসে বাংলাদেশ রূপান্তরিত হওয়ার পথে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। আর এ উন্নয়নের স্বর্ণ দ্বার আমাদের চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের উন্নয়ন বাদ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম শাশ্বতকাল থেকে বাংলাদেশের গেটওয়ে।
বর্তমানে চট্টগ্রাম যোগাযোগ ব্যবস্থার এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে মায়ানমার হয়ে এশিয়ান হাইওয়ে নির্মাণ ও বাংলাদেশকে বিশ্বায়নের নেটওয়ার্কের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করার জন্য নির্মিত হচ্ছে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ (১৮ হাজার কোটি টাকায় নির্মিত) মেরিন ড্রাইভ রোড। এই প্রকল্পের আওতায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল রোড নির্মাণের কাজ চলমান। টানেলটি আনোয়ারায় নির্মিত কোরিয়ান ইপিজেড ও চীনের অর্থায়নে প্রস্তাবিত অপর অর্থনৈতিক অঞ্চলের সাথে যুক্ত হবে মিরসরাই ইকোনমিক জোন স্থান থেকে বাঁশখালী, চকরিয়া, কক্সবাজারের হয়ে কক্সবাজার টেকনাফ মেরিনড্রাইভ এর সাথে যুক্ত হবে। চট্টগ্রামের উপর দিয়ে মিয়ানমার হয়ে এশিয়া হাইওয়ে নির্মানের কারণ হলো এশিয়ার পূর্ব-পশ্চিম সংযোগ করে চীনের সর্বশেষ প্রস্তাব “One Belt One Road” বাস্তবায়ন করা। এটি বাস্তাবায়ন হলে এবং চট্টগ্রামের স্থল বন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে ভিশন ২০২১ হবে বাংলাদেশের স্বর্ণযুগ। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি এক স্বাপ্নিক অভিযাত্রায় নতুন প্রজন্ম।
সময় এসেছে বাংলাদেশ কে বিশ্বের সামনে রোল মডেল হিসেবে দাড় করানোর। পুরনো সব ত্রুটি ও বিচ্যুতির সব কিছুই অভিজ্ঞতা, কোনটাই ফেলনা নয়, চাই নতুন সময়ের জন্যে নতুন আধুনিক ডিজিটাল উদ্যোগ। যেমন : যদি একটি শহরে দিয়ে বুঝাই, ধরুন চট্টগ্রামের পরিকল্পিত আবাসন, জলজট, যানজট, রাস্তাঘাট সংস্কার, খাল সংস্কার, ভূমি বিরোধ, বহুতল স্থাপনা নির্মাণ, জলাধার সংরক্ষণ, খেলার মাঠ সংরক্ষণ, পাহাড় ধ্বংস ও ধস রোধ করা সহ সকল নাগরিক সেবা সংকট মেকাবেলায় চাই নগর পরিকল্পনা, মনিটরিং, দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে ডায়নামিক নেতৃত্বের সামনে, নগরবাসীর চোখের ওপর পুরো নগরটিকে প্রথমেই করতে হবে এক ফ্রেমে ভিজুয়ালাইজ, পাখির মতো উড়ে যাওয়া উচ্চতা থেকে পুরো নগর কে দেখতে হবে এক সাথে পাখির চোখে। পুরো নগর যখন কেউ এক সাথে দেখে তখন সে পরিকল্পনা করতে পারে, কোথায় কি ত্রুটি তা ধরতে পারে, তখন তিনি সত্যিকার নগর পরিকল্পকের মতোই সিদ্ধান্তে যেতে পারেন, মনিটরিং করতে পারেন, কোন স্থাপনা কোথায় নির্মিত হলে সামগ্রিক নগরে কী ইমপেক্ট পড়বে তা সহজেই অনুমান করতে পারেন। কারো দ্বারা মিসগাইড হবার সুযোগ একেবারেই থাকে না। মোদ্দা কথা তত্ত্ব নয়, জটিল বইয়ের ভলিউমে রচনা লিখে নগর সাজানো যাবে না, আবাসন পরিকল্পনাও হবে না, সরল ও সহজ বোধ্য ভাবে পুরো শহর আগে চোখের সামনে বসান, নগরবাসীর চোখের সামনেও তা তুলে ধরুন, সবাই তখন এক সাথে হয়ে উঠবেন নগর পরিকল্পক, নীতিনির্ধারকেরা সহজেই নেবে সঠিক সিদ্ধান্ত ও সিলেকশন অব প্রায়োরিটি, পাশাপাশি নগরবাসীকেও গৃহ নির্মাণ আইন কে মানতে মানসিকভাবেই তৈরী করে ফেলা সহজ হবে, সহজ হবে সরকারের অন্যান্য সকল সম্পৃক্ত উন্নয়ন কাজে সহযোগী বানানো। ক্ষুদ্র মাঠ পর্যায়ের তথ্য প্রদানকারীর সামান্য কপটতা, দুর্নীতি, অনেক ছোট বিষয় কিন্তু এই ছোট বিষয়টি সমস্ত সিস্টেম ও পরিকল্পনাকে অকার্যকর করে দে। তাই মাত্র আগামী এক বছরেই বর্তমান অপূর্ণাঙ্গ মাস্টার প্ল্যান কে পূর্ণাঙ্গ করা সম্ভব। পদ্ধতিগত ও পরিকল্পনা গত যে সব ত্রুটির কারণে সৃষ্ট হয়েছিল নাগরিক আবাসন সংকট, সিদ্ধান্তে সংকট, জলযট সংকট, যোগাযোগ সংকট সবকিছু নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা এর মাধ্যমেই সম্ভব এবং খুবই সম্ভব। এটাই মৌলিক আইডিয়াগত প্রজন্মের চেতনার ডিজিটাল টেকনোলজির বাংলাদেশ ও ক্যারিশম্যাটিক স্বপ্নবাজ তারুণ্যের সম্ভাবনাময় ডিজিটাল অর্জন। এখন এসব তরুণ ও তাদের প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করতে শুধু দরকার সিডিএ কর্তৃক স্ব-উদ্যোগী জন-সংশ্লিষ্ট একটি নিঃস্বার্থ ডিজিটাল ভিশন ভিজুয়ালাইজড ম্যাপ প্রণয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও তৈরি করতে বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণ।
এর মাধ্যমেই চট্টগ্রাম মহানগরকে পরিকল্পিত পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের আওতায় আনার প্রযুক্তিগতভাবেই সম্ভব। স্ব-প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগী প্রকল্পের আওতায় যা বাস্তবায়ন করতে হবে, তা হলো স্যাটেলাইট ভিজুয়ালাইজেশন সিস্টেম ও ডিজিটাল টেকনোলজি ব্যবহার করে এরিয়াল ভিহীকলের মাধ্যমে রিয়েল টাইম কারিগরি ডাটা সমৃদ্ধ ফটোগ্রামোমেট্রিক লাইভ ত্রি ডি টপোগ্রাফিক ডিজিটাল ম্যাপ তৈরী করা। এই জীবন্ত দৃশ্যমান থ্রি ডি মাপের উপর সমস্ত পরিকল্পনাগুলো ভিজুয়ালী গ্রাফিক বসানো, সমস্ত নগর এর সকল কিছুই যখন এক হাতের মুঠোয় দৃশ্যমান করা যায়, কেবল তখনই সংশ্লিষ্ট প্রশাসক নিজের চেয়ারে বসে ভাবতে পারে,ক্রিয়েটিভ থিংকিং তখন ভর করবে প্রশাসকের মাথায়, সিদ্ধান্ত নিতে,ও নির্দেশনা দিতে হয়ে উঠবেন ডাইনামিকস ক্যরেক্টার। অনেকটা আলাউদ্দিনের দৈত্য এসে আলাউদ্দিনকে তার হাতের তালুতে বসিয়ে নগর দেখাচ্ছেন, তখন বসে বসে দেখা যাবে কোথাও কোনো অপরিকল্পিত নির্মাণ হচ্ছে কিনা, এবং নগরবাসী, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, প্রশাসক সকলেই মূল সমস্যা সৃষ্টিকারী কর্মকে প্রতিহত করতে পারবেন। এই টেকনোলজির মাধ্যমে “প্রত্যেকটি এলাকার জন্যে আলাদা আলাদা দিক নির্দেশনা ম্যাপের ওপর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা পূর্বেই ইন্ডিকেট সহজেই করে এরিয়া ব্লক করা সম্ভব ও তা সর্বসাধারনের জন্যে অনলাইনের সামাজিক মাধ্যমে দিয়ে দেয়া, প্লান পাশ অনুমোদন দিতে মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব হবে তখন, এমন কি অনলাইনে প্ল্যান পাশ অনুমোদন, অটো সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে এর মাধ্যমে, কমবে দুর্নীতি টলারেন্স সীমায় আসবে, বাঁচবে কাজের সময়, গতিশীল ও আধুনিক হবে সেবা প্রতিষ্ঠান, অন্য উন্নয়ন কাজের জন্যে জনশক্তির ব্যবহার সহজ হবে, মাস্টার প্লেন বাস্তবায়ন ও নিয়ন্ত্রণ আর কোন সমস্যাই হয়ে থাকবে না,মাস্টার প্লেনের ভুল ও সঠিক সিদ্ধান্ত কোনটি তা সহজেই জাস্টিফাই করা সম্ভব হবে। কোন সংস্থা কোন নতুন প্রকল্প গ্রহণ করলে ঐ ম্যাপের উপর তার ডিজাইন ও তা বাস্তবায়ন কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারবে খুব সহজেই, ম্যাপের কোথায় কাজ শুরু হবে, কি কাজ হবে, কতদিন সময় লাগবে তা ম্যাপে শো করে দিলেই, আন্ত সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেকার সমন্বয় করবে, এই ম্যাপ। সিটি গভর্নমেন্ট বাস্তবায়নের সীমাবদ্ধতা বহুলাংশে এই ডিজিটাল ম্যাপের অটো সিস্টেম টেকনোলজির মাধ্যম বহুলাংশে সমন্বয় করা সম্ভব। পুরো শহরের রাস্তা সংস্কার, সমপ্রসারণ, জমি একোয়্যার, ব্যক্তি পর্যায়ে নতুন আবাসন গড়ার ক্ষেত্রে সকল জটিলতা ও জনগণের সাথে সরকারের সম্পত্তির সীমানা সংক্রান্ত সকল জটিলতা দূর করা সম্ভব। একটি আধুনিক শহর নির্মাণের, নগরবাসীর আবাসন শৃংখল ও সঠিক পরিকল্পনা ও শতভাগ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার এই ডিজিটাল ভিজুয়াল রিয়েল পরিকল্পনা ম্যাপ তৈরী করা এখন সময়ের চাহিদা। পৃথিবীর সকল বড় বড় নগর মহানগর ও শহরের পরিকল্পনা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষ, তাদের সমস্ত উন্নয়ন সিদ্ধান্ত এই ম্যাপের ওপরই করে থাকেন। যা ডিজিটাল বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় চট্টগ্রাম থেকেই প্রথম সংযোজন শুরু করা হোক। কোনো আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজনের আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এড়িয়ে বাংলাদেশের তরুণদের হাতে দায়িত্ব দিন। স্বপ্নের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে তারা আপনাদের হাতে তুলে দেবে সাফল্যের চাবি। এই হলো প্রজন্মের জন্যে রেখে যাওয়া একজন প্রযুক্তিবিদ হিসেবে দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা মেটানোর আমাদের রেখে যাওয়া স্বপ্ন।

লেখক : ফেলো প্রকৌশলী, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রযুক্তিবিদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, গৃহায়ণ লি: বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইভ্যালির সম্পদ বিক্রি ও হস্তান্তরে নিষেধাজ্ঞা
পরবর্তী নিবন্ধঅপার সম্ভাবনার পর্যটন : প্রকৃতির মায়াময় হাতছানি