আড্ডার জায়গা এখন বখাটেদের দখলে

চেরাগী পাহাড় মোড়

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২২ at ৫:২০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম শহরের সৃজনশীল মানুষের প্রিয় আড্ডার জায়গা চেরাগী পাহাড় মোড়। সাংবাদিক, শিক্ষক, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী থেকে শুরু করে সৃষ্টিশীল কেউই বাদ যান না এই আড্ডা থেকে। শত ব্যস্ততার মাঝেও দিনে অন্তত একবার সৃজনশীল মানুষগুলো ঢুঁ মেরে যান চেরাগীতে। কেউ আবার কাজ সেরে সন্ধ্যার পরে এসে আড্ডা জমান। সুখ-দুঃখের নানা স্মৃতি ভাগ করে নেন বন্ধুর সঙ্গে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে চেরাগীর মোড় ঘিরে শুদ্ধতার আমেজ উধাও হতে বসেছে। রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে প্রায়শ অস্ত্রের মহড়া এই এলাকার শুদ্ধতা শুষে নিচ্ছে দিনে দিনে। উৎপাতে কাহিল চেরাগীর মোড়। ছিঁচকে চোর, মাদকসেবী তো আছেই, তার সাথে যুক্ত হয়েছে আশেপাশের বিভিন্ন এলাকার বখাটে, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীরা। বাধা দেয়ার কেউ নেই। প্রতিবাদ করলেই এসব টিনেজের কোমর থেকে কখনো চাপাতি, ছুরি কিংবা পিস্তল বের হয়। বিভিন্ন সময় এ ব্যাপারে প্রতিকার চেয়ে পুলিশের শরণাপন্ন হয়েছেন চেরাগী মোড়ের ব্যবসায়ী মহল।

অভিযোগ রয়েছে, এসব সন্ত্রাসীর নামের আগে প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠনের নাম যুক্ত থাকায় থানা পুলিশ, ‘দেখছি’ ‘করছি’ আর ‘পাঠাচ্ছি’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। মাঝেমধ্যে পুলিশের মোবাইল টিম টহল দিয়ে যায়। কিন্তু তারাও দায় সারেন, ‘আমাদের কোনো অর্ডার দেওয়া হয়নি’ টাইপের কথা বলে। আর এরই ফাঁকে সৃজনশীলতার বিচরণস্থল থেকে চেরাগীর মোড় হয়ে পড়ছে অপরাধীদের বিশ্রামস্থল।

সৃজনশীল মানুষগুলোর এ নিয়ে ক্ষোভের শেষ না থাকলেও মুখ ফুটে বলতে পারছেন না কেউই। ইতোপূর্বে মোমিন রোড, চেরাগী এলাকার ফুল ব্যবসায়ীরা নিরুপায় হয়ে এসব সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারী চক্রের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছিলেন। চট্টগ্রাম ফুল ব্যবসায়ী ও ফুল চাষি বহুমুখী সমবায় সমিতির ব্যানারে তারা চেরাগী এলাকায় মানবন্ধন ও সমাবেশ করেন। কিন্তু প্রতিকার মিলেনি।

চেরাগী কেন্দ্রিক অপরাধীদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে পুলিশ চেষ্টা করে যাচ্ছে জানিয়ে কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবির আজাদীকে বলেন, নিয়মিত আমাদের মোবাইল টিম টহল দেয়। এছাড়া কোনো অভিযোগ পেলে আমরা সাথে সাথেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।

সর্বশেষ গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সাব্বির ও সৈকত গ্রুপের মধ্যে কথা কাটাকাটির জের ধরে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও রাত ৮টার দিকে ছুরিকাঘাতে আসকার বিন তারেক ইভান (১৮) নামে এক তরুণ নিহত হন। আহত হয়েছে আরো কয়েকজন।

এটিই প্রথম ঘটনা নয়। এর আগে চেরাগীর মোড়ে দিনেদুপুরে এক স্কুলছাত্রের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল বখাটেরা। ফুলের দোকানগুলোতে বিভিন্ন সময় হামলার ঘটনাও ঘটেছে। জোবায়দুল আলম আশিক নামে জামালখান ওয়ার্ড ছাত্রলীগের এক নেতাকে কদম মোবারক এতিমখানার গলিতে নিয়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে।

শুধু তাই নয়, চেরাগীর মোড়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনার জেরে ছাত্রলীগের এক পক্ষ প্রতিপক্ষকে নিজেদের শক্তি দেখাতে গিয়ে ভাঙচুর করে আশপাশের দোকানপাট ও গাড়ি। সৌন্দর্যবর্ধনের অংশ হিসেবে রাস্তার আইল্যান্ডের উপর লাগানো গাছের টবগুলোও ভাঙচুর করা হয়। চেরাগী মোড়ের ভেতরে প্রান্তিক নামের এক যুবককে লোহার রড, কোমল পানীয়ের কাচের বোতল দিয়ে বেদম পিটিয়েছিল কিছু যুবক। এর আগে-পরে কয়েক দফায় চেরাগী মোড়ে এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ ছোটখাটো সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এ সময় তারা রামদা, কিরিচ, হকিস্টিক, এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়েও চেরাগী ও এর আশপাশের এলাকায় মহড়া দেয়।

জানা গেছে, জামালখান খাস্তগীর বিদ্যালয় থেকে চেরাগী মোড় এবং আন্দরকিল্লা থেকে মোমিন রোডের পুরো অংশ, জে এম সেন হলসহ আশপাশের বিভিন্ন গলিতে এসব সন্ত্রাসী বিচরণ করে। আশপাশের এলাকায় আলাদা আলাদা বিচরণ করলেও এসব সন্ত্রাসী গ্রুপ চেরাগী মোড়ে জড়ো হয়। দীর্ঘদিন ধরে ছাত্রলীগ নামধারীদের দুটো গ্রুপকে কেন্দ্র করে আশেপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বখাটে সন্ত্রাসীরা চেরাগী এলাকায় এসে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। এসব এলাকার স্কুল, কলেজ ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষার্থীদের ইভটিজিং করে সন্ত্রাসীরা। এছাড়া ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ ভয়াবহ মাদকের বেচাকেনার সাথেও এরা জড়িত। পুরো এলাকার ফুটপাতে গড়ে ওঠা বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান, টং দোকান, ফুলের দোকান থেকে নিয়মিত চাঁদাও নেয় তারা। মূলত এসব উৎস থেকে সংগৃহীত অর্থের ভাগবাঁটোয়ারা ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয় তারা। আর দ্বন্দ্ব থেকেই হয় সংঘর্ষ।

কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে এখানে আসতে হয়। কিন্তু বখাটেদের কারণে তাদের চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। রাস্তার ওপর মোটরসাইকেল রেখে সৃষ্টি করা হচ্ছে প্রতিবন্ধকতা। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপর হামলে পড়ে বখাটে কিশোর-তরুণদের দল। তারা উচ্চস্বরে কথা বলে এবং অনেক সময় ‘ফাও’ খেয়ে চলে যায়। খাবারের টাকা চাইলে তাদের হাতে নাজেহাল হতে হয়। ছুরি দেখিয়ে মারার ভয় দেখায়। চেরাগী ক্যান্ডি ও অন্যান্য দোকানে এর আগে ভাঙচুর হয়েছে। অনেক সময় আসা-যাওয়ার পথে নারীদের উত্ত্যক্ত করে এসব বখাটে।

পুলিশের অভিযানে কয়েক বছর আগে এখানে টং দোকান থেকে দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। মাঝেমধ্যে টহল পুলিশ অভিযান চালালেও ঘুরেফিরে বখাটেরা আবারও দখলে নেয় চেরাগী পাহাড় এলাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমেয়ের পর মারা গেলেন বাবাও
পরবর্তী নিবন্ধদুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব থেকেই মারামারি