আজাদী : সংবাদপত্র শিল্পের সাফল্যে ঐতিহাসিক রেকর্ড

মোস্তফা কামাল পাশা | বৃহস্পতিবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

নিজের অবস্থানে নিয়ে ঘোষণা দেয়ার মত কেউ না। অভিজ্ঞতার শিক্ষা, যত আড়াল, ততবেশি কাজ ও শেখা-জানার সুযোগ। প্রচার ফেনা দামি সময় গিলে রঙিন বেলুন করে দেয়। লড়াই করে নিজের ভালকে জিতে আনা খুব কঠিন।
অর্জন কম না। কীভাবে? ছোট্ট পরিসরে দুঃখ জয়ের কাহন অসম্ভব। ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছে দৈনিক আজাদী। প্রায় ১৬ বছরের কর্মজীবনে কামারশালায় লৌহপিন্ড পিটিয়ে দা, কুড়াল বানানোর মতই পোক্ত করে দেয়। সুযোগ পেয়েছি, নিজকে ভেঙেচুরে গড়ার। কড়া শাসন-স্নেহ-স্বাধীনতা তিনটাই একলগে পেয়েছি। স্নেহ বেশি বিলিয়েছেন, সাংবাদিকতার অসাধারণ এক শিক্ষকও। জমিদার নন্দনটি আগে স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তিনি আজাদীর বার্তা সম্পাদক প্রয়াত সাধন কুমার ধর। নির্মোহ পেশাদারিত্বের ঝকঝকে আলোকধারা। তাকে আজাদীতে টেনে এনেছেন, সম্পাদক শ্রদ্ধেয় মরহুম অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। পড়ালেখা আর পেশাদারিত্বই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। অবসরে পত্র-পত্রিকা, বই, ছেলেবেলার মজার কান্ড বর্ণনা ও রাজনৈতিক আড্ডায় বেজায় আসক্তি ছিল । সহকর্মীদের সাথে কাজের ফাঁকে প্রাণবন্ত আড্ডা দিতেন। ওয়ালেট ফাঁকা করে সিঙ্গারা, কচুরি খাওয়াতেন। নিজের নতুন জানাশোনা, জ্ঞান অকাতরে ভাগ দিতেন সহকর্মীদের। কাজই ছিল তার সাধনা। কাজ ছাড়া বিশেষ অনুরাগ কারো প্রতি ছিলইনা। আড্ডায় সম্পাদক স্যারের উপস্থিতি প্রাণরসের নতুন যোগান আসত বেশি। দু’জনের কেউ ওয়াসরুমে গেলে প্যাকেটের সিগারেট গায়েবের ঘটনা নিয়ে চলত জমাটি খুনসুটি। উপভোগ ছিল দু’বয়সী শিশুর চাপল্য। কোন রিপোর্ট বা ফিচার ভাল হলে প্রশংসা করতেন- অনুপ্রাণিত করতেন সংশ্লিষ্টকে। আজাদীর সিড়িমুখে প্রেস রিলিজ রাখার বঙ ছিল। পরিচয়ের সুযোগে কেউ প্রেস রিলিজ হাতে দো’তলার নিউজ ডেস্কে আসলে বিরক্ত হতেন। যতই আপন হোক, ছাড় নাই। পেশার সাথে আপসকামীতা প্রচন্ড ঘৃণা করতেন। আমার গতি ও বাংলা ভাষার নতুন নতুন শব্দ চয়ন খুব পছন্দ করতেন।
একবার প্রেস রিলিজ বক্সের খাম ডেস্কে আনা হলে খুলতে গিয়ে পেয়ে যাই ১০০ টাকার একটা নোট। স্যার ডেস্কেই ছিলেন। কী করব জানতে চাইলে খানিক চুপ থেকে বলেন, নিজ থেকে এদ্দূর এসছে যখন, সদ্ব্যবহার উচিত। বলতে বলতে খামটা দেখতে চান। প্রেরকের ঠিকানা অস্পষ্ট, তাও সীমানার বাইরে। পিওন ডেকে সিঙ্গাড়া, কচুরি আনান। বিজ্ঞাপন শাখাসহ সবখানে বিলি হয়। বেঁচে যায় বেশকিছু খুচরো টাকা, ওগুলো পিয়নের ভাগের। নিউজটা কাভার হয়েছে কিনা, মনে নেই। ডেস্কে সম্ভবত প্রয়াত সুখেন্দু দা, সুলতান আশরাফী, দিবাকর বা নিজামও ছিল। এরকম অসংখ্য মজার ও নির্দোষ স্মৃতি তাকে ঘিরে। বৈষয়িক স্বার্থ কখনো তাকে টানেনি। টানলে বর্তমান বাস্তবতায় কোটি কোটি টাকার সম্পদ রেখে যেতেন। নগরকেন্দ্রে নিজস্ব জমি, টিন ছাদের সুন্দর বাড়ি ছিল পারিবারিক সূত্রে। রক্ষণাবেক্ষণও করতে পারেন নি ঠিকঠাক। জানামতে উল্টো সম্পত্তি বিক্রি করেছেন, ছেলেমেয়ের উচ্চ শিক্ষায়। আজাদীর বর্তমান সম্পাদক এম এ মালেক সাহেব তাঁকে স্যার সম্বোধন করতেন। অসম্ভব সম্মান করতেন। সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ স্যারের সাথে রাজনীতি-সাংবাদিকতা ও পারিবারিক সব তরফেই তার বন্ধুত্বের রসায়ন ছিল অপার্থিব এক বিস্ময়! এত সুযোগ যার হাতের মুঠোয়, কেন যে তিনি সাধারণ জীবন যাপন করতেন? জহুর হকার্স মার্কেটের কোট-টাই পরতেন? জমিদার নন্দনের এমন কৃচ্ছ্রতা সত্যি অবাক করার মত!
তিনি আমাকে দায়িত্বের বাইরেও এরশাদ-রওশন জমানার তীব্র নিউজ খরায় পত্রিকার পৃষ্ঠা ভরাটে টানা উৎসাহ দিতেন। সাক্ষী, তার আমলে আজাদীতে কমর্রত সহকর্মী ও আজাদী আর্কাইভ। সম্পাদক স্যার প্রাতিষ্ঠানিক রীতির বাইরে সব পৃষ্ঠায় এমন বেপরোয়া বিচরণের অন্যায় সুযোগ পছন্দ করতেন না। কিন্তু সাধন স্যারকে লাই না দিয়েও পারতেন না। তাই, ব্যালেন্স করতে হতো নিজকে। যা কিছু করি, সেরাটা দেবার তাগিদ ছিলই। সাথে স্বচ্ছতা ও পেশাদারিত্বে সর্বোচ্চ মনোযোগও। এটা, পেশাগত জীবনে যে কোন বাধার প্রাচীর ডিঙানোর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস এনে দেয়। আজাদী ছেড়ে আসার পর ভয়ঙ্কর আঁধারে নিরুদ্দিষ্ট গন্তব্য খুঁজে পেতে ঝন্‌জা-বিক্ষুব্ধ মহাসাগর সাঁতরাতে হয়। চারপাশেই লুকানো হাঙর-কুমির-অক্টোপাস। অথচ এরাই ছিলেন ক’ মাস আগেও প্রাণের বান্ধব! নতুন কোন হাউসে চাকরির রুচি ছিলনা। খুঁজিওনি, আজাদীর স্বাধীনতাদিতইবা কে? ‘৯৮ সালে শুধু শ্রমজাত সেবা বেচে মিডিয়ায় টিকে থাকার এত সুযোগ ছিলইনা।অন্তর্জাল সংস্কৃতির বিস্ফোরণও হয়নি যে, নিজের যোগ্যতা হাইলাইট করে কোন বিদেশি মিডিয়ার মনোযোগ কেড়ে নেব। কাগজে কলাম লিখে পকেট খরচা তোলাও কঠিন। এক কন্যাসহ ৪ শিশুর বড় সংসার। সাংবাদিকতা ছাড়া কিছুই শিখিনি। কঠিন দিনে ‘৯৭ সালের শেষ অর্ধে থাই এয়ারের অতিথি হয়ে ব্যাঙ্কক ভ্রমণের সুযোগ হয়। হোটেল রুমে ব্যাঙ্কক পোষ্টও পেতাম। ৯৬ পৃষ্ঠার বহুরঙা বিশাল কাগজ। এশিয়ার অন্যতম অভিজাত ও প্রভাবশালী দৈনিক। ইংরেজি সাংবাদিকতা চর্চা হয়নি। তবুও অভ্যাসের টানে বড় বড় শপিং মলের সওয়ারী টানা বাইকারদের নিয়ে সাক্ষাৎকার ভিত্তিক প্রতিবেদন করি, অনেক যত্নে। হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কের প্রধান নির্বাহী মার্কিন তরুনী জুলিয়ানার সহযোগিতায় পাঠাই, ব্যাঙ্কক পোস্ট এ। তখন আমার সম্পাদনায় চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ উম্মূখ ‘দৈনিক সাম্পান’ জন্মের আগেই মিস ক্যারেজের ক্ষণ গুণছে। কেন, বলা সঙ্গত হবেনা। দু’দিন পর সম্ভবত ১২তম পৃষ্ঠায় রাইডারের নিজস্ব রঙিন ছবি জুড়ে আইটেমটি ছাপা হয়। জুলি বেশ খুশি, আমিও। পরপরই ডাক পড়ে পত্রিকা অফিসে। সম্মানী চেক হাতে দিয়ে সিটি এডিটর সাউথ এশিয়ান ডেস্ক এডিটরসহ বসেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধি হতে অফার দেন। ব্রেক দরকার ছিলই-রাজি হয়ে যাই। কিন্তু টার্মস কন্ডিশনে অনেক ফাঁক ও ফাঁকি ছিল। আপত্তি শুনে কিছু বদলালেও বাস্তবে কাজটা প্রতিনিধির বদলে ষ্ট্রিঙ্গার বলাই সঙ্গত। চট্টগ্রামে অফিস করব বলায় বিরক্তির বদলে খুশি হয়। বুঝি অনেক পরে। ওদের টার্গেট থাই স্বার্থ। বঙ্গোপসাগরের ফিশিং, ব্লু-ইকোনমি নিয়ে বন্দর ও পর্যটন সংশ্লিষ্ট। জিয়ার আমলে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সুবিধা হাতায়। ‘৯০ দশকের আগে-পরে চুক্তি শেষ হলেও লোভ ছাড়েনি। আমাকে নিউজ হান্টের টোপ বানাতে চায়, পারেনি। বছর দুই আটকে থেকে পরে “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি”! বছরে চারবার ব্যাঙ্ককসহ বিভিন্ন বিদেশি নগরে বিলাস সফরসহ অনেক বৈষয়িক সুবিধার টোপ হেলায় পায়ে ঠেলি। যুদ্ধ করে, অবিশ্বাস্য রক্ত ও ইজ্জতের দামে দেশ অর্জন করেছি। ওটার স্বাথের্র সাথে আপস কী সম্ভব? অবশ্য অনেক কসরত ও জুলির সহযোগিতায় পশ্চিমা মিডিয়ার কিছু ঘুলঘুলি ফাঁক হয় ততদিনে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক দৈনিক আজাদী থেকে বিশ্ব মিডিয়ার তাজা বাতাসে স্নাত হই। এরপর অন্তর্জালের বিস্তার বিশ্ব দিগন্তও দ্রুত হাতের মুঠোয় আসে।
সংবাদপত্রের বাইরে মিডিয়ার আরও কিছু অর্থকরি সেক্টরে ভাড়াটে ও ঠিকে কাজ করতে হয়। অপ্রচলিত কোন কোন সেক্টর থেকে মোটা আয়ও আসে। এসব অজানা কথা ফাঁক করছি, আজাদীর প্রতি কৃতজ্ঞতার কারণে। সাথে সাধন স্যারের প্রতি প্রচন্ড আবেগও। তিনি এবং আজাদী মজবুত ভিত্তি গড়ে না দিলে কথাগুলো ফিকশনেই মানাত-বাস্তবে নয়। আজাদীর শিক্ষাকে পুঁজি করে বেশকিছু পেশাগত ও সৃজনশীল প্রকল্প নেয়ার দুঃসাহস করেছি। ব্যর্থতার বোঝা ভারী হলেও বেদনার কষ্টে ঝলসে আত্মবিশ্বাস আরো পোক্ত হয়েছে। ভয়াবহ প্রতিকূলতা জয় ও কঠিন লড়াই দিয়ে চার সন্তানকে সর্বোচ্চ শিক্ষাসহ আত্মবিশ্বাসের ভিতও গড়ে দিয়েছি। কেবল সাংবাদিকতা পেশায় ভর করে, তাও বারবার ছিন্নমূল! জীবন-জীবিকায় সন্তানেরা যার যার অবস্থানে সফল। নিজে টাইপিংও জানতাম না। হাতেই লিখতাম, অফিস সহকর্মীরা বাকি সব করতেন। মাত্র ক’বছরে আড়াই ভাষায় (একটায় গতি এখনো শ্লথ,তাই) পেশাদার মিডিয়া অপারেটর থেকেও দ্রুত টাইপিং পারি। যা খুশি তৎক্ষণিক লিখতে পারি। প্রতি লেখায় পারি মাত্রা ও আঙ্গিক ভেঙে ভিন্ন স্বাদ ও রুচি পরিবেশন করতে। সব সম্ভব হয়েছে, দৈনিক আজাদী তথা শ্রদ্ধেয় প্রয়াত সাধন স্যার, শ্রদ্ধাভাজন মরহুম খালেদ স্যার এবং বর্তমান সম্পাদক শ্রদ্ধেয় এম এ মালেক স্যার, অপত্য স্নেহ, শাসন এবং অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন বলেই। এই তিন অমিয়ধারা একযোগে বর্ষিত না হলে কোন গর্তে থাকতাম, ভাবতেও ভয়! বন্ধুদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা, অভাজনের গতিবিধি কঠোর ও তীক্ষ্‌ণ নজরদারিতে না রাখলে বহু বছর আগেই বেওয়ারিশ ফসিল হয়ে যেতাম নিশ্চিত।
মরহুম আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের ‘অন্যতম প্রিয় সন্তান’ দৈনিক আজাদী পাঠকপ্রিয়তা ধরে রেখে ৬২ বছরের ঝকঝকে মার্বেল সিড়িতে পা রেখেছে ৫ সেপ্টেম্বর। এটা এ’ অঞ্চলের সংবাদপত্র শিল্পের ঐতিহাসিক রেকর্ড সাফল্য। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা ছাড়া দেশে এই কৃতিত্বের ভাগিদার কেউ নেই। রোমাঞ্চ শিহরণও অনুভব করছি, আজাদীতে ছিলাম-এখনো আছি, তাই। অবস্থান বদলেছে কেবল।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধছড়া-কবিতা চর্চায় চট্টগ্রামের নারী
পরবর্তী নিবন্ধস্বর্গদুয়ার চট্টগ্রাম : ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি