স্বর্গদুয়ার চট্টগ্রাম : ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি

ড. সালমা বিনতে শফিক | বৃহস্পতিবার , ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

১. এককালে বাংলাকে বলা হত পৃথিবীর স্বর্গ আর চট্টগ্রাম ছিল সেই স্বর্গের প্রবেশদ্বার। পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, অরণ্য, খাল-বিল, হ্রদ, নদী, সাগর ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের কোলের কাছের সম্পদশালী এই জনপদের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান প্রাচীন কাল হতেই নানা জাতিগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করত। তখন চট্টগ্রামের বড় একটা অংশ হরিকেল নামে পরিচিত ছিল। শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতি, ব্যবসায়-বাণিজ্য, এবং জ্ঞানচর্চায় হরিকেল রাজ্য প্রাচীন বাংলার একটি অগ্রগামী রাজ্য ছিল বলে জানা যায়। ‘কোমল মৃত্তিকার সমৃদ্ধ অর্থনীতির বাংলার’ সঙ্গে বাণিজ্য ছিল অতি লাভজনক। সে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল সুদূর পূর্ব ইউরোপে। আজ থেকে দু’হাজার বছর আগেই গ্রীক বণিকেরা চট্টগ্রামে বাণিজ্যতরী পাঠিয়েছিল।
ভিনদেশিদের চট্টগ্রামে আগমনের এই ধারা অব্যাহত থাকে মধ্যযুগ হতে আধুনিক কাল অবধি। আরাকান হতে বৌদ্ধ, ত্রিপুরা হতে হিন্দু, আরব ও মধ্য এশিয়া হতে মুসলমান, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের নানা দেশ হতে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী ভাগ্যান্নেসিরা প্রাকৃতিক এই সমুদ্র বন্দর দিয়ে একে একে প্রবেশ করেছে বাংলায়। মসলা, মসলিন আর মুক্তোর নেশায় কর্ণফুলীর তীরে জাহাজ ভিড়িয়েছে পৃথিবীর তাবৎ দেশের বণিকরা। এ সকল জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বীদের সকলেই পায়ের চিহ্ন রেখে গিয়েছে এই শহরের বুকে, আনাচে কানাচে। কিছু চিহ্ন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে, কিছু রয়ে গেছে মহাকালের সাক্ষী হয়ে। এ পথ দিয়ে চলে যাওয়া পথিকগণের স্মৃতিচিহ্নটুকুকেই আমরা লালন করি ‘ঐতিহ্য’ বলে।
ঐতিহ্য সব সময় যে সুখের গল্প শোনায় তা নয়, যদিও ঐতিহ্যমাত্রই একটি রাষ্ট্রের, জাতিগোষ্ঠীর বা সমাজের সাংস্কৃতিক সম্পদ। ঐতিহ্য গবেষকদের মতে, ঐতিহ্য দু’রকমের হতে পারে; বস্তুগত এবং অবস্তুগত। কলা ও স্থাপত্য যেমনঃ দালানকোঠা, সৌধ, সেতু, তোরণ, মিনার, মূর্তি- এসব বস্তুগত ঐতিহ্য, অপরদিকে ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান অবস্তুগত ঐতিহ্যের অংশ।
আমরা জানি যে পশুদের জীবনযাপনে ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রয়োজন পড়েনা। কিন্তু মানবজাতির জীবনচলায় ঐতিহ্যের ভূমিকা অনেকটা আলো হাওয়ার মতো। ঐতিহ্য একদিকে আদিপিতাদের জীবনপ্রণালির সাক্ষ্য দেয়, জাতীয় গৌরব কিংবা বিষাদের গল্প শোনায় এবং অন্যদিকে মানবসন্তানের ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার প্রাণশক্তি যোগায়। সবচেয়ে বড় কথা, ইতিহাস পুনর্গঠনে ঐতিহ্য অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, যদিও আপাতদৃষ্টিতে ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অনেকটা সমার্থক বলে মনে করা হয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যকার সূক্ষ্ম পার্থক্য নির্দেশ করতে গিয়ে সুজান মার্সডেন বলেছেন, “অতীতে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনার বিশ্লেষণাত্মক (কার্যকারণ উল্লেখপূর্বক) বিবরণই ইতিহাস, তবে অতীতের যা কিছু টিকে থাকে কালের সাক্ষী হয়ে তা-ই ঐতিহ্য।”
ইতিহাস গবেষণায় ঐতিহ্য, বিশেষত বস্তুগত ঐতিহ্য খুব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত এই কারণে যে ইট, কাঠ, পাথর কখনও মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়না। লিখিত বিবরণ ক্ষেত্রবিশেষে পক্ষপাতদোষে দুষ্ট হতে পারে; লেখককে উৎকোচ প্রদান করা যেতে পারে, কিন্তু ইট পাথরকে উৎকোচ দেয়া যায়না। তাই ঐতিহ্যের প্রকারভেদের মধ্যে কলা ও স্থাপত্যের অবস্থান নিঃসন্দেহে ওপরের দিকে। অতীতের স্থপত্যিক নিদর্শন সেই সময়ের মানুষ, সমাজ এবং জাতিগত পরিচয়ের নানা দিক উন্মোচিত করে; যেমন- সেই সময়ের আর্থ সামাজিক অবস্থা, নির্মাতার মেধা ও দূরদর্শিতা। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রাচীন কালে যখন মানুষ লিখতে পড়তে শেখেনি, তখনও নির্মিত হয়েছিল বিস্ময়কর স্থাপনা যা আমাদের পূর্বপুরুষদের গভীর জ্ঞান, চিন্তাশক্তি ও রুচিবোধের পরিচয় বহন করে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, স্থাপত্য মানবসভ্যতার না-বলা গল্পকে ধারণ করে।
ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এই মেলবন্ধনে সংস্কৃতির অবস্থান কোথায়? ঐতিহ্যের অবস্তুগত উপকরণগুলোই (ভাষা, বিশ্বাস, মূল্যবোধ, রীতিনীতি, প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান) কিন্তু সংস্কৃতি বিনির্মাণ করে। পাশাপাশি খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদও সংস্কৃতিকে ধারণ করে। এছাড়া আধুনিক সমাজে সাহিত্য, সংগীত, নৃত্যকলা, চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রসহ যা কিছু বিনোদনের খোরাক যোগায়, তার সবকিছুও সংস্কৃতির অন্তর্গত। ঐতিহ্য যেমন মানবসন্তানকে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠার প্রাণশক্তি যোগায়, সংস্কৃতিও তাই। জন্মলগ্নে পশুশাবক আর মানবশিশুতে কোন তফাৎ থাকেনা। সংস্কৃতি সেই পরশপাথর, যা রক্ত মাংসের শরীরে ও মননে মূল্যবোধ, চেতনা, দায়িত্ববোধ ও সহনশীলতার সঞ্চার করে। সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য সমাজ ও জাতিগঠনে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে একতাবদ্ধ রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। একতাবদ্ধ থাকার এই বোধ থেকে জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ এবং এই প্রক্রিয়াই কালক্রমে রাষ্ট্র গঠনের ভিত তৈরি করে দেয়। অপরদিকে, সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য থেকে জন্ম নেয় ঘৃণা, সহিংসতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ যার প্রভাবে ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে পৃথিবী। একদিকে সীমাহীন অর্জনের স্মারক, অন্যদিকে ধ্বংসের কিনারায় মানবজাতি।
ওপরের কথাগুলো স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে যেমন সত্য, তেমনি সত্য আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। সাড়ে চার বিলিয়ন বছর বয়সী আমাদের পৃথিবীটাতে প্রথম মানুষ পদচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল প্রায় ছয় মিলিয়ন বছর আগে। তবে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চেতনাসমৃদ্ধ মানুষ, বিজ্ঞানীরা যাদেরকে ‘জ্ঞানী’ মানুষ বলেছেন, তাদের যাত্রা শুরু আরও অনেক পরে, মাত্র সত্তর হাজার বছর আগে। আমরা তাদেরই উত্তরাধিকার। এই জ্ঞানী মানুষদের বেশির ভাগই কোন নির্দিষ্ট ভূমিতে একটানা অনেক দিন বসবাস করেননি। বৈরি প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধের প্রক্রিয়া হিসেবে ক্রমাগত বসত বদল করেছেন, গড়েছেন নতুন বসতি, নতুন কোন ভূখণ্ডে। অজানাকে জানার নেশাও তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল তাদের, যাদেরকে ‘মন-পাগলা’ অভিধায় ভূষিত করেন কোন মরমী কবি নন, স্বয়ং বিজ্ঞানী। প্রকৃতপক্ষে অভিবাসনের ইতিহাস পৃথিবীর ইতিহাসের মতোই প্রাচীন।
আধুনিক পৃথিবীতে কে ভূমিপুত্র, কে অভিবাসী বা ভূমিদস্যু তা নিয়ে তর্ক বিতর্কে অবতীর্ণ হলে আজকের সকল আধুনিক জাতিকেই বর্তমান বাসভুমি ছেড়ে পিতৃভূমি আফ্রিকায় পাড়ি দিতে হবে। কারণ মানবজাতির আদি বাসভূমি সুদূর আফ্রিকায় এবং সেখান থেকে তার শাখা প্রশাখা নানান ধারা উপধারায় প্রবাহিত হতে হতে থিতু হয়েছে কোথাও না কোথাও, ঠিক যেমন একটি শাখা গন্তব্য খুঁজে পেয়েছে চট্টগ্রামে। অনেকেই আবার থিতু হয়নি। অভিবাসনের ধারা চলছে আজও, তবে ভিন্নমাত্রায়। মানবস্রোত অভিবাসনের সঙ্গে বয়ে নিয়ে চলে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে, বিশেষ করে ভাষা, রীতিনীতি, প্রথা ও উৎসবকে। ইতিহাস কেবল নয়, এর সাক্ষ্য দেয় বিজ্ঞানও, জিন আর জীবন-ধারা বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
২.
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ছাড়াও ভূ সংস্থান বা স্থান বিবরণ (ঃড়ঢ়ড়মৎধঢ়যু) বিবেচনায় চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অন্য জেলা বা অঞ্চলগুলোর তুলনায় একেবারেই স্বতন্ত্র। সাগর আর পাহাড়ের এমন মিতালি বাংলাদেশের আর কোথাও নেই। বাংলার ‘রুমি’ সৈয়দ আহমদুল হকের ভাষায়,
“ঞড়ি াড়রপবং ধৎব ঃযবৎব; ড়হব রং ড়ভ ঃযব ংবধ, ড়হব ড়ভ ঃযব সড়ঁহঃধরহং;ৃৃ..
চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো হিমালয়েরই শাখা প্রশাখা। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই চট্টগ্রামের ইতিহাস চট্টগ্রামের আশেপাশের অঞ্চলগুলোর সঙ্গে হাত ধরাধরি এগিয়ে চলছিল। চট্টগ্রামের ঐতিহ্য সাক্ষ্য দেয় সকল কালেই এখানে নানা জাতের মানুষের মিলনস্থল ছিল। নেই নেই করেও এই বন্দর শহরে যা কিছু সাংস্কৃতিক সম্পদ অটুট আছে, তা থেকে চট্টগ্রামের বৈচিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়। এই শহরে কেউ এসেছে বাণিজ্য করতে, কেউ বসত গড়তে, আবার কেউবা শাসন করতে। পর্তুগিজ ইতিহাসবিদ জে জে কেম্পুস বলেছেন, নানান সময়ে এই শহরে আসা মানুষরা এমন কিছু চিহ্ন রেখে গিয়েছে, যা কখনই মুছে ফেলা যাবেনা। তবে বর্তমানে দ্রুত নগরায়ণ এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে অনেক ঐতিহ্যই হুমকির মুখে পড়েছে। বিভিন্ন ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর আগমন ও নির্গমনে চট্টগ্রামের ইতিহাস বাঁক বদল করেছে বারবার। তবে প্রাচীনকাল হতেই চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, আর এই বৈচিত্রই চট্টগ্রামকে স্বতন্ত্র রেখেছে পৃথিবীর নানা শহর থেকে। যেমন প্রাচীন হরিকেল রাজ্য বৌদ্ধ অধ্যুষিত হলেও প্রচুর হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাস ছিল। এই রাজ্যে বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের পণ্ডিতগণ তর্কযুদ্ধে লিপ্ত হতেন বলে জানা যায়, যা থেকে তাঁদের প্রচুর জ্ঞান ও পরমতসহিষ্ণুতার একটা প্রোজ্জ্বল ছবিও কল্পনা করা যেতে পারে। চট্টগ্রাম একসময় স্বাধীন হিন্দু রাজ্য ত্রিপুরার অংশবিশেষ ছিল। হিন্দু অধ্যুষিত বাংলা ও বৌদ্ধ অধ্যুষিত বার্মার সীমান্তে অবস্থিত বলে দু’রাজ্যের ধারাবাহিক যুদ্ধ বিগ্রহের প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামে প্রাপ্ত হিন্দু মন্দিরের মধ্যে সীতাকুণ্ডের শম্ভুনাথ মন্দির ও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে অবস্থিত শিবমন্দিরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। খ্রিষ্টীয় নবম শতকে (মতান্তরে অষ্টম শতকে) চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন ঘটে আরবদের। তবে আরবদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য, ধর্ম প্রচার কিংবা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা নয়। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে পর্তুগীজ নাবিকরা যখন চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ভেড়ায় তখনও বন্দরে তারা অনেক আরব পতাকা দেখতে পেয়েছিল, যা থেকে অনুমান করা যায় পর্তুগীজ প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত আরব বাণিজ্য জমজমাট ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে। চট্টগ্রামের সঙ্গে প্রথম আফগান যোগসূত্র স্থপিত হয় চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝিতে। ফখরুদ্দীন মুবারক শাহের চট্টগ্রাম জয়ের (১৩৩৮-১৩৩৯) মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতার অবসান ঘটে এবং চট্টগ্রাম বাংলার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়। চট্টগ্রামে সুলতানি আমলের অনেক মুদ্রা ও শিলালিপি আবিষ্কৃত হয় এবং অসংখ্য মসজিদ ও মাজারের নিদর্শনও পাওয়া যায়। হাটহাজারী, কুমিরা, বাঁশখালী, মিরেরশরাই -এ সুলতানি আমলে নির্মিত মসজিদসমূহ সুলতানি স্থাপত্যের চিহ্ন বহন করে। ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে (১৫১৭) চট্টগ্রাম বন্দরে প্রথম পর্তুগীজ জাহাজ নোঙর ফেলে। চট্টগ্রাম বন্দরের জাঁকজমকে তারা এতই মুগ্ধ ছিল যে তারা এ বন্দরকে ‘পোর্টো গ্রান্ডে’ বা বৃহৎ বন্দর নামে অভিহিত করে। পর্তুগীজ জলদস্যুরা একদিকে নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, অপরদিকে ধর্মযাজকরা খ্রিষ্টধর্মের বাণী প্রচার করে অনেক লোককে ধর্মান্তরিত করে। উপরন্তু দেশীয় রাজ্যগুলোর আন্তঃকোন্দলের সুযোগ নিয়ে আভ্যন্তরীণ বিষয়েও তারা হস্তক্ষেপ করে এবং মাত্র দুই দশকের মাথায় চট্টগ্রামে স্থাপিত হয় পর্তুগীজ উপনিবেশ (১৫৩৬-৩৭)। ব্রিটিশ আগমনের সাথে সাথে চট্টগ্রামে পর্তুগীজ প্রাধান্যের অবসান হলেও অনেক পর্তুগীজ এখানে স্থায়ীভাবে থেকে যায়। পর্তুগীজ ঘরবাড়ি, দুর্গ ও গির্জা তাদের বসতির সাক্ষ্য দেয়। ফিরিঙ্গি বাজার আজও পর্তুগীজ বসতির চিহ্ন বহন করে এবং অনেক পর্তুগীজ বংশধরদের চট্টগ্রামে দেখা যায়, যাদের অনেকে মূলধারার সঙ্গে মিশে গেলেও পর্তুগীজ আভিজাত্য নিয়ে গৌরববোধ করে।
পর্তুগীজ প্রাধান্যের কালেই চট্টগ্রামে মুঘল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়- সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝিতে (১৬৬৬)। মুঘল প্রতিনিধি শায়েস্তা খান আরাকানি জলদস্যুদের হাত থেকে সুরক্ষার জন্য মুঘল নৌবাহিনীতে অনেক পর্তুগীজকে নিয়োগ দেন। বন্দর শহরটিকে তখন মুঘল সরকারের সদরদপ্তর হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর থেকে একে একে নির্মিত হয় অসংখ্য স্থাপনা। সুবাদার শায়েস্তা খান জনকল্যাণের স্বার্থে ফেনী থেকে চট্টগ্রামের পথে বিভিন্ন খালবিলের ওপর অন্তত ৯৯ টি সেতু নির্মাণ করেন (শিহাবুদ্দিন তালিশ)। শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খান প্রথম নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা জামে মসজিদ। কদম মোবারক মসজিদ, ওয়ালি খাঁ মসজিদ, হাজী খাঁ মসজিদ, বায়েজিদ বোস্তামি’র মাজার (সুফি সাধক বায়েজিদ বোস্তামির চট্টগ্রামে আগমনের পক্ষে ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায়না) মুঘল স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করে, যদিও বর্তমানে তাদের অধিকাংশই কর্তৃপক্ষ ও নাগরিকদের অসচেতনতা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে হুমকির মুখে।
অষ্টাদশ শতকে শেষার্ধে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতা কেন্দ্রিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধিতে
বন্দর শহর চট্টগ্রামের গুরুত্ব কমতে থাকে। তবে কলকাতা পত্তনের আগে কোম্পানির চট্টগ্রামে প্রাধান্য স্থাপনের একাধিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। নবাব সিরাজুদ্দৌলার মৃত্যুর পরও ইংরেজরা চট্টগ্রামের জমিদারি আদায়ের অনেক চেষ্টা করে এবং অবশেষে মীরজাফরের সমর্থন ও মীর কাশিমের সনদে তাদের মোক্ষলাভ হয়। চট্টগ্রামের কর্তৃত্ব বুঝে নিতে ইংরেজকে অন্তত অর্ধশতবছরের অপেক্ষা আর অনেক ছলছাতুরির আশ্রয় নিতে হয়।
অতঃপর শুরু হয় পরাধীনতার কাল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই শতাব্দীর ভয়াবহতম ভূমিকম্পে (১৭৬২) বিধ্বস্ত হয় চট্টগ্রামের জনজীবন ও ভূ-প্রকৃতি। চট্টগ্রামকে নিয়ে কোম্পানির অনেক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিত্যসঙ্গী হওয়ায় কলকাতাই নির্বাচিত হয় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে। তথাপি ফরাসীরা কুঠি নির্মাণের অনুমতি নিয়ে চট্টগ্রামের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যায়, যদিও অল্প সময়ের মধ্যে ফরাসী কুঠিরও পতন হয়। একপর্যায়ে শুরু হয় বর্মি আগ্রাসন; শুরুতে আরাকানে। আরাকানের নির্যাতিত জনগণ (অন্তত ত্রিশ-চল্লিশ হাজার) নাফ নদী পাড়ি দিয়ে টেকনাফে এসে আশ্রয় নিয়েছিল সেই ১৭৯৭-১৮০০ সালের দিকে। উদ্বাস্তু ব্যবস’াপনা ও তাদের দেখভালের জন্য পালংক্ষি উদ্বাস্তু শিবিরে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স অধিক পরিশ্রমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যান (১৭৯৯)। তাঁর স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে পালংক্ষিকে কক্সবাজার নাম দেওয়া হয়। কিন্তু উদ্বাস্তু সমস্যার কোন সুরাহাতো হয়ইনি, বরং আরাকানি বিদ্রোহী ধরার অজুহাতে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে বর্মি বাহিনী। বর্মি আক্রমণ প্রতিহত হয় কোম্পানির দক্ষতায়, কারণ তারাই তখন শাসনকর্তা। শাসনের পাশপাশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের স্মারক হিসেবে কলকারখানা, রাস্তাঘাট, সেতু নির্মাণের পাশাপাশি রেলপথের সমপ্রসারণ ও রেলব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত মহাকর্মযজ্ঞ চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দেয়।
চট্টগ্রামবাসী এতকাল কি করছিল? চুপচাপ কোম্পানির শাসন মেনে নিয়েছিল? তা নয়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সূচনায় সংঘটিত সিপাহী বিদ্রোহের ঢেউ লাগে চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রামের ‘মঙ্গল পাণ্ডে’ হাবিলদার রজব আলী তার সহযোগীদের নিয়ে কারাগার আক্রমণ, অস্ত্রাগার ও কোষাগার লুণ্ঠন করে জানান দেন সিপাহী বিদ্রোহে চট্টগ্রামের অবস্থান (১৮৫৭)। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ শতকের প্রথমার্ধে চট্টগ্রামের মাটিতেই ফোটে বিপ্লবের ফুল; সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের প্রাণের বিনিময়ে। রক্তের সিঁড়ি বেয়ে একদিন আসে স্বাধীনতা। মুক্তিসংগ্রামের দীর্ঘযাত্রায় চট্টগ্রাম বরাবরই অগ্রপথিকের ভূমিকায়।
৩.
ইতিহাস চর্চায় বড় দুর্দিন চলছে আজ, আমাদের সমাজে কেবল নয়, দেশে দেশে- সমগ্র বিশ্বে। অর্থকরী বিষয় নয় বলে শিক্ষার্থীরাও ইতিহাসের খাতায় নাম লেখাতে চায়না। এর দায় কার? কেন আমরা ইতিহাস পড়ব? শুধুই কি অতীতের ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করার জন্য? ইতিহাস কে কেবলই অতীতমুখী? নৈতিকতা ও প্রগতির সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্ক কি সাংঘর্ষিক? দর্শনের সঙ্গে ইতিহাসের সম্পর্কই বা কি ? ইতিহাস কি বিজ্ঞান নয়? চট্টগ্রামের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আলোচনায় সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া না গেলেও সংবেদনশীল পাঠক অনেক জবাব পেয়ে যাবেন।
চট্টগ্রামের ভাষা ও জীবনযাত্রায় এই জনপদে পায়ের চিহ্ন রেখে যাওয়া প্রতিটি জনগোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে। আঞ্চলিক ভাষা ‘চাটগাঁইয়া বুলি’র শব্দভাণ্ডারের সঙ্গে আরবি, আরাকানি, পর্তুগীজ, পালি ও উর্দু- হিন্দি ভাষা থেকে অনেক শব্দ প্রবেশ করেছে। খাদ্যাভ্যাসে, উৎসব আয়োজনের বৈচিত্র মনে করিয়ে দেয় কোন না কোন পূর্বসুরির কথা, যাদের হয়তো আমরা ঘৃণাই করি জাতিগত বিদ্বেষের কারণে। এইসব চিহ্ন মুছে যাবার নয়, কারণ তারা মিশে গেছে আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে।
একটা জনপদের সৌন্দর্য ও উন্নতির জন্য যা কিছু প্রাকৃতিক উপাদান আবশ্যক, প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক বেশিই ছিল চট্টগ্রামে। কিন্তু‘ আমরা তা ধরে রাখতে পারিনি। পাহাড়, পর্বত, অরণ্য, নদী, সাগর যে শহরে থাকে সেই শহরের আকাশে বিষাক্ত সীসা ভেসে বেড়ানোর কথা না, একুশ শতকের মহাউন্নয়নের যুগে এসে নর্দমার ঢেউয়ে পূর্ণবয়স্ক জলজ্যান্ত মানুষ হারিয়ে যাওয়ার কথা না। আবার মুহূর্তেই সেই হারিয়ে যাওয়া মানুষটা নির্বিকার নাগরিক সমাজের স্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়ারও কথা না। এসবই আমাদের স্বার্থান্বেষী, মানবিক বিকৃতির পরিচয় বহন করে, যার জন্ম ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিমুখীতা এবং সংস্কৃতিহীনতা হতে।
ইতিহাস বলছে লোভ, ঘৃণা, অনৈতিকতা, বিশ্বাসঘাতকতা ও ষড়যন্ত্রের ফল তাৎক্ষণিক উপাদেয় মনে হলেও সময় তার চরম প্রতিশোধ নিতে কাউকে ছাড়েনা। এই ঘৃণার সংস্কৃতি থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে আমাদের, সুন্দর আগামী আর বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার প্রয়োজনে। শিক্ষা নিতে হবে ইতিহাস থেকে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে ঐতিহ্যকে আর চর্চা করতে হবে সুস্থ ধারার সংস্কৃতির। বিপ্লবের আঁতুড়ঘর চট্টগ্রাম থেকেই আওয়াজ উঠুক দিন বদলের। ফিরে আসুক স্বর্গদুয়ার চট্টগ্রামের সেই স্বর্ণযুগ।
তথ্যসূত্র: মুহাম্মদ ইব্রাহীম, শিকড়, জিন, জীবনধারা ও ভাষার প্রবাহ : আফ্রিকা থেকে চট্টগ্রাম, ২০২১
হারুন রশীদ, উপনিবেশ চট্টগ্রাম, ৫০০ বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস, ২০২১
Shah M. Shafiqullah, Calligraphic Art in Sultanate Architecture, 2012
Shamsul Hossain, Heritage of Chittagong, A Study of the Muslim Monuments, 2006
Suniti Bhuson Qanungo, A History of Chittagong, 1988
Syed Ahmadul Huq, A Short History of Chittagong, 1949
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজাদী : সংবাদপত্র শিল্পের সাফল্যে ঐতিহাসিক রেকর্ড
পরবর্তী নিবন্ধসাংবাদিক দিদারুল আলমের পরিবারের পাশে বসুন্ধরা গ্রুপ