‘অলৌকিক কয়েন’ ও এক তারা মিয়ার প্রতারণার গল্প

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৯:১৭ পূর্বাহ্ণ

রফিকুল ইসলাম ওরফে তারা মিয়ার (৫৫) প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার দৌঁড় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকের রসায়ন বই পড়ে তিনি রপ্ত করেছেন কোন রাসায়নিকের সঙ্গে কোন রাসায়নিক মিশ্রণ করলে কী হবে! রপ্ত করা জ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করে তিনি তৈরি করেন ‘অলৌকিক কয়েন’; যার ওপর চিনি রাখলে তা গলে যায়। সাধারণ মানুষের সামনে যখন তিনি সেই ‘অলৌকিক কয়েন’ গলিয়ে দেখান; তাজ্জব বনে যান তারা। তারপর বাড়তি দামে বিক্রি করার লোভ দেখিয়ে হাতিয়ে নেন লাখ টাকা। এমন চক্রের মূলহোতাসহ তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, দলনেতা তারা মিয়ার কাছে একটা মেশিন আছে; সেটার ভেতরে বসিয়ে শুধু চাপ দিলেই কয়েন তৈরি হয়ে যায়। বাসায় সব ধরনের উপাদান থাকায় আধঘণ্টার মধ্যে এ ‘অলৌকিক কয়েন’ তৈরি করে ফেলতে পারে। গ্রেপ্তারকৃতদের থেকে ব্রিটিশ আমলের তামা ও সিরামিকের ভুয়া কয়েন, প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত কথিত পুরাতন পয়সা তৈরির ডাইস, কথিত ব্রিটিশ আমলের পয়সা, তামা, পোড়া মাটিসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং চেতনানাশক দ্রব্য তৈরির কাজে ব্যবহৃত ক্লোরফর্ম, পটাশিয়াম ক্লোরাইড, হাইড্রোজেন সালফার এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, সালফাইড্রিক এসিড, ইথানল, সালফার মনোক্লোরাইড, কস্টিক সোডা এবং কপার সালফাইড উদ্ধার করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে নগরীর পাঁচলাইশ থানাধীন বিবিরহাট এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার তিনজন হলেন দলনেতা রফিকুল ইসলাম ওরফে তারা মিয়া (৫৫) ও তার দুই সহযোগী শাহেদ আহম্মদ খান (৪৪) এবং মোহাম্মদ আলমগীর (৩৭)

উপপুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, চক্রটি কয়েন দিয়ে প্রতারণার পাশাপাশি অজ্ঞান পার্টি হিসেবেও লুট করে সাধারণের পকেটে যা কিছু থাকে। তারা ১৮৩৯ সালের তামা ও সিরামিকের ভুয়া কয়েন দেখিয়ে মানুষের বিশ্বাস অর্জন করায় যে, এটার ওপর চিনি রাখলে চিনি গলে যায় এবং কয়েনটির অলৌকিক শক্তি রয়েছে। অথচ এই কয়েন তারা নিজেরাই তৈরি করে মাত্র ১০০ থেকে ২০০ টাকা খরচায়।

তিনি আরো বলেন, শুধু এটাই নয়; গ্রেপ্তার তিনজন বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার সঙ্গেও জড়িত। তারা বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করে অনেক সময় গরু চুরি, সিএনজি টেঙি, ইজি বাইক চালককে অজ্ঞান করে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়।

তাদের মধ্যে একজন গরু চুরি করার জন্য গরুর মালিককে অজ্ঞান করতে চেতনানাশক ওষুধ খুঁজছিল। পরে সে জানতে পারে দলনেতা তারা মিয়ার বাসায় ভালো মানের চেতনানাশক ওষুধ আছে এবং সে সারাদেশেই বিভিন্ন মানুষের কাছে এসব ওষুধ সরবরাহ করে থাকে। সেই থেকে এ চক্রের একে অপরের সাথে পরিচিতি ঘটে। এরপর থেকে বিভিন্ন প্রতারণার কাজে জড়িয়ে পড়ে তারা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এসব কিছুর সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে তারা।

গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দলনেতা অষ্টম শ্রেণি পাস হলেও তার বাসা থেকে এইচএসসির কেমেস্ট্রির (রসায়ন) বই পাওয়া গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা মিয়া অষ্টম শ্রেণি পাস। তবে এইচএসসির কেমেস্ট্রির (রসায়ন) বইয়ে বিভিন্ন এসিডের নাম লেখা আছে। কোন রাসায়নিকের সঙ্গে কোন রাসায়নিক মিশ্রণ করলে কী হবে; সবই তার মুখস্ত। পাশাপাশি সে রংয়ের ব্যবসাও করে। কেমিক্যাল সম্পর্কে তার ভালো একটা ধারণা আছে। তাই তার কাছে কয়েনগুলো তৈরি করা থাকে। সারাদেশে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। তাদের চক্রের গ্রেপ্তার হওয়া শাহেদ আহম্মদ খান সিলেট থেকে এসেছেন। তার কাজ ছিল সিলেটের মানুষের কাছে এসব কয়েন বিক্রি করা। এ বিক্রির প্রেক্ষাপটে তিনি চট্টগ্রামে কিছুদিন অবস্থান করেছিলেন।

তাদের কৌশল প্রসঙ্গে উপ পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, মানুষকে বিশ্বাস করানোর জন্য মুদ্রার ভেতরে আগে থেকেই কিছু খালি জায়গা থাকে। যখন সাধারণ মানুষকে দেখায় তখন ওই কয়েনের মধ্যে কিছু কেমিক্যাল দিয়ে দেয়। ওইটার উপর যখন চিনি দেয় তখন চিনিগুলো গলে যায়। তারা সাধারণ মানুষকে জানায়, বিশ্বে এটার অনেক ডিমান্ড আছে; এটা তোমরা লাখ টাকায় বিক্রি করতে পারো। এ বিশ্বাসে মানুষও তাদের কাছ থেকে অনেক দাম দিয়ে এসব কয়েন কিনে নেয়। গ্রেপ্তারকৃতরা পাঁচ বছর ধরে এসব প্রতারণা কাজের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন।

গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে একজনের মুরগির খামার ছিল; সেটি ব্যবসাগত কারণে চলে যাওয়ায় সে এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত হয়। তারা সহজসরল মানুষকে টার্গেট করে একটা কয়েন ৫২০ হাজার; আবার ৫০ হাজার টাকাতেও বিক্রি করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রথম কিস্তির ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পেল বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধদেড় ঘণ্টা বন্ধ ছিল চট্টগ্রামের পথে ট্রেন চলাচল