অমানুষ

জুয়েল আশরাফ | শুক্রবার , ১৭ জুন, ২০২২ at ৯:১৪ পূর্বাহ্ণ

বোনারপাড়া রেলওয়ে স্টেশন। রাত এগারোটা। অনেক ভয় নিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন রহিমা খাতুন। ভিড়ের প্রতিটি মুখে কিছু খুঁজছেন। প্ল্যাটফর্মের সকলের দিকে প্রশ্নাতীত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। সম্ভবত কিছু বলার চেষ্টা করছেন, কিন্তু তারপর চুপ করে গেলেন। কিছুক্ষণ পর এক যুবকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা, একটা কথা শুনবে?
যুবকটি তার দিকে অবজ্ঞাভরা দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, না, অন্য কাউকে বলেন।
রহিমা খাতুন ভয়ে চুপ হয়ে গেলেন। ট্রেন এলো। লোকজন ছুটতে থাকে নিজ নিজ বগির দিকে। বৃদ্ধা রহিমা খাতুনও আচমকা উঠে জোরে চিৎকার করতে লাগলেন, বাবুল, বাবুল!
সমস্ত সম্ভাব্য শক্তি দিয়ে তার ব্যাগটি তুলে নিয়ে প্রতিটি বগির কাছে গিয়ে জোরে চিৎকার করে বললেন, বাবুল, বাবুল, বাবা আমার।
একটু আগে যেই যুবক রহিমা খাতুনকে এড়িয়ে গিয়েছিল, সে চুপচাপ বসে তাকে দেখল।
ট্রেন ছাড়ার পর প্ল্যাটফর্ম আবার ধীরে ধীরে আগের মতো শান্ত হয়ে আসে। বয়স্ক ভদ্রমহিলা ধীরেধীরে অস্থির, ক্লান্ত পদক্ষেপে এক জায়গায় বসলেন। যুবকটি উঠে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
বৃদ্ধা রহিমা খাতুন যুবকের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, হ্যাঁ বাবা। আমার কথাটা শোনো।
যুবকটি তার পাশে বসে বলল, বলুন।
আমার ছেলে ওই পথে গাড়িতে করে গ্রামের টিকিট নিতে গেছে।
একপাশে ইশারা করে বললেন রহিমা খাতুন। যুবক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনার ছেলে গাড়ি করে টিকিট নিতে কোথায় গেছে?
বুড়ি উত্তর দিল, বাবুল বলেছে সামনের স্টেশনে গ্রামের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। চার ঘণ্টা হয়ে গেল, এখনও সে ফিরে আসেনি।
এবার যুবকের মনে কিছুটা সন্দেহ হল। সে সহানুভূতির সুরে জিজ্ঞেস করল, আম্মা আপনার ছেলে কী করেন?
রহিমা খাতুন বললেন, খুব বড় ব্যবসায়ী। আমি তার বাড়িতে এক মাস ছিলাম।
যুবক জিজ্ঞেস করল, আপনার গ্রাম কোথায়?
রহিমা খাতুন বললেন, অনেক দূরে। ট্রেনে ওখানে পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে।
যুবক আবার জিজ্ঞেস করল, বাড়িতে আর কে কে আছে?
রহিমা খাতুন বললেন, আমি, আমার ছেলে ও মেয়ের জামাই। আমার স্বামী নেই। আমরা খুব গরীব। অনেক পরিশ্রম করে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছি।
একটু থেমে রহিমা খাতুন জিজ্ঞেস করলেন, বাবা তুমি কোথায় যাচ্ছো?
যুবক বলল, আমি এখানে কাজ করি। ছুটিতে গ্রামে যাচ্ছি।
রহিমা খাতুন আবার উদ্বিগ্ন স্বরে বললেন, কত রাত হয়ে গেল, দেখো, ওর খাবারটাও আমার কাছে রাখা হয়েছে। খিদে পেতে কতক্ষণ লাগবে জানি না।
রহিমা খাতুন কিছু খাবারের জিনিস বের করে যুবককে দেখালেন। একটি বন্ধ বাক্সে চার-পাঁচটি রুটি মোড়ানো এবং সামান্য সবজি।
পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল যুবক। সে করুণার সাথে বৃদ্ধা মহিলার দিকে তাকাল। এখনও তিনি ছেলের আসার অপেক্ষায় আছেন। বেচারি এখন পর্যন্ত বুঝতে পারেনি যে তার ছেলে তাকে এই জনাকীর্ণ অচেনা জায়গায় রেখে পালিয়ে গেছে। যুবকের ট্রেন আসতে এখনও প্রায় ঘণ্টাখানেক বাকি। বৃদ্ধাকে বললেন, আম্মা খাবার খান, রাত বারোটা বাজে।
রহিমা খাতুন বললেন, না বাবা। বাবুল আগে আসুক। সে খাবে, আমিও খাব।
ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। বৃদ্ধা তার ব্যাগটা তুলে আবার উঠে দাঁড়ালেন। লোকজন বলল, কোথায় যাচ্ছেন? এই ট্রেন এখানে থামে না।
বাবুল, ওরে বাবা, বাবুল!
আরে, উনাকে থামান! কিন্তু বোধহয় অনেক দেরি হয়ে গেছে। লোকজন ছুটে এলো। বৃদ্ধা রহিমা খাতুনের বিকৃত দেহটাকে ছড়িয়েছিটিয়ে দিল। তার জিনিসপত্র এবং খাবারও যা তার ছেলের জন্য নিরাপদে রেখেছিল, যেই ছেলে আর ফিরে আসবে না। মানুষ নানারকম কথা বলল।
কিছুক্ষণ পর যুবকের ট্রেন আসার ঘোষণা হল। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে দ্রুত ছুটে চলেছে ট্রেন। যুবকটি তার বগিতে চুপচাপ বসা। কোথাও বগিতে খুব বিখ্যাত গান লতা মঙ্গেশকর বাজছে
কী লিখি তোমায়, প্রিয়তমা তুমি ছাড়া…।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকত যে লাবণ্য ফোটে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রাণীকথা