অবশেষে স্যুয়ারেজ সিস্টেমে প্রবেশ করতে যাচ্ছে চট্টগ্রাম

জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ১৪ মার্চ ওয়াসার মতবিনিময় সেপটিক ট্যাংকের পরিবর্তে বর্জ্য যাবে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে ব্যয় হবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ১০ মার্চ, ২০২৩ at ৪:৫৭ পূর্বাহ্ণ

প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম মহানগরীকে পরিকল্পিত স্যুয়ারেজ সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। শুরু হয়েছে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। পুরো নগরীকে ছয়ভাগে ভাগ করে প্রথম পর্যায়ে অন্তত বিশ লাখ মানুষকে স্যুয়ারেজ সিস্টেমের আওতায় আনার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। হালিশহরের ১৬৩ একর ভূমির উপর দুইটি সর্বাধুনিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন এবং প্রায় ২০০ কিলোমিটার পাইপ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে স্যুয়েরেজ সিস্টেম গড়ে তোলা হচ্ছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে নগরবাসীর সম্পৃক্ততা খুবই ঘনিষ্ঠ হওয়ায় জনসচেতনতা বাড়ানোর উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তাই প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরুতে নগরবাসীর সচেতনতা বাড়াতে বিশেষ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম ওয়াসা। সভায় নগরীর ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করে স্যুয়েরেজ প্রকল্পের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হবে।

সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রামের পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম ওয়াসা গড়ে তোলা হয়। ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করা চট্টগ্রাম ওয়াসার কার্যক্রম প্রধানত: সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধ ছিল। দীর্ঘ প্রায় ৬০ বছর পর প্রথমবারের মত পয়ঃনিষ্কাশন সেবাও চালু করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা বলতে কিছু নেই। ৬০ বর্গমাইলের নগরীতে অন্তত ৭০ লাখ মানুষ বসবাস করে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষের শত শত টন পয়োবর্জ্য প্রতিদিন সরাসরি নগরীর ড্রেন হয়ে নদী ও সাগরে গিয়ে পড়ছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন বাসা বাড়ির সেপটিক ট্যাংক থাকলেও মূলত এক পর্যায়ে বর্জ্য চলে আসে নালায়। যা এলাকার পরিবেশ নষ্ট করে। শহরের ২০ হাজারেরও বেশি বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের অন্তত অর্ধেক সেপটিক ট্যাংকের নিচে ফুটো রয়েছে। যেখান দিয়ে বর্জ্য অনায়াসে ভবনের পাশের ড্রেনে এসে পড়ে। নগরীতে পয়ঃবর্জ্য সংগ্রহের কোনও ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন উৎস হতে নিঃসৃত পয়ঃবর্জ্য মূলত নগরীর সুপেয় পানির উৎস কর্ণফুলী ও হালদা নদীতে পতিত হয়।

ওয়াসার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, বর্তমানে নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ২৮৮ মিলিয়ন লিটার বর্জ্য পানি নিঃসৃত হয়ে নদীতে পড়ছে। ২০৩০ সালে এর পরিমাণ প্রতিদিন ৫১৫ মিলিয়ন লিটার হবে। এছাড়া নগরীতে প্রতিদিন প্রায় ৫৩৯ ঘনমিটার ফিক্যাল স্ল্যাজ সেপটিক ট্যাংকে জমা হচ্ছে যা আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন প্রায় ৭১৫ ঘনমিটার হবে। ফলে নদীর পানি প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে যা সার্বিক ভাবে চট্টগ্রামের পরিবেশ দূষণ করছে এবং ভবিষ্যতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সুপেয় পানি সরবরাহে সংকট সৃষ্টির শংকা রয়েছে। পরিকল্পিত কোনো স্যুয়েরেজ সিস্টেম গড়ে না ওঠায় বছরের পর বছর ধরে টয়লেটের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চট্টগ্রাম মহানগরী শূণ্যের কোটায় রয়েছে। যা ঘুরে ফিরে উন্মুক্ত মলমূত্র ত্যাগের মতো অবস্থা সৃষ্টি করছে বলেও বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এই অবস্থার অবসানে নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীকে ছয়টি ক্যাচমেন্টে ভাগ করে একটি ক্যাচমেন্টের মাধ্যমে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সর্বমোট ৩ হাজার ৮০৮ কোটি টাকার এই প্রকল্পের কাজকে তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে একটি অংশে হালিশহরের চৌচালায় দুইটি সর্বাধুনিক ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট তৈরি করা হচ্ছে। যার একটিতে পাইপ লাইনের মাধ্যমে আনা বর্জ্য প্রতিদিন নয় কোটি লিটার পরিশোধন করে পরিবেশ সম্মতভাবে সাগরে ফেলে দেয়া হবে। অপর প্ল্যান্টটি ফিক্যাল প্লাসের ( বিশেষ ধরনের গাড়িতে বাসা বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা বর্জ্য) মাধ্যমে সংগৃহীত দৈনিক ৩০০ টন বর্জ্য পরিশোধন করা যাবে।

নগরীকে ৬টি ভাগে বিভক্ত করে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পটিতে প্রথম ধাপে অন্তত ২০ লাখ মানুষকে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হবে। শুরুতে চট্টগ্রাম শহরের হালিশহর ক্যাচমেন্টভুক্ত এলাকাসমূহ ওয়ার্ড নং২২ (এনায়েত বাজার), ২৩ (উত্তর পাহাড়তলী), ২৪ (উত্তর আগ্রাবাদ), ২৫ (রামপুর), ২৬ (উত্তর হালিশহর), ২৭ (দক্ষিণ আগ্রাবাদ), ২৮ (পাঠানটুলী), ২৯ (পশ্চিম মাদারবাড়ী), ৩০ (পূর্বমাদারবাড়ী),৩১ (আলকরণ), ৩৬ (গোসাইল ডাঙ্গা), ৩৭ (উত্তরমধ্য হালিশহর) এর সম্পূর্ণ অংশ এবং ওয়ার্ড নং১১ (দক্ষিণ কাট্টলী), ১২ (সরাইপাড়া), ১৩ (পাহাড়তলী), ১৪ (লালখানবাজার), ১৫ (বাগমনিরাম), ২১ (জামালখান), ৩২ (আন্দরকিল্লা), ৩৩ (ফিরিঙ্গিবাজার), ৩৮ (দক্ষিণমধ্য হালিশহর) এর আংশিক অর্থাৎ মোট প্রায় ৩৬ বর্গ কিলোমিটার এলাকাকে পয়ঃনিষ্কাশন সেবার আওতায় আনা হচ্ছে। প্রায় ২শ’ কিলোমিটার পয়ঃপাইপ লাইন স্থাপনের আওতায় পুরো এলাকাটিকে এই ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এছাড়াও মহানগরীর যে সকল এলাকাকে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অর্থাৎ পয়ঃপাইপ লাইন স্থাপনের আওতায় আনা সম্ভব হবে না সে সকল জনগোষ্ঠির শতকরা ৪১ ভাগ নিরাপদ সেপটিক স্ল্যাজ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা সম্ভব হবে। যেখান থেকে গাড়ির মাধ্যমে বর্জ্য সংগ্রহ করে হালিশহরের ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পরিশোধন করা হবে।

প্রকল্প পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আরিফুল ইসলাম জানান, পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেয়ে স্যুয়েরেজ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা অনেক কঠিন। চট্টগ্রামে স্যুয়েরেজ সিস্টেমের প্রকল্প বাস্তবায়ন চট্টগ্রাম ওয়াসার জন্য একটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। পানির পাইপ যেখানে রাস্তা আছে সেখানে ১ দশমিক ২ মিটার বা ৪ ফুট গভীরে স্থাপন করলে হয়ে যায়। কিন্তু স্যুয়েরেজের পাইপ বসাতে হবে সর্বোচ্চ ১২ মিটার বা চল্লিশ ফুটেরও বেশি নিচে। পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় পাইপের স্তর ঠিক রাখতে নগরীর কোনও কোনও এলাকায় চল্লিশ ফুট মাটি খুঁড়েই পাইপ স্থাপন করতে হবে। এটা না করলে বর্জ্য পাইপের পরিবর্তে ম্যানহোল দিয়ে উপরে উঠে আসবে।

অত্যন্ত কঠিন এই কাজটি বাস্তবায়নে নগরবাসীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। মানুষের ঘরেও কাজ করতে হবে। এতে করে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনসচেতনতা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর এই সচেতনতা বাড়াতেই মূলতঃ আগামী ১৪ মার্চ এক মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে। নগরীর পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লু চিটাগাং বে ভিউতে অনুষ্ঠাতব্য সভায় নগরীর ৪১টি ওয়ার্ড কাউন্সিলর, মহিলা কাউন্সিলরসহ জনপ্রতিনিধি ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা এম রেজাউল করিম চৌধুরী মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। গেস্ট অব অনার থাকবেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগঠিত হয় চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ
পরবর্তী নিবন্ধবিএনপির সালাহ উদ্দিন ও ড. ইউনূস বিষয়ে যা বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী