অবশেষে এলো গ্যাস

চট্টগ্রামে রান্নার চুলা জ্বলছে শিল্প কারখানা ও সিএনজি স্টেশনে পুরোদমে আসেনি একটি এলএনজি টার্মিনাল গভীর সাগরে যেতে না পারায় দ্রুত গ্যাস পাওয়া গেছে

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ১৬ মে, ২০২৩ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামে অবশেষে গ্যাসের দেখা মিলেছে। শিল্প কারখানা বা সিএনজি স্টেশনে পুরোদমে না হলেও রান্নাঘরের চুলা জ্বলতে শুরু করেছে। ঘূর্ণিঝড় মোখার সতর্কতার মাঝে যান্ত্রিক সমস্যায় একটি এলএনজি টার্মিনাল গভীর সাগরে যেতে না পারায় চট্টগ্রামের শেষ রক্ষা হয়েছে। বিষয়টিকে শাপেবর হিসেবে দেখা হলেও পুরো সেক্টর নিয়ে সরকারের সাথে সমন্বয়হীনতার যে চিত্র ধরা পড়েছে তা নিয়ে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

বলা হয়েছে, সিএনজি খালাসের একটি টার্মিনাল আটকা পড়ার খবর সরকার জানে না। সরকারিভাবে গ্যাস আসতে দুইতিন দিন লাগবে বলে যে তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে তাতে চট্টগ্রামের লাখ লাখ মানুষের পকেট থেকে কোটি কোটি টাকা বেরিয়ে গেছে। একইসাথে চট্টগ্রামকে আমদানিনির্ভর গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল করে ফেলায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত স্বস্তি এসেছে, ঘরে ঘরে রান্না হচ্ছে। সিএনজি স্টেশন ও শিল্প কারখানায়ও সীমিত পরিসরে সরবরাহ শুরু হয়েছে।

এদিকে গ্যাস সরবরাহ করলেও কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) নির্দেশনা ছিল, কোনো সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন গ্যাস বিক্রি করতে পারবে না। তবে নির্দেশ অমান্য করে নগর ও মফস্বলের বিভিন্ন এলাকায় রিফুয়েলিং স্টেশন থেকে টেক্সিতে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এতে করে গত রাতে শহরের কিছু এলাকায় বাসায় গ্যাস আবার বন্ধ হয়ে যায়।

জানা যায়, চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগানের পুরোটাই আমদানিনির্ভর হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে সিলেট, কুমিল্লা ও ফেনী অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাস চট্টগ্রামে সরবরাহ দেয়া হলেও এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ার পর ক্রমে সিস্টেমটি পাল্টে ফেলা হয়। এলএনজি প্রবাহ শুরু হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্রের প্রাকৃতিক গ্যাস আর চট্টগ্রামে আনা হয়নি। আনার ব্যবস্থাও নেই। বর্তমানে চট্টগ্রামের গ্যাসের পুরোটাই যোগান দেয়া হচ্ছে আমদানিকৃত গ্যাস দিয়ে। এর মধ্যে দৈনিক আড়াইশ থেকে সাড়ে তিনশ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস চট্টগ্রামে সরবরাহ দেয়া হয়েছিল। ইউক্রেনরাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক সংকট এবং ডলার সংকটে মাস কয়েক আগে বিদেশের স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান কমতে থাকে। গত দুই মাস ধরে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনা পুনরায় শুরু হওয়ায় চট্টগ্রামে গ্যাসের যোগান বাড়ে। অর্থাৎ আমদানিকৃত গ্যাসের যোগান বাড়লে চট্টগ্রামে গ্যাসের প্রবাহ বাড়ে, বিদেশের বাজারে কোনো সমস্যা হলে তার ধাক্কা লাগে চট্টগ্রামের গ্যাস সেক্টরে।

আমদানিকৃত এলএনজি খালাসের জন্য মহেশখালীতে দুটি এলএনজি টার্মিনাল রয়েছে। ওই টার্মিনালে খালাস হওয়া গ্যাস ৯২ কিলোমিটার পাইপ লাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় এনে ন্যাশনাল গ্রিডে যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামের বরাদ্দকৃত গ্যাস রাখার পর বাকি গ্যাস ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে যেতে থাকে।

কেজিডিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, মহেশখালীর দুটি টার্মিনালের দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। তবে টার্মিনাল দুটি থেকে সর্বোচ্চ ৭শ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়েছে। টার্মিনাল দুটির একটির মালিকানা মার্কিন কোম্পানি এঙিলারেট এনার্জি। অপরটির মালিকানা দেশীয় কোম্পানি সামিট গ্রুপ। এই দুটি টার্মিনাল আগামী ২০৩২ ও ২০৩৩ সাল পর্যন্ত বেসরকারি কোম্পানিগুলো পরিচালনা করবে। এরপর টার্মিনাল দুটি পেট্রোবাংলাকে হস্তান্তর করা হবে।

উক্ত দুটি টার্মিনালের মধ্যে সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন টার্মিনালটিতে সম্প্রতি কিছুটা সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য ঘূর্ণিঝড় মোখার সতর্কতায় উক্ত টার্মিনাল দুটিকে গভীর সাগরে চলে যেতে বলা হয়। তবে সামিট পাওয়ারের টার্মিনালটি স্থান ত্যাগ করতে পারেনি। ওটি মহেশখালীতে অবস্থান করছিল। ঘূর্ণিঝড় মোখা এই টার্মিনালের কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। এতে করে গতকাল সকাল থেকে এই টার্মিনাল থেকে এলএনজি খালাস শুরু হয়েছে। অন্যথায় চট্টগ্রামে গ্যাস আসতে ৮/১০ দিন লেগে যেত।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সামিট গ্রুপের টার্মিনাল আটকা পড়ার ঘটনাটি চট্টগ্রামের জন্য শাপেবর হয়েছে। তবে এই টার্মিনালটি ঘাটেই আছে এবং আজ গ্যাস সরবরাহ সীমিত পরিসরে শুরু করা যাবেএই তথ্যটি যদি রোববার প্রকাশ হতো তাহলে চট্টগ্রামের মানুষের অনেক টাকা সাশ্রয় হতো। মানুষ খাবারের সংস্থান করার জন্য এলপিজি সিলিন্ডার, গ্যাসের চুলা, স্টোভ, কেরোসিন, ইনডাকশন চুলা, রাইস কুকার, কেরোসিন ইত্যাদি দ্বিগুণ, তিন গুণ দামে কিনেছে। খাবারের দোকানগুলোতে কয়েক গুণ বেশি দামে বিক্রি হয়েছে খাবার। গ্যাসের অভাবে চট্টগ্রামে গত রোববার নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল। তাতে মানুষের কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। একদিন পরই গ্যাসের প্রবাহ শুরু হবে জানতে পারলেই কেউ এমন আরাজকতার শিকার হতেন না।

সূত্রে জানা যায়, গতকাল সকালে সামিট গ্রুপের গ্যাস সরবরাহ ন্যাশনাল গ্রিডে দেয়া শুরু হয়েছে। গতকাল তারা আড়াইশ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস দিয়েছে। এর মধ্যে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট চট্টগ্রামে রেখে বাকি ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস ন্যাশনাল গ্রিডে নেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে পাওয়া ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস দিয়ে শুরুতে বাসাবাড়িতে গ্যাস সরবরাহ দেয়া হয়েছে। ক্রমে সীমিত পরিসরে শিল্প কারখানা ও সিএনজি স্টেশনগুলোতে গ্যাস দেয়া হচ্ছে। তবে শহরের অধিকাংশ সিএনজি স্টেশনে গত রাত পর্যন্ত গ্যাসের স্বাভাবিক প্রবাহ শুরু হয়নি।

কেজিডিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্যাসের প্রবাহ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সরকারিভাবে আমদানিকৃত এলএনজিবাহী জাহাজটি গভীর সাগর থেকে মহেশখালীর দিকে আসতে শুরু করেছে। আগামী দুইচার দিনের মধ্যে এই জাহাজটি থেকে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে। মহেশখালীতে একটি টার্মিনাল ঝড়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওটি পুরোপুরি অপারেশনে আসলে চট্টগ্রামের গ্যাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।

এদিকে কেজিডিসিএলের শীর্ষ কর্মকর্তারা গতকাল দিনভর বৈঠক করেছেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করেছেন। চট্টগ্রামে গ্যাসের স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনির্বাচনকালীন সরকার হলেও বিএনপির সুযোগ নেই
পরবর্তী নিবন্ধছেলের মৃত্যুর ৪ দিন পর মারা গেলেন বাবাও