অপচয় কমাতে হবে, সঞ্চয় বাড়াতে গুরুত্ব দিতে হবে

| শনিবার , ৩০ জুলাই, ২০২২ at ৫:৪৪ পূর্বাহ্ণ

মহামারির মধ্যে যুদ্ধ যে সঙ্কটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে বিশ্বকে, সেই প্রেক্ষাপটে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে ‘হিসেবি গৃহস্থের’ পথ ধরতে দেশবাসীকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্প্রতি তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে সরকারি ব্যয় কমানোর নানা পদক্ষেপ তুলে ধরার পাশাপাশি নাগরিকদের এ পরামর্শ দেন। শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সঞ্চয় করতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব সঞ্চয় বাড়ানো এবং প্রত্যেককে মিতব্যয়ী হতে হবে। আপনারা বিদ্যুৎ ঢালাওভাবে ব্যবহার করবেন না, পানি ঢালাওভাবে ব্যবহার করবেন না। অপচয় যেন না হয়। সকলেই কিছুটা কৃচ্ছ্র সাধন করে, কিছুটা সঞ্চয় করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন।’
ব্যক্তিগত পর্যায়ে সঞ্চয় বাড়ানোর মাধ্যমে জাতীয় সঞ্চয় নীতিতেও অবদান রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সকল প্রকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় তথা অপচয় কমানো, আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্য ক্রয় পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনায় মনোযোগ দিতে হবে।” সবাইকে দেশিয় পণ্য ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়া তাগিদ দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ‘কথায় কথায় বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া যাবে না। কারণ দেশে ভালো চিকিৎসা হয়।’ ইউক্রেইন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজার অস্থির গত কয়েক মাস ধরেই। এই পরিস্থিতিতে প্রায় সব পণ্যের দামই বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধকে বাংলাদেশের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে সমস্ত জিনিস বিশেষ করে আমাদের আমদানি করতে হয়, যেমন জ্বালানি তেল, গম, ভোজ্য তেল, এলএনজি, প্রত্যেকটার মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে এবং জাহাজের ভাড়াও বৃদ্ধি পেয়েছে।’ নয়টি পণ্য একই পরিমাণ আমদানিতে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তবে এই প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেখানে উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে, আমরা আমাদের উন্নয়নের গতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। এ ব্যাপারে সকলের সহযোগিতা কামনা করি।’
আসলে, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম পাগলা ঘোড়ার গতিতে বেড়ে যাওয়ায় হিমশিম খাচ্ছে স্বল্প ও মধ্যআয়ের মানুষ। ব্যয়ের সঙ্গে আয় বাড়েনি। ফলে জীবিকা নির্বাহ করতে একদিকে জীবনযাত্রার মানে লাগাম টানতে হয়েছে, অন্যদিকে হাত পড়েছে সঞ্চয়ে। পত্রিকান্তরে খবর বেরোয়, অনেকেই এখন সঞ্চয় ভেঙে সংসার খরচ মেটাচ্ছেন। এতে বর্তমান সঞ্চয়ের স্থিতি যেমন কমে যাচ্ছে, তেমনি নতুন সঞ্চয়ের গতিও হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সঞ্চয়ের স্থিতি কমেছে।
ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের (সিপিএ) এক জরিপে দেখা গেছে. ২৬ শতাংশ মানুষ এখন সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। ঋণ করে খাদ্যের পেছনে ব্যয় করছেন ৩৪ শতাংশ পরিবার। আগে এ হার আরও বেশি ছিল। সঞ্চয় কমার এই প্রবণতাকে ভালো চোখে দেখছেন না অর্থনীতিবিদরা। তাঁরা মনে করেন, সঞ্চয় কমার সবচেয়ে বড় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে জিডিপিতে। জিডিপির আকার বাড়াতে হলে সঞ্চয়ও বাড়াতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, দেশের মোট জিডিপির মধ্যে সঞ্চয়ের হার ২৪ শতাংশ। এ হার কমপক্ষে ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। যেখানে সঞ্চয় বাড়ানোর কথা। সেখানে কমছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদরা বলেন, সঞ্চয় কমে যাওয়া ভালো লক্ষণ নয়। গ্রাহকরা দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতে সঞ্চয় ভাঙলে সেটা আরও খারাপ। ভোক্তাদের ব্যয়ের সঙ্গে আয়ের মিল নেই। ফলে তারা সঞ্চয় ভাঙছে। রাতারাতি আয় বাড়ানো সম্ভব নয়। দ্রব্যমূল্য বাড়ার কারণে এমনটি হয়েছে। এখন দ্রব্যমূল্য কমাতে হবে। তাহলে ভোক্তার ব্যয় কমবে। তখন আবার সঞ্চয় বাড়তে শুরু করবে।
অর্থনীতিবিদের মতে, বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির দেশে সঞ্চয়-জিডিপির অনুপাত হওয়া উচিত কমপক্ষে ৩০-৩২ শতাংশ। তিন বছর আগেও এ অনুপাত ছিল কাঙ্ক্ষিত মাত্রার কাছাকাছি। কিন্তু পরবর্তীকালে এই অনুপাত হ্রাস হতে হতে ২৫.৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এই সময় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হলেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সঞ্চয়ে প্রবৃদ্ধি তো হয়ইনি বরং আশঙ্কাজনকভাবে তা কমে গেছে। শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব উল্লাহ তাঁর এক লেখায় বলেন, সঞ্চয়ের হার একটি দেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রধান নির্ধারক। সঞ্চয় বৃদ্ধি পেলে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা সম্ভব এবং বর্ধিত বিনিয়োগের মাধ্যমে অধিকতর হারে পণ্যসামগ্রী ও সেবা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। সামগ্রিক সঞ্চয় থেকেই বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদের জোগান আসে। এ কারণেই মতাদর্শ নির্বিশেষে সব ধরনের অর্থনীতিবিদরা সঞ্চয়ের হারের ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে