অন্তহীন ভালোবাসায় সেবার অগ্রযাত্রায় যুবসমাজ

ডা. এম.জাকিরুল ইসলাম | মঙ্গলবার , ২৩ আগস্ট, ২০২২ at ৫:২১ পূর্বাহ্ণ

২৩ শে আগস্ট ৪৯তম ‘বাংলাদেশ লিও দিবস’। আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালের ২৩শে আগস্ট লিও ইজমের শুভ সূচনা হয়। ঢাকা ধানমণ্ডি লায়ন্স ক্লাবের অভিভাবকত্বে ‘কমলাপুর লিও ক্লাব’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশে লিও আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। এই আন্দোলনের জনক এক মহান ব্যক্তিত্ব যিনি প্রথম বাংলা সবাক চলচিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর সফল র্নিমাতা ও প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন আব্দুল জব্বার খাঁন। তিনি লিওদের মাঝে বাংলাদেশের লিওইজমের জনক নামে খ্যাত। অনেক রক্ত ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি সবুজ শ্যামলীমা বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে গৌরব জনক স্থান অর্জন করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশে যুবকদের মাঝে বিরাজ করছিল অস্থিরতা ও চরম হতাশা। জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ যুব সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ও সেবার জগতে তাদের অনুপ্রাণিত করতে মনস্থ করলেন মরহুম লায়ন আব্দুল জব্বার খাঁন। মূলত তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের দেশে আন্তর্জাতিক সেবা সংগঠন লায়ন্স ক্লাবের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক যুব সেবা সংগঠন ‘লিও ক্নাব’ আত্মপ্রকাশ করে। আজকের এই দিনে আমরা সেই মহান লায়ন যাঁর মাধ্যমে আমাদের যুব সমাজ সেবার আঙিনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারছে তাঁকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি এবং সেই সাথে বাংলাদেশের লায়নইজমের জনক মরহুম লায়ন এম,আর, সিদ্দিকীকে গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। লিও শব্দের অর্থ নেতৃত্ব, অভিজ্ঞতা ও সুযোগ। লিও শব্দের আভিধানিক অর্থ সিংহ শাবক হলেও সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এর পরিচয় ভিন্নরূপ। লিও মনোগ্রামে দেখা যায় দুইটি সিংহ দুই দিকে তাকিয়ে আছে। এর অর্থ হচ্ছে একটির মাধ্যমে লিওরা তাকিয়ে থাকবে অনাগত ভবিষ্যতের দিকে যেখানে তারা প্রয়োজনে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে অন্যের দিকে। অন্যটির মাধ্যমে লিওরা স্ব-স্ব পেশায় আত্মনিয়োগ করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলবে।
লিও হওয়ার যোগ্যতা :
আপনি যদি একজন সমাজ সচেতন তরুণ কিংবা তরুণী হন এবং বয়স যদি ১২ বৎসর থেকে ৩০ বৎসরের মধ্যে থাকে অবশ্যই আপনি লিও সদস্য হবার যোগ্যতা রাখেন। আন্তর্জাতিক ভাবে লিও সদস্য দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে আলফা বা নিয়মিত সদস্য, যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বৎসর। ওমেগা বা সিনিয়র সদস্য যাদের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বৎসর। আপনাকে এই কথা অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে যে, লিও সদস্য পদ পেতে হলে আপনাকে সৎ চরিত্রবান ও সেবার মনোভাব সম্পন্ন হতে হবে এবং সমাজ রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কার্যকলাপে জড়িত থাকা যাবে না।
লিও সদস্য হওয়ার প্রক্রিয়া:
লিও হওয়ার যোগ্যতা সম্পন্ন কোনো তরুণ বা তরুণী লিও সদস্য হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে উনাকে পরিচিত কোনো লিও ক্লাবের সদস্যের সাথে যোগাযোগ করে আগ্রহ প্রকাশ করতে হবে। ঐ সদস্য উনাদের ক্লাবের নিয়মিত সভায় আগ্রহী তরুণ/ তরুণীকে নিয়ে যাবেন এবং সভায় পরিচয় করিয়ে দিয়ে উদ্দেশ্যটা জানাবেন। সভায় তিনি ঐ তরুণ/তরুণীর স্পন্সর হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিবেন। তারপর ক্লাবের নিয়ম অনুযায়ী ফরম পূরণ ও প্রয়োজনীয় ফি দিয়ে সদস্য পদ গ্রহণ করবেন।
লিও ক্লাবের মূল উদ্দেশ্য:
১৯৫৭ সালে গঠিত এভিংটন হাইস্কুল লিও ক্লাবের অভিভাবক গ্লেন সাইড লায়ন্স ক্লাব চারটি মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করার দায়িত্ব দেন। দায়িত্বগুলো হল :-
১. স্কুলের প্রশাসন ও অনুষদের সহযোগিতায় ছাত্রদের নেতৃত্বদান, পাণ্ডিত্য অর্জন, পৃথক দায়িত্ব, সততা ও অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা অর্জনে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য স্কুলের সেবা করা।
২. সমাজের অভাবগ্রস্তদের প্রতি সাড়া দিয়ে সমাজের সেবা করা।
৩. গণতন্ত্রের আদর্শ এবং সরকার ও নাগরিকদের উন্নয়নে দেশের জন্য সেবা করা।
৪. লিও সদস্যদের বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সমঝোতার বন্ধনে আবদ্ধ করা।
লিও সংগঠনের নীতিমালা:
আমি আমার বৃত্তি জীবনের মর্যাদার প্রতি আস্থাবান হবো এবং সেই লক্ষ্যে নিষ্ঠার সাথে কর্মলিপ্ত থেকে আমরা পেশাগত কাজে উৎকর্ষের জন্য সুনাম অর্জনে সচেষ্ট থাক্বো। আমি মনে রাখবো বন্ধুত্বই বন্ধুত্বের লক্ষ্য, বন্ধুত্ব কখনো কার্যসিদ্ধির মাধ্যম নয়। আমি বিশ্বাস রাখবো প্রকৃত বন্ধুত্বের মূল্য একজনের প্রতি আর একজনের উপকার বা সাহায্যর দ্বারা নিরুপিত হয় না। বরং সত্যিকার বন্ধুত্ব কিছুই দাবি করেনা এবং উপকার গ্রহণ করে শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ। একজন নাগরিক হিসাবে আমরা জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য আমি সর্বদা স্মরণ রাখবো। কথায়, কাজে ও আচরণে তাদের প্রতি আনুগত্যে আমি অটল ও অবিচল থাকবো।
দুঃস্থকে সহানুভূতি, দুর্বলকে সহায়তা ও নিঃস্বকে দান করে আমি তৃপ্ত হবো। সমালোচনার ক্ষেত্রে আমি সতর্ক ও সংযত থাকবো কিন্তু প্রশংসায় হবো উদার ও অকৃপণ, আমি গড়ে তুলবো কখনোও ভাঙবো না।
লিও জেলা ৩১৫-বি ৪: বাংলাদেশ মাল্টিপল লিও জেলা ৩১৫ এর অন্যতম সফল লিও জেলা ৩১৫ বি-৪। এই লিও জেলার অধীনে ৪৯টি লিও ক্লাব রয়েছে। নবগঠিত (১৯৯৭-৯৮) লিও সেবা বর্ষে প্রতিষ্ঠিত লিও জেলার ৩১৫-বি-৪ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে নেতৃত্ব দেন প্রাক্তন লিও WE ARE FOR EACH OTHER এর প্রবক্তা, (২০১৭-২০১৮) লায়ন্স সেবা বর্ষের সফল জেলা গভর্নর যিনি ডাক দিয়েছিলেন ‘CHILDREN FIRST ’ লায়ন মোঃ মনজুর আলম মনজু – পি.এম.জে.এফ। প্রতিষ্ঠাতা জেলা সচিব হিসাবে নেতৃত্ব দেন প্রাক্তন লিও। বর্তমান রিজিয়ন চেয়ারপার্সন হেডকোয়ার্টার লায়ন ডা. এম. জাকিরুল ইসলাম। বর্তমানে লিও জেলা ৩১৫-বি-৪ এর অধীনে ৪৯টি লিও ক্লাব এর মাধ্যমে ২০৫৭ জন লিও সদস্য /সদস্যা সেবা কর্মকাণ্ডে নিজেদের সর্বদা নিয়োজিত রেখেছেন। মাল্টিপল জেলা ৩১৫ এর অধীনে ২১৯টি লিও ক্লাব ৮৩৩৬ জন লিও সদস্য বাংলাদেশে লায়নদের সাথে সেবা কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত আছেন। বর্তমানে বিশ্বে ১৫৩ দেশে লিও ক্লাব প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বে ৭৬৮৪ টি লিও ক্লাব যার মধ্যে আলফা লিও ক্লাব ৩০৮৯ টি ও ওমেগা লিও ক্লাব ৪৫৯৫ টি এর মাধ্যমে পৃথিবীতে ১,৮১,৭৩১ জন লিও সদস্য সেবা কার্যে নিয়োজিত রয়েছেন। বর্তমান লিও সেবা বর্ষে লিও জেলাকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন লিও ইরফান মোস্তাফা। এছাড়া সদ্য প্রাক্তন সভাপতি লিও আফিফা ইসলাম। সহ সভাপতি লিও আতিক শাহরিয়ার সাদিফ, জেলা সচিব লিও ওমর ফারুক ও জেলা ট্রেজারার হিসাবে লিও মো. শওকত হোসাইন লিও জেলা ৩১৫-বি-৪ বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। লিও জেলাকে সুচারুরূপে পরিচালিত করছেন, লিও ক্লাব্‌স চেয়ারপার্সন লায়ন মো. আনিসুল হক চৌধুরী ও যুব বিনিময় চেয়ারপার্সন লায়ন নিশাত ইমরান।
লায়ন্সজেলা ৩১৫ বি-৪, বাংলাদেশ:
বর্তমান লায়ন্স সেবা বর্ষ (২০২২-২০২৩) লায়ন্স জেলা ৩১৫ বি-৪ এর বাংলাদেশ এর নেতৃত্বে রয়েছেন সম্মানিত জেলা গভর্নর ‘অন্তহীন ভালবাসায় সেবা’ শ্লোগানের প্রবক্তা ‘LOVE ALL SERVE ALL ’ লায়ন শেখ শামশুদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী- পি.এম.জে.এফ। সদ্য প্রাক্তন জেলা গভর্নর লায়ন আল সাদাত দোভাষ- পি.এম.জে.এফ, ১ম ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন এম.ডি.এম মহিউদ্দিন চৌধুরী -এম.জে.এফ, ২য় ভাইস জেলা গভর্নর লায়ন কহিনুর কামাল – এম.জে.এফ, কেবিনেট সেক্রেটারি লায়ন হাসান মাহমুদ চৌধুরী ও কেবিনেট ট্রেজারার লায়ন পারভীন মাহমুদ- এফ.সি.এ – এম.জে.এফ লায়ন্স জেলা ৩১৫-বি-৪ বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
যুব সমাজের অগ্রযাত্রা:
আমরা লিওরা জীবনের অর্ঘ্য সাজাই আশার কুসুমে, স্বপ্নের বুননিতে গড়ি অনাগত জীবনের নকশীকাঁথা। বিগত দিনের জীর্ণতার নাগপাশ ছিন্ন করে অনাগত দিনের রক্তিম সূর্যের উষ্ণ আলিঙ্গনে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রতিকূলতা অক্টোপাসের মত সহস্র বেষ্টনীতে ঘিরে আছে আমাদের যুব সমাজকে। আমাদের দৃঢ় প্রত্যয় হোক মাদকমুক্ত ও সন্ত্রাসমুক্ত যুব সমাজ প্রতিষ্ঠা করে ফুলের মত সুভাসিত জীবন গড়ি। গভীর ধ্বংস স্তুপের মাঝে দাড়িঁয়েও আমরা নির্মাণের কঠিন শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সকল আঁধার সরিয়ে আলোকিত ঝর্নাধারায় ধুঁইয়ে দিয়ে শান্তির নীলাকাশ প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হবে লিওদের। সকল ভালোর প্রতি উদাত্ত আহ্বান আর অসুন্দরের প্রতি ক্ষমাহীন সংগ্রাম আমাদের। মনে রাখতে হবে এই বিশ্বে যা কিছু ভালো তা বিশ্বের সকল মানুষের অধিকার। এই অধিকার আদায়ের নাম হোক লিওইজম। আমরা এমন একটি দিনের অপেক্ষায় আছি যেদিন স্বপ্নের পাখিরা নীড় খুঁজে পাবে, চিকিৎসাহীন মৃত্যু করবে না যখন উপহাস, দুঃস্থের মুখে হাসি আর অন্ধের চোখে আলো সেদিন থাকবে নিশ্চিত। আত্ম সচেতন ব্যক্তি ও জাতিই পারে বিশ্বের মাঝে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। এই জন্য যে উপকরণের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হচ্ছে নেতৃত্ব, অভিজ্ঞতা, মহতী উদ্যোগ ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা। আমাদের একান্ত বিশ্বাস বাংলাদেশের সোনার ছেলে মেয়ে বলে খ্যাত প্রিয় লিও ভাই বোনেরা প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সাফল্য বিশ্বের মানচিত্রে স্থায়ী রূপ দিতে সক্ষম হবেন। আমাদের লিও ভাই- বোনেরা সুশিক্ষা গ্রহণ, সৎচরিত্র গঠন ও আর্তমানবতার সেবায় অংশগ্রহণ করে আগামী দিনের আলোকিত মানুষ হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবেন।
আসুন, আমরা পরম সম্মানিত জেলা গভর্নর লায়ন শেখ শামশুদ্দিন আহমেদ সিদ্দিকী পি.এম.জে.এফ এর যুগোপযোগী ডাক ‘অন্তহীন ভালবাসায় সেবা’ স্বার্থক বাস্তবায়নের জন্য একযোগে কাজ করি এবং সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠির জন্য আত্মত্যাগ করে সুপ্রিয় লিও জেলা সভাপতি লিও ইরফান মোস্তাফার নেতৃত্বে জেলা গভর্নর এর ডাক সার্থক বাস্তবায়ন কল্পে যুবসমাজ তথা লিওদের সঠিক পথে পরিচালিত করি।
লেখক : রিজিয়ন চেয়ারপার্সন হেডকোয়ার্টার -লায়ন্স ক্লাবস্‌ ইন্টারন্যাশনাল, চিকিৎসক, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ৩২.৭২ কোটি টাকা