অটিজম কোনো রোগ নয়, এটি জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা

সাগর মল্লিক | শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

খসরু সাহেব একজন পদস্থ কর্মকর্তা। উনার দশ বছর বয়সী ছেলে জাহিন, দুরন্ত শিশু। কথায়, চলনে, বলনে ভীষণ স্মার্ট। যেকোনো পারিবারিক প্রোগ্রামে, মেধায় বা দুষ্টুমিতে জাহিন সবাইকে মাতিয়ে রাখে। একসাথে, বিভিন্ন অফিসে বিশ বছরের অধিক সময় চাকরি করার পরেও, অনেক কাছের মানুষও জানে, জাহিন খসরু সাহেবের একমাত্র পুত্র। পরবর্তীতে এক-কান, দু-কান করে জানা যায়, আয়ান নামে জাহিনের আরো এক বড় ভাই আছে, যাকে ঘরের মধ্যে শিকলবন্দী করে রাখা হয়। তথাকথিত সোশ্যাল স্ট্যাটাস বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, এভাবেই বহু আয়ান, শারীরিক বা মানসিক সীমাবদ্ধতার কারণে অবহেলিত হয়, নিগৃহীত হয়।
অপরদিকে প্রফেসর রেবেকা একজন নামকরা শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। উনার প্রথম সন্তান রাহিব, জন্মের পর ১৪ মাসের মধ্যেও, অন্যান্য শিশুদের মত সাড়া না দেওয়ায় বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যা সনাক্ত হয়। প্রফেসর রেবেকা, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হতে যেয়ে, হয়ে গেলেন শিশু বিশেষজ্ঞ। মিসেস রেবেকা, রাহিবকে নিয়ে কখনো হীনমন্যতায় ভোগেননি। বরং, রিহাবকে উনি, সকল সভা-সেমিনারে নিয়ে যান। উনি দাবি করেন, সৃষ্টিকর্তা বরং বিশেষভাবে ভালোবেসেই রাহিবকে তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন। এ জন্য তিনি নিজেকে আশীর্বাদপুষ্ট মনে করেন। (উপরোক্ত ঘটনা দুটি, বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লিখিত)
সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও ২ এপ্রিল পালিত হয় বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। এছাড়া অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তিদের সম্মানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এর দপ্তর-সংস্থা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীল বাতি জ্বালানো হবে। দিবসটি সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনগুলোও পালন করবে।
২০০৭ সালের ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ২ এপ্রিল দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২০০৮ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। অটিজম বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি ও তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
অটিজম কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতপক্ষে অটিজম কোনো রোগ নয়। এটি একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা। অটিজম এমন একটি বিকাশজনিত সমস্যা, যা হলে আক্রান্ত ব্যক্তির অন্য মানুষ বা বিষয়ের প্রতি কোনো আগ্রহ থাকে না। এছাড়া সামাজিক মিথস্ক্রিয়া, ভাষা, আবেগীয় বিষয়গুলোও পরিলক্ষিত হয় না।
এর মানে এই নয় যে, অটিস্টিক শিশু বোকা কিংবা মেধাবী নয়। বেশিরভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি ১০ জন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজনের ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে খুবই দক্ষতা থাকে। অটিস্টিক শিশুকে ঠিকমতো পরিচর্যা করতে পারলে পরবর্তী সময়ে সে অনেক গুণী কেউ একজন হয়ে উঠতে পারে। এখন তারাও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, কোনো শিশুর অটিজম নির্ণয় হলে অতিদ্রুত ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। পাশাপাশি পরিবারের সবার সচেতনতাও বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুটির সঙ্গে কথা বলার মাঝে, পড়ানোর সময়, সামাজিক বন্ধনে, খেলাধুলার মাঝেও বিভিন্ন বিষয় শেখাতে হবে। হাসি-খুশিতে রাখতে হবে সবসময়। সম্প্রতি ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)-এর এক গবেষণায় জানা গেছে, গ্রামের তুলনায় শহরে অটিস্টিক শিশু জন্মের হার বেশি। গ্রামে প্রতি ১০ হাজারে ১৪ জন এবং শহর এলাকায় প্রতি ১০ হাজারে ২৫ শিশু অটিজম বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন। মেয়ে শিশুর চাইতে ছেলে শিশুর মধ্যে অটিজমে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় আড়াই গুণ বেশি। এছাড়াও দেশে ১৬ থেকে ৩০ মাস বয়সি শিশুদের মধ্যে অটিজম বিস্তারের হার প্রতি ১০ হাজারে ১৭ জন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মতে, দেশের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির মধ্যে ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। তবে ধারণানুযায়ী বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখের মতো অটিজম আক্রান্ত মানুষ রয়েছে। প্রতি বছর তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে আরও প্রায় ১ হাজার ৫০০ শিশু। যুক্তরাষ্ট্রের অটিজম সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ অটিজম আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অটিজম কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। অটিজম মূলত মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশের প্রতিবন্ধকতাজনিত একটি মানসিক রোগ। এটি মানুষের হরমোনজনিত সমস্যার বহিঃপ্রকাশ। সর্বোপরি, অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনো জানা যায় নি। এটির প্রতীকী রং নীল। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য যেমন আলাদা; তেমনি তাদের প্রতিভাও ভিন্ন। কেউ হয়তো ভালো ছবি আঁকতে পারছে, কেউ বা নিজের কাজগুলো গুছিয়ে করতে পারে। এসবই অটিজমে আক্রান্ত শিশুর সাফল্য বলে খুশি থাকতে হবে। এই প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউসিজি) অধ্যাপক ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ বলেন, অটিজম কোনো রোগব্যাধি নয়। এটি জন্মগত স্নায়বিক দুর্বলতা। শিশুর জন্মের ২-৩ বছর বয়সের মধ্যে এটির প্রকাশ ঘটে। হাঁটা-চলা, আচার-আচরণে অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়। এক সময় অটিজম ছিল একটি অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যু। এ সম্পর্কে সমাজে নেতিবাচক ধারণা ছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা ও স্কুল সাইকোলজিস্ট সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের নিরলস প্রচেষ্টায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অটিজম বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে। তিনি ২০০৭ সালে এ বিষয়ে দেশে কাজ শুরু করেন। সায়মা ওয়াজেদ এ অবহেলিত জনস্বাস্থ্য ইস্যুতে তার বিরাট অবদানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বীকৃতি পেয়েছেন। বাংলাদেশ অটিজম ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিসঅর্ডার বিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপার্সন ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা প্যানেলের সদস্য তিনি। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল একজন প্রখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। সারাবিশ্বেই তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মনোবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি এবং ২০০২ সালে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৪ সালে স্কুল সাইকোলজির ওপর তিনি বিশেষজ্ঞ ডিগ্রি লাভ করেন। কিছুদিন পূর্বেও আমাদের দেশে অটিজম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা ছিল। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অটিজমের গুরুত্ব ও সচেতনতা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে আরও ব্যাপক আকারে কাজ করতে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘সূচনা ফাউন্ডেশন’ নামের একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। অল্পকথায় বললে তিনি বিশ্বে অটিস্টিক শিশুদের অভিভাবক। মনস্তত্ত্ববিদ সায়মা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অটিজম স্পিকস-এর পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন। তাঁর উদ্যোগেই ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অটিজমের মতো অবহেলিত একটি বিষয় নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ভারতের কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী অংশগ্রহণ করেন। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশে ‘নিউরোডেভলোপমেন্ট ডিজঅ্যাবিলিটি ট্রাস্ট অ্যাক্ট ২০১৩’ পাস করা হয়। সেই সঙ্গে তাঁর পরামর্শের ওপর ভিত্তি করেই জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বেশকিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মানসিক স্বাস্থ্য ও অটিজম নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৪ সালে সায়মা ওয়াজেদকে ‘এক্সেলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ক্যারাবলিতে অটিজম বিষয়টি তিনিই সংযুক্ত করেন। বাংলাদেশে অটিজম বিষয়ক বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে অটিজমবিষয়ক ‘শুভেচ্ছা দূত’ হিসেবে সায়মা ওয়াজেদ কাজ করছেন। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সৃষ্টিশীল নারী নেতৃত্বের ১০০ জনের তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী তনয়া সায়মা ওয়াজেদ হোসেন পুতুল। তাঁর এই অগ্রযাত্রা নিরন্তর এগিয়ে যাক।

লেখক : মাস্টার ট্রেইনার, অটিজম ও এনডিডি বিষয়ক মাস্টার
ট্রেইনার প্রশিক্ষণ কোর্স ও প্রভাষক, পটিয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে চাই
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে