হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ২ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

সুইজারল্যান্ডের চিঠি
ব্রোকেন চেয়ার এবং নির্বাসিত পাক-কূটনৈতিক-(১)
জেনেভায় গেছেন কিন্তু জাতিসংঘের সদর দফতরের সামনে যে বিশাল চত্বর সেখানে তিন-পায়া ‘ভাঙা চেয়ার’ যা ‘ব্রোকেন চেয়ার’ হিসাবে বেশি পরিচিত তা চোখে পড়েনি তা কেউ বললেও বিশ্বাস করার নয়। তিন পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা এই চেয়ার এত উঁচু যে দূর থেকে চোখে পড়বেই। কিছুতেই দৃষ্টি এড়ায় না। যারা সুইজারল্যান্ডের এই চমৎকার নগরীতে কাজে বা বেড়াতে যান, তারা এই বিশাল সাইজের ভাঙা চেয়ারের নিচে বা সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। প্যারিসের যেমন আইফেল টাওয়ার, কিংবা হল্যান্ডের উইন্ড মিল বা টিউলিপ, ঠিক তেমনি সুইজারল্যান্ডের বিশেষ করে জেনেভার এই ‘ব্রোকেন চেয়ার’। অনেকেই অবাক হয়, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ১২ মিটার উচ্চতার এই বিশালাকৃতির কাঠের নির্মিত চেয়ারের দিকে। অনেকেই উত্তর খোঁজে, জানতে চায় কেন এই স্থানটিতে বছরের পর বছর, কী বৃষ্টি, কী রোদ কিংবা বরফে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক এই চেয়ারটি। সে কাহিনীতে আসছি একটু পর। তার আগে বলে নেই আমার কেন এই নগরীতে আসা। গত ছয় মাসে এর সামনে বার তিনেক হাজির হয়েছিলাম প্রতিবাদ জানাতে। একাত্তরে হানাদার পাক সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছিল তার প্রতিবাদ জানাতে। উপস্থিত হয়েছিলেন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসী বাংলাদেশি সহ কিছু ইউরোপীয়। কেবল আমরাই নই। ভাঙা চেয়ারের সামনে উপস্থিত হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নির্যাতিত গোষ্ঠী, মানুষ নিজ দেশে তাদের সমপ্রদায়ের উপর, তাদের গোষ্ঠীর উপর রাষ্ট্রের অনিয়ম, অত্যাচারের প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদ জানান নানা দেশে ঘটে যাওয়া কিংবা চলমান গণহত্যা, ধর্ষণ, গুম, অত্যাচারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের উপর অত্যাচার, হত্যা ও হয়রানির প্রতিবাদ জানিয়েও সামপ্রতিক সময়ে এই ঐতিহাসিক স্থানটিতে আয়োজিত হয়েছে বেশ কটি মানববন্ধন, ফটো প্রদর্শনী ও প্রতিবাদ।
একাত্তরের গণহত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে এমনি এক মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজনে যোগ দেবার জন্যে গেল সপ্তাহে উপস্থিত হয়েছিলাম জেনেভায়। আয়োজক ছিল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ ফোরাম ও সুইজারল্যান্ড মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ। এর একদিন আগে ২৪ মার্চ ছিল হল্যান্ডে পৃথক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। হেগ শহরে অবস্থিত লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার হলে আয়োজিত সম্মেলনের বিষয় ছিল : একাত্তর-গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং গণহত্যা-উত্তর শান্তি। তাতে উপস্থিত হয়েছিলেন বেশ ক’জন বক্তা, বাংলাদেশ, ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন আমেরিকায় পাকিস্তানের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত হুসেইন হাক্কানি। রাষ্ট্রদূতের চাইতে তার বড় পরিচয় তিনি একজন সুবক্তা ও লেখক। দেশে-বিদেশে তার আলোচিত ও বিখ্যাত হবার কারণ, তিনি নিজ দেশ পাকিস্তানের বিশেষ করে সামরিক বাহিনী ও সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের সমালোচক। বেনজির ভুট্টো সহ পাকিস্তানের চার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ছিলেন সুদর্শন এই পাক রাষ্ট্রদূত। তার লেখা ও প্রকাশিত বইয়ের রয়েছে বিশ্বব্যাপি কাটতি। হল্যান্ডে যে সম্মেলন হয়ে গেল তাতে তাকে বক্তা হিসাবে পেলে সম্মেলনের আলোচনা যে জমে উঠবে তাতে কোন সন্দেহ ছিল না। কিন্তু প্রশ্ন হলো তার কাছে পৌঁছাই কী করে। তার সাথে কোন পরিচয় বা জানাশোনা নেই। বৃটিশ সাংবাদিক বন্ধু, ক্রিস ব্ল্যাকবার্নকে লিখে জানালাম হুসেইন হাক্কানিকে ধরা চাই। হাক্কানির সাথে ক্রিসের ছিল বন্ধুত্বের সম্পর্ক। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ক্রিস। ক্রিসকে বাংলাদেশ সরকার ২০১০ সালে ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ পুরুস্কারে সম্মানিত করে। ক্রিসের অনুরোধে হুসেইন হাক্কানি রাজি হলেন বক্তা হিসাবে হল্যান্ডের সম্মেলনে যোগ দিতে। ক্রিসের মাধ্যমে তার সাথে শুরু হলো যোগাযোগ। অভিজ্ঞ এই কূটনৈতিক স্থায়ীভাবে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনে। সমস্যা দেখা দিল তার প্লেনের টিকেটের ব্যবস্থা করতে গিয়ে। তাকে কী করে ইকোনমি ক্লাসের টিকেট অফার করি, হাজার হলেও তিনি আন্তর্জাতিকভাবে একজন সম্মানিত ব্যক্তি। অন্যদিকে বিজনেস ক্লাসের টিকেট দেই সে আর্থিক সক্ষমতাও আমাদের নেই। ক্রিসকে বলি, তুমি ম্যানেজ করতে পার কিনা দেখো। ধরেই নিয়েছিলাম তিনি রাজি হবেন না। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে ক্রিস জানালে, হুসেইন হাক্কানি রাজি হয়েছেন। আমাদের স্বস্তি ফিরে আসে। লিখলেন, তাকে ইকোনমি ক্লাসের টিকেটের দাম দিলেই হবে। পাশাপাশি এও জানালেন, তিন দিনের পরিবর্তে তিনি চারদিন হোটেলে থাকবেন এবং বাড়তি একদিনের টাকা তিনি দেবেন। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলাম, হোটেলের পুরো টাকাটা আমরা খুশি মনে দেব। পরে দেখলাম তিনি তার টিকেট ‘এয়ারমাইলজ’ দিয়ে আপগ্রেড করেছেন। কিন্তু বোধকরি আমরা বিব্রত হবো এই ভেবে সে কথা জানাননি। আমাদের মুগ্ধ হবার পালা।
কেবল আমরাই নই, মুগ্ধ হলেন সবাই, যারা তার সাথে কথা বলার সুযোগ পেয়েছেন, যারা সম্মেলনে তার বক্তব্য শুনতে পেরেছেন। এবং যা ভেবেছিলাম তাই করলেন এই বিজ্ঞ কূটনৈতিক ও লেখক। বলা যেতে পারে ‘ভিডি, ভিসি, ভেনি’। তিনি এলেন, মাত করলেন এবং জয় করলেন। একাত্তরে বাংলাদেশে পাকিস্তান যে গণহত্যা করেছে তার সমালোচনা করে সম্মেলনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, “জন্মগত সূত্রে পাকিস্তানি হিসাবে আমি মনে করি পাকিস্তানের উচিত বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। তা দুদেশের মধ্যে শান্তি ও সমপ্রীতি গড়ে উঠার জন্য সুযোগ করে দেবে। একাত্তরে যা ঘটেছে তাতে আমি অনুতপ্ত, তখন আমার বয়স মাত্র ১৪। কিন্তু আমি যদি বড় হতাম, তাহলে হয়তো আমি কিছু বলতে পারতাম। সেই সময় পাকিস্তানে হাতে গোনা কিছু প্রতিবাদ উঠেছিল। কিন্তু আমি মনে করি এই পর্যায়েও যদি পাকিস্তান পার্লামেন্ট প্রস্তাবটি পাশ করে, সেই সময়ে যাদের উপর এই নৃশংসতা সংঘটিত হয়েছিল এবং যারা সেই সময় পাকিস্তানের নাগরিক ছিলেন, তাদের কাছে ক্ষমা চাওয়া হয় তাহলে ভালো হতো। আমি বিশ্বাস করি ‘মাস এপোলোজি’ (গণ ক্ষমা) বা সম্মিলিত ক্ষমা (কালেকটিভ এপোলোজি) ট্রানজিশনাল জাস্টিসে সহায়ক হতো।” পাকিস্তানি এই কূটনৈতিক যিনি বর্তমানে নিজ জন্মভূমিতে নিরাপত্তার কারণে ফিরে যেতে পারছেন না বলেন, “আজ থেকে ৫০ বছর আগে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং যে সমস্ত আর্মি জেনারেল ও সামরিক অফিসার ছিলেন তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে মারা গেছেন। সেই ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উচিত কৃত অপরাধের দায় স্বীকার করে ক্ষমা চাওয়া এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। যেটি সব চাইতে জরুরি তা হলো এর ফলে একটি ‘ঐতিহাসিক রেকর্ড’ স্থাপন করা, যাতে এই ধরনের অন্যায় করলে বিশ্বব্যাপি নিন্দার ভয় থাকে এবং অনুরূপ অপরাধ আর ঘটবে না।”
পাকিস্তানের বিভিন্ন সামরিক জেনারেলের লেখা বই থেকে অংশ বিশেষ উল্লেখ করে এই বিজ্ঞ কূটনৈতিক বলেন, “জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল নিয়াজী, লে. জেনারেল কামাল মতিনউদ্দিন থেকে শুরু করে ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক সবাই তাদের লেখা বইয়ে একাত্তরে পাক সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বর্ণনা করেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সবাই অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে দিয়েছেন। তারা সবাই তাদের বইয়ে অন্যের উদ্ধৃতি দিয়ে সে সময়কার ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন”। হেগ শহরের লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে আয়োজিত এই সম্মেলনে আরো জনা কয়েক বক্তা থাকলেও অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়েছে উপস্থিত সবাই হুসেইন হাক্কানির বক্তব্যই শোনার জন্যে বেশি আগ্রহী। হাক্কানি অনেক দিন ধরে নিজ দেশে অনেকটা ‘পার্সন নন গ্রেটা’। নিরাপত্তার অভাবে তিনি এখন নিজ দেশে ফিরে যেতে পারছেন না। এই প্রসঙ্গে সম্মেলনের আগের দিন সন্ধ্যায় জানালেন, গেল বছর তার আপন ভাই মারা গেলে তিনি পাকিস্তানে যেতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানে তার জানাশোনা ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ তাকে নিরাপত্তার গ্যারান্টিও দিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরিবারের নিকটজনরা দেশে না-যাবার পরামর্শ দেন। তিনি নিজেও খুব একটা নিরাপদ বোধ করছিলেন না। বললেন, বলা তো যায় না, কোন কিছুতেই বিশ্বাস নেই। বিপদ যে হবে না সে গ্যারান্টি তো নেই। সম্মেলনের আগের সন্ধ্যায় ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে সম্মেলনে যোগ দেয়া বক্তাদের সাথে তাকেও বাসায় ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছিলাম। নানা বিষয় নিয়ে তার সাথে খোলামেলা আলাপ হচ্ছিল। তখনই এই সমস্ত একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলি উঠে আসে আড্ডায়। যেদিন সম্মেলন শেষ হলো সেদিন সন্ধ্যায় সবাই মিলে ডিনারে বসেছিলাম এক রেস্তোরাঁয়। পকেট থেকে আমেরিকান পাসপোর্ট বের করে আমাদের দেখিয়ে বলেন, ‘এখন আর চলাফেরা করতে ভয় পাইনে’। জানতে চেয়েছিলাম, এই যে আমেরিকার বাইরে এলেন, নিরাপদ বোধ করেন কি? তার উত্তরে তার এই বক্তব্য।
হুসেইন হাক্কানি কেন নিজ দেশ পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারেন না। সমস্যা কোথায়? পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর, বিশেষ করে গোয়েন্দা বাহিনী আই এস আই-এর সাথে হাক্কানির দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ছিল কঠিন। তিনি ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কট্টর সমালোচক। সমালোচনা করার কারণে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর মধ্যে তিনি শত্রু তৈরি করেছিলেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানি গোয়েন্দারা তাকে অপহরণ করে এবং আদালত মুক্তির আদেশ না দেয়া পর্যন্ত দুই মাস তাকে আটকে রাখে। পাক ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (আইএসআই) হুসেইন হাক্কানিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছিল, যদিও বা সফল হয়নি এবং সেনাবাহিনীর সমালোচনার কারণে তার মেয়াদকালে তাকে নিয়মিত নজরদারিতে রেখেছিল। এর পরের কাহিনী আরো চমকপ্রদ, যেন কোন গোয়েন্দা সিরিজ। সে কাহিনী লিখবো পরের সংখ্যায়। তাতে আরো লিখবো জাতিসংঘ সদর দফতরের সামনে বিশালাকৃতি ভাঙা চেয়ারের কেন এত কদর।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅটিজম কোনো রোগ নয়, এটি জন্মগত স্নায়ুবিক দুর্বলতা
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তির সংগ্রাম, গণমানুষের রক্তক্ষরণ ও অগ্রগতি