অগ্রপথিক এম এ মালেক

জাহেদুল আলম | সোমবার , ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৫১ পূর্বাহ্ণ

মোহাম্মদ আবদুল মালেক সমধিক পরিচিত এম এ মালেক নামে। সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তিনি একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। তিনি তেষট্টি বছরের প্রাচীন দৈনিক ও স্বাধীন বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম সংবাদপত্র (১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১, শুক্রবার, সকাল) দৈনিক

 

আজাদীর সম্পাদক। বর্তমানে বিরাশি বছর বয়সী এই সংবাদপত্র ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের প্রবীণতম সম্পাদক। দৈনিক আজাদীর প্রিন্টার্স লাইনে সম্পাদকের নাম এম এ মালেক বানানে মুদ্রিত থাকে। তাঁর প্রকাশিত প্রথম গ্রন্থে (উল্টো থেকে, ১৯৮৯) মুদ্রিত নাম মোহাম্মদ আবদুল মালেক। এটি এখনও তাঁর লেখক নাম।

নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে বাংলায় বা ইংরেজিতে নাম লেখার প্রচলন আমাদের সমাজে দীর্ঘদিনের। মোহাম্মদ আবদুল মালেক যখন ছাত্র (পঞ্চাশের দশকের শেষভাগে), তখন শিক্ষাসনদ প্রদান করা হতো ইংরেজিতে। তাই ইংরেজিতে লিখিত নাম Mohammad এর M এবং Abdul এর A পূর্বে যুক্ত করে

Malek পূর্ণভাবে রেখে তিনি নাম লেখেন M A Malekবাংলায় প্রতিবর্ণীকরণে হয়েছে এম এ মালেক।

জনাব এম এ মালেক চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর সম্পাদক ও প্রকাশক। দৈনিক আজাদী বাংলা ভাষায় সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রকাশিত আঞ্চলিক দৈনিক সংবাদপত্র। এম এ মালেক চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস (১৯৩০) ও কালুরঘাটে অবস্থিত আজাদী প্রিন্টার্স

(১৯৭৯)-এর স্বত্বাধিকারী। উপরোক্ত পরিচয়ে তাঁকে সবাই চেনেন। অনেকে চেনেন বাংলাদেশ অন্ধ কল্যাণ সমিতি (BNSB) ও চট্টগ্রামে অবস্থিত দেশের প্রাচীন চক্ষু চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান আই ইনফরমারি অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারএর একজন উদ্যোক্তা হিসেবে। অনেকে চেনেন চট্টগ্রামে অবস্থিত আন্তর্জাতিক মানের

চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠান ইম্পেরিয়াল হাসপাতালের অন্যতম উদ্যোক্তা হিসেবে। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে একটি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। অনেকে এম এ মালেককে চেনেন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান লায়ন্স ক্লাব, চিটাগাং ক্লাব, সিনিয়র্স ক্লাব, আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের

মাধ্যমে মানবসেবায় নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে। চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, প্রেস মালিক সমিতি, সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠনসহ অসংখ্য পেশাজীবী সংগঠনের একজন দক্ষ সংগঠক ও নেতৃত্বদানকারী হিসেবেও তাঁকে অনেকে চেনেন। আবার অনেকে চেনেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল প্রাক্তন ছাত্র সমিতি, চট্টগ্রাম কমার্স

কলেজ প্রাক্তন ছাত্র সমিতির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক সংগঠনের কাণ্ডারি হিসেবে। ত্রিশটিরও অধিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নেতৃত্বে জনাব এম এ মালেকের নাম প্রোজ্জ্বল।

অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এব্যক্তিকে বাহ্যিকভাবে রাশভারী মানুষ মনে হলেও, এই মানুষটির রয়েছে একটি সরস ও সংবেদনশীল অন্তর। মিতবাক সদা স্মিতহাস্য তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য। দীর্ঘদিন যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন, তারা জনাব এম এ মালেকের এই অনুভূতিশীল ও পরোপকারী হৃদয়ের পরিচয়

জানেন। সামান্য সময়ের জন্যও যারা তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেছেন, তারাও তাঁর এই বৈশিষ্ট্য উপলব্ধি করতে পেরেছেন।

জনাব এম এ মালেকের প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক অবদানের কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু, এসব কর্মকাণ্ডের বাইরেও তিনি সমাজে, রাষ্ট্রে ও ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। তাঁর এ ভূমিকার কথা অনেকেরই অজানা। এ নগরীতে প্রতিনিয়ত কোনো না কোনো বর্ণাঢ্য শিল্পসাহিত্যসাংস্কৃতিক

আয়োজনে জনাব এম এ মালেক আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতাসহ অন্যান্য যৌক্তিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। এসব উদ্যোগের কোনো কোনোটা সাংবাৎসরিক। বিগত ছয় দশক ধরে এসব উদ্যোগের সাথে তিনি সম্পৃক্ত। অথচ, কখনো কোনো বক্তৃতায় বা লেখায় তিনি সেসব প্রচার করেননি।

গত পাঁচ দশক এসএসসি ও এইচএসসি উত্তীর্ণ কিংবা উচ্চশিক্ষার সোপান অতিক্রমকারী কেউ না কেউ এম এ মালেক কর্তৃক আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতাপ্রাপ্ত। এদের অনেকেই জানতে পারেনি, তাকে সহযোগিতা কে করেছেন। এম এ মালেকও এসব কখনও কাউকে বলেননি। সেই শিক্ষার্থীর

অভিভাবক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই শুধু জানতে পেরেছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর এরকম একটি কার্যক্রম অনেক বছর ধরে চলমান। জনাব এম এ মালেক তাঁর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অনেকের সন্তানের শিক্ষাসহায়তা, কর্মজীবনে প্রবেশে সহযোগিতা এবং বিবাহের ব্যয় নির্বাহে আর্থিক ও

প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে থাকেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কেউ অবসরউত্তর জীবনধারণে আর্থিক সংকটে থাকলে, তাকেও তিনি প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিয়ে থাকেন।

জনাব এম এ মালেকের পিতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক (১৮৯৬১৯৬২) তৎকালীন পূর্ববঙ্গের প্রথম মুসলমান ইঞ্জিনিয়ার। ১৯১৯ সালে কলকাতার শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে তিনি তড়িৎ প্রকৌশলে স্বর্ণপদকসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সরকারি ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানিতে তড়িৎ প্রকৌশলী

পদে চাকুরিকালীন (১৯২০১৯৩০) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক চট্টগ্রাম শহরে বিদ্যুতায়নের ব্যবস্থা করেন। ১৯২৯ সালে তিনি চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর লাইব্রেরি, ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস, ১৯৫০ সালে নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন

সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা এবং ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নিজের সম্পাদনায় প্রকাশ করেন দৈনিক আজাদী। এর মাত্র দুই বছর পর ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি পরলোকগমন করেন। ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেকের কনিষ্ঠ সন্তান এবং একমাত্র পুত্র জনাব এম এ মালেক তখন স্নাতক শ্রেণির ছাত্র। বয়স মাত্র একুশ বছর।

পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে তরুণ এম এ মালেকের কাঁধে হঠাৎ এসে পড়ে যাবতীয় দায়িত্বকোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসকে সগৌরবে সচল রাখা, দৈনিক আজাদীর প্রকাশনা যথাযথভাবে অব্যাহত রাখা, পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন প্রভৃতি। যেবয়সে হাসি আনন্দ উদ্দামতা উচ্ছলতায় অবগাহন করে

জীবনের রূপ রস সৌন্দর্য আস্বাদন করার কথা, সেই বয়সে এম এ মালেক ধরলেন বিপরীত স্রোতে উজানতরির হাল। ওই বয়সে ঢেউয়ের ধাক্কাতে অনেকেই বৈঠা হারিয়ে ফেলেন, তরি থেকে বিচ্যুত হন, হারিয়ে যান অতলে কিংবা মুখ থুবড়ে পড়ে থাকেন জীবনসৈকতে। কিন্তু, এম এ মালেক শক্তহাতে বৈঠা ধরে জীবননৌকা ঢেউয়ের চূড়ায় তুলে তরতর করে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন উজানে।

এম এ মালেক যখন যে কাজে হাত দিয়েছেন, সেখানে সোনা ফলেছে। যখন যে প্রতিষ্ঠানে ও সংগঠনে সম্পৃক্ত হয়েছেন, সেই প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তাঁর নেতৃত্বগুণে আরোহন করেছে খ্যাতি ও সাফল্যের শিখরে। তারুণ্য ও যৌবনের বিশাল একটা সময় তিনি দিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা ব্যয় করেছেন

পেশাগত ও সেবামূলক কাজে। মাত্র একুশ বছর বয়সে পিতৃহারা তরুণ এম এ মালেক বিগত ষাট বছর ধরে মেধাসৃজনমনন, শ্রম, একাগ্রতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, নেতৃত্ব, ধৈর্য, অধ্যবসায় গুণে সমাজ ও দেশের জন্য রেখেছেন সীমাহীন অবদান এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাফল্য, খ্যাতি,

হিতৈষণা ব্যক্তিত্বের এক অনুকরণীয় অধিষ্ঠানে। দেশের প্রাচীনতম সংবাদপত্র এবং প্রচারসংখ্যার শীর্ষে অবস্থানকারী দৈনিক আজাদীর সম্পাদক ও প্রকাশক হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজেকে রেখেছেন প্রচারণার অন্তরালে। প্রচারবিমুখ ও নিভৃতচারী মানবহিতৈষী এম এ মালেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসির সাথে এক

সাক্ষাৎকারে বলেছেন– ‘আমি আমার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছি’। কতবড় আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি হলে একজন মানুষ নিজের সম্পর্কে এরকম কথা বলতে পারেন!

গত এক বছরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমার মৃত্যুর পর জাতীয় পতাকা দিয়ে ঢেকে আমাকে দাফন করা হবে। এমন সৌভাগ্য কয়জনের ভাগ্যে জোটে’! সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য এক বছর আগে এই দিনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান ‘একুশে পদকে’

ভূষিত করা হয় জনাব এম এ মালেককে। রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল দশটায় সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদের সভাপতিত্বে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মাধ্যমে জনাব এম এ মালেকের হাতে ভার্চুয়ালি (কোভিডজনিত কারণে) একুশে পদক

তুলে দেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। একুশে পদকপ্রাপ্তির বর্ষপূর্তিতে অভিবাদন ও অভিনন্দন গ্রহণ করুন জনাব এম এ মালেক। হে অগ্রপথিক, আমরা আপনার সুস্থ, সুন্দর, নিরোগ দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করছি।

লেখক : নাট্যকর্মী ও শিক্ষক; সম্পাদক, নাট্যমঞ্চ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিদায় প্রিয় নেতা
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রীতি