বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রীতি

পিংকু দাশ | সোমবার , ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:৫২ পূর্বাহ্ণ

সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সমাজের ঘটনা, মানুষের যাপিত জীবন, পরিবেশ, প্রকৃতি, রাজনীতি এসব কিছুই মূলত সাহিত্যের বিবেচ্য বিষয়। মানুষ তাই সাহিত্য থেকে পৃথক থাকতে পারেন না। সাহিত্যের কাছে তাকে আসতে হয়, এর ভিতরের নির্যাস তাকে গ্রহণ করতেই হয়। নিজ দেশের সাংস্কৃতিক চেতনাও তিনি ধারণ

 

 

করেন স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে রকমই একজন মানুষ, যিনি শুধু একজন রাজনীতিকই ছিলেন না, ছিলেন সাহিত্য সংস্কৃতি সচেতন একজন ব্যাক্তি। তিনি শুধু যে একটি নাম তাই নয়, সর্বোপরি তিনি একটি ইতিহাস, একটি প্রতিষ্ঠান এবং সার্বভৌম একটি রাষ্ট্রের প্রতীক। তীক্ষ্ণবুদ্ধি,

দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও মেধাবী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু একই সঙ্গে ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা। সংস্কৃতি জগতের সাথে তাঁর সম্পৃক্ততা ছিল দীর্ঘদিনের।

বাংলা, বাঙালি ও বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষে এক ও অভিন্ন । বই পড়তে ভীষণ ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু। বিশ্বসাহিত্যে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তাঁর ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহে ছিল রবীন্দ্রনাথ, নজরুলসহ বিশ্বের অনেক খ্যাতিমান সাহিত্যিকদের বই। তারমধ্যে জর্জ বার্নাড শ, রবার্ট পেইন, বার্ট্রান্ড রাসেল, কেনেডি ও মাও সেতুং অন্যতম। নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক বারট্রান্ড রাসেলের বই এতটাই প্রিয় ছিল তাঁর, যে নিজের ছোট ছেলের নাম রেখেছিলেন শেখ রাসেল।

বঙ্গবন্ধুর লেখা বিভিন্ন বই, ভাষণ ও চিঠিপত্রে সাহিত্যপ্রেমের পরিচয় পাওয়া যায়। রাজনীতির মানুষ হয়েও সাহিত্য সংস্কৃতির সব জায়গায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। যতবার জেলে গিয়েছেন, ততবার তাঁর একমাত্র সঙ্গী রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছিল তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস। তাই তিনি কথায় কথায়

রবীন্দ্রনাথের কবিতা আওড়াতেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করেছে। রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতাই বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্থ ছিল। রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন ভাষণে তিনি তাঁর প্রিয় পংক্তি ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি’– ‘বঙ্গমাতা’র এই কবিতার

চরণ অথবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে’জনপ্রিয় চরণসমূহ ব্যবহার করতেন। তাঁর লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী‘ (২০১২),’কারাগারের রোজনামচা‘(২০১৭) এবং ‘আমার দেখা নয়াচীন‘ (২০২০) প্রকাশের পর লেখক হিসেবে তিনি সুনাম অর্জন করেন দেশে বিদেশে।

বইগুলোতে লেখার অনেক অংশে তিনি বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদের কথা উদ্ধৃত করেছেন, যা তাঁর সাহিত্যপ্রেমেরই বহি:প্রকাশ।

সূর্য উঠেছে। রৌদ্রের ভিতর হাঁটাচলা করলাম। আবহাওয়া ভালোই। তবুও একই আতঙ্কইত্তেফাকের কী হবে! সময় আর কি সহজে যেতে চায়। সিপাহি, জমাদার, কয়েদি সকলের মুখে একই কথা, ইত্তেফাক কাগজ বন্ধ করে দিয়েছে। ঘরে এসে বই পড়তে আরম্ভ করলাম। এমিল জোলার লেখা ‘তেরেসা

রেকুইন’ পড়ছিলাম। সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তিনটা চরিত্রজোলা তাঁর লেখার ভিতর দিয়ে। এই বইয়ের ভিতর কাটাইয়া দিলাম দুই তিন ঘণ্টা সময়’। (‘কারাগারের রোজনামচা’ ১৮ই জুন ১৯৬৬, শনিবার)

১৯৬৯ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হয়ে পরেরদিন সোহরাওয়ার্দী ময়দানে সম্বর্ধনা সভায় দেয়া ভাষণে বাঙালি সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর ভালোবাসার উজ্জ্বল চিত্র ফুটে উঠেছে। সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা মীর্জা গালিব, সক্রেটিস, শেকসপিয়ার, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও

সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য। আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথ এর লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় লিখে বিশ্বকবি হয়েছেন। আমরা রবীন্দ্রনাথ এর বই পড়বোই, আমরা রবীন্দ্রসংগীত গাইবোই এবং রবীন্দ্রসংগীত এই দেশে গীত হবেই’।

পাকিস্তান সরকারের রবীন্দ্রনাথ বর্জনের যে প্রচেষ্টা ছিল, তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত জবাব বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন স্বাধীনতার পর ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ রবীন্দ্রনাথের এই গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচিত করে।

বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতু্‌ননেছা মুজিব এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘প্রতিবারই জেলে যাবার সময় বঙ্গবন্ধু ‘সঞ্চয়িতা’ টা হাতে তুলে নিতেন। কারাগারে নিঃসঙ্গতায় বঙ্গবন্ধুর একমাত্র সহচর ছিল ‘সঞ্চয়িতা’। বইটার গায়ে পড়েছিল জেলের সেন্সরের অনেকগুলো সিল। অনেক যত্নে রাখা সত্ত্বেও ‘সঞ্চয়িতা’র

কপিটা বহু ব্যবহারে পুরাতন হয়ে গিয়েছিল। কারাগারের মুহূর্তগুলোতে বঙ্গবন্ধু পড়াশোনা করতেন একাগ্রচিত্তে’’। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে কবি নজরুলের দেশাত্মবোধক গান মুক্তিকামী মানুষের প্রেরণার উৎস। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু গণজাগরণের কবি, সাম্যবাদী কবি নজরুলকে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির সম্মান প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর এই পদক্ষেপ তাঁর সাহিত্যপ্রীতির পরিচয় বহন করে।

বঙ্গবন্ধুর সাহিত্যপ্রেম ও সংস্কৃতিভাবনা বাঙালি চেতনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও ভালোবাসা থেকেই ১৫ই এপ্রিল ১৯৬৭ ‘কারাগারের রোজনামচা’বইয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,

আজ বাংলা নববর্ষ, ১৫ই এপ্রিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি নূরে আলম সিদ্দিকী, নূরুল ইসলামসহ আরও কয়েকজন রাজবন্দী কয়েকটা ফুল নিয়ে ২০ নং সেল ছেড়ে আমার দেওয়ানীতে এসে হাজির। আমাকে কয়েকটা গোলাপ ফুল দিয়ে নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাল’। ওই দিন বঙ্গবন্ধু আরও লেখেন, ‘আমি কারাগার থেকেই আমার দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানাই’।

এই লেখাগুলো থেকে বাংলা সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি যে বঙ্গবন্ধুর গভীর অনুরাগ ছিল তা ভালোভাবেই প্রকাশ পায়।

১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণে বঙ্গবন্ধু জাতির চিন্তাচেতনা ও মননশীলতার উৎকর্ষ সাধনে সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আজকে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, তখন সাহিত্যিক, শিল্পী ও

সংস্কৃতিসেবীদের কাছে আমার প্রত্যাশা আরও অধিক। যারা সাহিত্যসাধনা করছেন, শিল্পের চর্চা করছেন, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেবা করছেন, তাদেরকে দেশের জনগণের সঙ্গে গভীর যোগসূত্র রক্ষা করে অগ্রসর হতে হবে। দেশের জনগণের চিন্তাভাবনা, আনন্দবেদনা এবং সামগ্রিক তথ্যে তাদের জীবনপ্রবাহ আমাদের সাহিত্য ও শিল্পে অবশ্যই ফুটিয়ে তুলতে হবে।’

বঙ্গবন্ধুর শ্রেষ্ঠ পরিচয় তিনি একজন বাঙালি। বাংলার মাটি, কৃষ্টি ও মানুষের সাথে তিনি একাকার হয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক অধিবেশনে জ্ঞানগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন, যা থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যসংস্কৃতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণার একটা সুস্পষ্ট পরিচয় পাওয়া

যায়। ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘আমরা বাঙালি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমি যদি ভুলে যাই আমি বাঙালি, সেদিন আমি শেষ হয়ে যাব। আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ, বাংলার মাটি, আমার প্রাণের মাটি, বাংলার মাটিতে আমি মরবো, বাংলার কৃষ্টি, বাংলার সভ্যতা আমার কৃষ্টি

ও সভ্যতা’। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে বিশ্বের দরবারে সম্মানিত করেছেন। মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং ভালোবাসা থেকে ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে তিনি বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেছেন।

বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য ও বইপ্রেম পরিবারের মধ্যেও প্রবাহিত। শত কাজের ব্যস্ততার মাঝেও এতটুকু সময় পেলে সন্তানদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতেন। কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন পরিবারের লোকজনদের। বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিভিন্ন বক্তৃতা আর লেখনিতে

রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এর কবিতার চরণ ব্যবহার করেন। এতে করে তাঁদের মধ্যে সাহিত্যপ্রেমের দৃষ্টান্ত প্রতিফলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর সাহিত্যপ্রীতি সম্পর্কে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ বইতে লিখেছেন, ‘১৯৪৯ থেকে আব্বা যতবার জেলে গেছেন কয়েকখানা নির্দিষ্ট বই ছিল যা সবসময়

আব্বার সঙ্গে থাকত। জেলখানার বই বেশিরভাগই জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন, কিন্তু মা’র অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনো দিতেন না। সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্ররচনাবলী, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শ’র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেয়া ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন

করে রাখতেন। আব্বা জেল থেকে ছাড়া পেলেই খোঁজ নিতেন বইগুলো এনেছেন কিনা। যদিও অনেক বই জেলে পাঠানো হতো। মা প্রচুর বই কিনতেন আর জেলে পাঠাতেন। নিউ মার্কেটে মা’র সঙ্গে আমরাও যেতাম। বই পছন্দ করতাম, নিজেরাও কিনতাম। সব সময়ই বইকেনা ও পড়ার একটা রেওয়াজ আমাদের

বাসায় ছিল। প্রচুর বই ছিল। সেই বইগুলো ওরা (পাকিস্তানিরা) নষ্ট করে। বইয়ের প্রতি ওদের আক্রোশও কম না। আমার খুবই কষ্ট হয় ঐ বইগুলোর জন্য যা ঐতিহাসিক দলিল হয়ে ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে সবই হারালাম।’ বঙ্গবন্ধুর জীবন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, বঙ্গবন্ধুর সাহিত্যভাবনা আমাদের সবার জীবনে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে আজীবন।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি,

বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅগ্রপথিক এম এ মালেক
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে তিন লক্ষ টাকা জরিমানা গুনল এক যুবক