রানী গেলেন, এলেন রাজা
‘রাজা আসে রাজা যায়’- ছোটবেলা থেকে এমনটাই জেনে এসেছি। এবার গেলেন রানী, এলেন রাজা। দীর্ঘ ৭০ বছর ২১৪ দিন সিংহাসনে বসে রাজ্য (যুক্তরাজ্য ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহ) শাসন করে রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় হলেন ইংরেজ-রাজাদের মধ্যে সবচাইতে দীর্ঘমেয়াদি শাসক। রানী এলিজাবেথ মারা গেলেন গত ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, ৯৬ বছর বয়সে। আরো ১৫১ দিন বেঁচে থাকলে তার শাসনকালীন সময়কাল হতো ৭১ বছর। তবে তার চাইতে বেশি সময় ধরে রাজা ছিলেন তেমন উদাহরণ আছে। দীর্ঘ ৭২ বছর ১১০ দিন রাজ্য শাসন করে বিশ্বের সবচাইতে দীর্ঘমেয়াদি রাজা হলেন, ফ্রান্সের লুই সিক্সটিন (ষোল)। লুইয়ের মজার গল্প আমরা ছোটবেলায় পড়েছি। তিনি বলতেন, ‘আই এম দি স্টেট’ অর্থাৎ ‘আমিই রাষ্ট্র’। ১৬৪৩ সালের ১৪ মে সিংহাসনে বসে ১৭১৫ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লুই সিক্সটিন রানী এলিজাবেথের মত রাজ্য শাসন করেন। এলিজাবেথের রানী হবার কথা ছিল না। তার ভাই রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড, যার কথাও আমরা স্কুল বয়স থেকে শুনে এসেছি, প্রেমের কারণে সিংহাসন ত্যাগ করলে রানী এলিজাবেথের পিতা ষষ্ঠ জর্জ ১৯৩৬ সালে এলিজাবেথকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেন।
বাবা বলতেন যারা রাজা, রানী হন তারা খুব ভাগ্যবান, তাদের যারা দেখে তারাও ভাগ্যবান। বাবার প্রথম ধারণায় আমার তেমন দ্বিমত নেই, কিন্তু রাজা বা রানীকে যারা দেখবেন তারা ভাগ্যবান কোন যুক্তিতে সেটি ঠিকমত বুঝতে পারিনে। রানী এলিজাবেথকে দেখেছিলাম সেই একেবারে ছোটবেলায়। রানী এসেছিলেন চট্টগ্রাম। আজকের যে শিরীষ তলা বা বলা যায় সিআরবি তারই সামনে দিয়ে যে রাস্তা আগ্রাবাদ থেকে এগিয়ে এসে সার্কিট হাউজের দিকে এগিয়ে গেছে, সেই রাস্তা ধরে রানী এলিজাবেথের গাড়ি-বহর গিয়েছিল। বাবা গিয়েছিলেন তাকে দেখতে, অনেকের সাথে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। আমি, যদ্দুর মনে মনে পড়ে বাবার কোলে। রানীর চেহারার কথা মনে নেই, কিন্তু তার হাতে যে সাদা রঙের দস্তানা দেখেছি সেটির কথা এখনো বেশ মনে আছে। তখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি। সে ১৯৬১ সালের কথা। চট্টগ্রাম পূর্ব পাকিস্তানের অংশ। এরপর ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলে রানী এলিজাবেথ ১৯৮৩ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশ এসেছিলেন, সাথে তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপ। মোট চারদিন ছিলেন তারা রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে। তখন ক্ষমতায় জেনারেল এরশাদ। রানীর সফরকে ঘিরে এরশাদ-সরকার সেই সময় ঢাকাকে বেশ সাজিয়েছিলেন। তার জন্য খরচ হয়েছিল দুই মিলিয়ন ডলার। সে সময় বিশ্ব ব্যাংকের হিসাবে, গরীব দেশের তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয়। তাই কিছু সমালোচনা উঠেছিল। কিন্তু রানী বলে কথা। তার আগমনকে স্মরণীয় করে রাখা চাই। ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ঢাকামুখী ১৮ মাইল রাস্তার দু-পাশ দু-দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ শ্লোগান সহ নানা ব্যানার-ফেস্টুনে সজ্জিত করা হয়েছিল। সেই সফরে রানী গিয়েছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধতে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, ট্রেনে চেপে গিয়েছিলেন ঢাকার অদূরে, শ্রীপুরের বৈরাগিচালা গ্রামে কাছ থেকে দেখেছিলেন কী করে মুড়ি তৈরি হয়, দেখেছিলেন পুকুরে জাল ফেলে মাছ ধরার দৃশ্য।
এলিজাবেথ বাংলাদেশের রানী না হলেও এক সময় এই অঞ্চলটি তার শাসনাধীন ছিল। সেই অর্থে বলা চলে তিনি ছিলেন আমাদেরও রানী। রানীর মৃত্যুতে গোটা বৃটেন এখন শোকে ভাসছে। দশদিনব্যাপী চলছে নানা অনুষ্ঠান। তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠান হবে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর, লন্ডনে। রানীর এই দীর্ঘ শাসনকালীন সময় ছিল সুখ-দুঃখ মিলিয়ে। তাকে অনেক ঝড়-ঝাপটা পোহাতে হয়েছে। সবকিছু সয়েছেন, মোকাবেলা করেছেন নীরবে। রানীর এই যে দীর্ঘ সময় ধরে সিংহাসনে থাকা, ব্যাপারটিকে অনেকেই ভালোভাবে নিতে পারেননি। নিন্দুকেরা বলতেন, এখন তার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া উচিত তার। যেমনটি দিয়েছেন ডাচ রানী বিয়াট্রিঙ। তিনি বেশ সুস্থ-সবল থাকা অবস্থায় ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে তার বড় ছেলে প্রিন্স উইলিয়ামকে রাজার আসনে বসান। তখন তার বয়স হয়েছিল ৭৫। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন ৩৩ বছর। কেউ কেউ তাই রানী এলিজাবেথের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাকে সমালোচনা করলেও তার রাজ্যে অনেকে এই বলে প্রশ্ন তুলেছিলেন – রানী কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন? তার বড় ছেলে প্রিন্স চার্লস নিজেকে তেমন যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। তিনি অর্থাৎ বর্তমান রাজা তার বিয়ের পর তার প্রণয়িনী বর্তমানে রানী-সহচর যা ইংরেজিতে ‘কুইন স্কর্ট’ ক্যামেলিয়ার সাথে অনেকটা প্রকাশ্যে উঠাবসা, প্রেম এবং যার ফলশ্রুতিতে প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্সেস ডায়ানার বিবাহ-বিচ্ছেদ, ডায়ানার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারণে কখনোই বৃটিশ জনগণের হৃদয় ও ভালোবাসা অর্জন করতে পারেননি। তাদের অনেকেই তাকে রানী এলিজাবেথের যোগ্য উত্তরসূরি হিসাবে মেনে নেবার পক্ষে ছিলেন না। গতকালও দেখলাম এক ইংরেজ মহিলা হাতে প্ল্যাকার্ড, তাতে ইংরেজিতে লেখা- ‘তুমি আমার রাজা নও’ নিয়ে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। পুলিশ তাকে সরিয়ে নেয় এবং গ্রেপ্তার করে বলে খবরে প্রকাশ। পুলিশের এই একশনের তীব্র প্রতিবাদ দেখা দেয় বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে। তারা অভিযোগ করেন, এতে পুলিশ জনগণের মত-প্রকাশের অধিকারে বাঁধা দিচ্ছে। অন্যদিকে, রানী এলিজাবেথ যখন বয়স হওয়া সত্বেও ক্ষমতা ছাড়ছিলেন না, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন যে খোদ রানীও চাইছিলেন না প্রিন্স চার্লস আগামী দিনের রাজা হোক। অনেকে ধরে নিয়েছিলেন ডায়ানার বড় সন্তান প্রিন্স উইলিয়ামকে হয়তো রানী ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ডায়ানার সন্তান হিসাবে (যদিও বা প্রিন্স চার্লসেরও সন্তান) প্রিন্স উইলিয়াম জনগণের কাছে তার বাবার চাইতেও অনেক গ্রহণীয় ছিলেন, এখনো। যাই হোক, জনগণ চাইলেই তো হবেনা এবং হয়নি। প্রিন্স চার্লস বৃটেন ও কমনওয়েলথভুক্ত দেশের নতুন রাজা হলেন। বিগত ৭০ বছর আমরা বৃটেনে ‘রানী’ দেখেছি। আগামীতে বৃটেনে ‘রানী’ দেখার সম্ভাবনা একেবারে নেই বললেই চলে। কেননা সাত দশক বয়সের চাইতে কিছু বেশি নতুন রাজা চার্লস তৃতীয় মারা গেলে, নতুন রাজা হবেন তার বড় সন্তান প্রিন্স উইলিয়াম, উইলিয়ামের মৃত্যুর পর রাজা হবেন তার বড় সন্তান।
রানী এলিজাবেথের ক্ষমতায় থাকা সময়টা ছিল অনেক ঘটনাবহুল। বিশ্বযুদ্ধ সহ ঘরে-বাইরে অনেক ঝড়-ঝঞ্জা তাকে দেখতে হয়েছে, সামাল দিতে হয়েছে। ঘরের ভেতর দুই সন্তানের (প্রিন্স চার্লস ও প্রিন্স এন্ড্রু) কেলেঙ্কারি, ডায়ানার দুর্ঘটনায় প্রাণহানি, তার নাতী প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী ম্যাগানের রাজবাড়ি এমন কী দেশত্যাগ ইত্যাদি ঘটনা তাকে হতাশ ও ব্যথাহত করেছিল। ডায়ানার হত্যার পর তাকে জনগণের রোষে পড়তে হয়। তখন সবাই বিশ্বাস করতেন যে রানী তার নিজের চাইতে ডায়ানার জনপ্রিয়তার কারণে ঈর্ষান্বিত, যে কারণে ডায়ানার সাথে তার তেমন ভাব ছিল না। ডায়ানার ছিল ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা যা রানী এলিজাবেথের চাইতে কোন অংশে কম ছিলনা, বরঞ্চ বলা চলে বেশি। চালর্স ও ডায়ানার কলহ রাজপরিবারে বিভেদ বাড়িয়ে তোলে এবং এক সময় ডায়ানা হতাশায় ভুগতে থাকেন। বিবিসির সাথে এক একান্ত সাক্ষাৎকারে মুখে মৃদু কিন্তু সকরুণ হাসি নিয়ে প্রিন্সেস ডায়ানা বলেছিলেন, ‘এই বিয়েতে আমরা তিনজন ছিলাম, তাই একটু ভীড় ছিল’। তার স্বামী প্রিন্স চার্লসের প্রণয়িনীকে লক্ষ্য করে তার এই মন্তব্য। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি রাজবাড়ীর অনেক ভেতরের কাহিনী ফাঁস করে দিয়েছিলেন যা রাজপরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। রানী বিষয়টিকে সহজে নিতে পারেননি। আর সেখান থেকে দুজনের দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে।
সবকিছুর পরও বলতে হয় রানী এলিজাবেথ ছিলেন বৃটিশ জনগণের হৃদয়ের কাছাকাছি। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি ছিলেন বিপুল শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র। তাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল রাজপরিবার, ইংরেজ রাজতন্ত্র। কমনওয়েলকে ঐক্যবদ্ধ করার পেছনে তার ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। বিশ্বের যে সমস্ত দেশে সফরে গেছেন সেখানে পেয়েছেন আন্তরিক অভ্যর্থনা ও জনগণের ভালোবাসা। জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে। কিন্তু জীবনের শেষ সময়টুকু সেখানে থাকতে পারেননি। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের আবার্ডিনশায়ারের রাজপ্রসাদে। সেখানেই তিনি শেষ নিঃস্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর এক সপ্তাহ আগেও তিনি কাজ করেছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি বৃটেনের ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির নতুন নেতা লিজ ট্রাসকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ঘোষণা দেন স্কটল্যান্ডের এই রাজপ্রাসাদে। হাতে তখন ছড়ি। কাজ, দায়িত্ব তাকে তার শেষ বয়সেও ছাড়েনি। অমৃতপথযাত্রী রানী এলিজাবেথ দ্বিতীয় চলে গেলেন। রেখে গেলেন তার সৃষ্ট বিশাল ইতিহাস। নতুন রাজা চার্লস তৃতীয় কী ইতিহাস সৃষ্টি করেন সেটি এখন দেখার বিষয়।
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট