ভরদুপুর। একরাশ ধুলো উড়িয়ে গাড়ি এসে থামল শরতকান্দি। জাফরকে শরতকান্দি নামতে দেখে বাসের এক দঙ্গল যাত্রী অবাক হয়ে গেল। এমন কেতাদুরস্ত মানুষ তো ওরা আগে কখনও শরতকান্দি নামতে দেখেনি। ওরা গোগ্রাসে গিলে খাচ্ছে জাফরের বেশভূষা-পরিপাটি পোশাক পরিচ্ছদ। জাফরের কিন্তু সে সব দেখার মন নেই, তার চিন্তা চেতনা জুড়ে আছে শরতকান্দির কাজী বাড়ি, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু আলম ভাই এবং রাবেয়া। শরতকান্দির চৌপাশ কি এখনো তাকে মনে রেখেছে। মনে রেখেছে আবু আলম ভাই? কিংবা রাবেয়া কি এখনো সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি মনে রেখেছে।
একটা সময় ছিল তখন, যখন বোধ বিশ্বাসে শুধু মুক্তির আকুলতা ছিল, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ছিল, ছিল সোনালি দিনের প্রত্যাশা। তবে এতসব ছড়িয়েও জীবনের সুখ-দুঃখ, ঐশ্বর্য-ভালোবাসা মাথা তুলতে চায়নি-তা কি করে ভাবে জাফর। শরতকান্দির আবু আলম ভাইয়ের কমান্ডে থাকাকালীন কতো বিনিদ্র রাত কেটেছে জাফরের, আলম ভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ, যুদ্ধ জয়ের গল্প, অপারেশন ব্রিফিং এর কথাবার্তা। কাছে এসেছে রাবেয়া। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানতে চেয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের কথা, ক্যাম্পের কথা, এমনকি অপারেশনের খুঁটিনাটি। তবে জাফর একটা জিনিষ সুস্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তা হলো রাবেয়া নিজকে বার বার উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতমভাবে মেলে ধরেছে নিজকে মুক্তিযোদ্ধা জাফরের কাছে। জাফর তো তখন ছিলো অনেক দূরে।
ব্যতিক্রমী জীবনযাপনের মাঝে জাফর তখন পালিয়ে বেড়িয়েছে। তার ফেরা হয়নি আলো হাওয়ার রাজ্যে, ভালোবাসার কথকতা তখন স্বাধীন চেতনার কাছে হার মেনে আছে। জাফর তখন ভেবেছিলো সে রাবেয়ার মুখোমুখি হবে-তবে সে হবে-এক রৌদ্রকরোজ্জ্বল সোনালি স্বাধীন স্বদেশে। জাফর-আবু আলম ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবে নিজের স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে। তখন কে ফেরাবে জাফরকে? আবু আলম ভাই বা রাবেয়া তখন কি আর জাফরকে হারাতে পারবে? এবং সেই জন্য যুদ্ধজয়ের মুক্তিযোদ্ধা জাফরের শরতকান্দি আসা।
টালি দোকানে এক কাপ ধোঁয়া ওঠা চা শেষ করে যখন আলম ভাইয়ের কাজী বাড়ির দিকে পা ফেলে তখন ক’জন অতি উৎসাহী লোক দূরত্ব বজায় রেখে তার পিছু নেয়। ওরা জেনে যায় সে কাজী বাড়ি যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবু আলম ভাইয়ের কাছে। ওরা খুশিতে উদ্বেল হয় : ‘চলেন মিয়া ভাই আলম ভাইয়ের বাড়ি পৌঁছে দিই।’
পথে যেতে যেতে ওরা কত কথা বলে। তাদের গাঁও গেরামের কথা, ফসল-আসলের কথা, ওই দক্ষিণের তোতাডোবা নদীর ফি বছর ভাঙনের কথা, গাজন মেলার কথা এবং এক পর্যায়ে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা এবং তাদের প্রিয় শ্রদ্ধাভাজন মুক্তিবাহিনী কমান্ডার আবু আলম ভাইয়ের কথা।
‘তা কই কি মিয়াভাই আমাগো আবু আলম ভাই বড়ো মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিল। দ্যাশের স্বাধীনতার জন্যে কি না যুদ্ধ কইরছে। মুক্তিবাহিনীতে গেছিল বইলা মায়েরে পাকবাহিনী গুলি করল-বাড়িঘর পুড়াইয়া দিল। বোনটা পলাইয়া বাঁচল। আবু আলম ভাইয়ের কতা অহন দশ গ্রামে মাইনষের মুখে মুখে। কত জন আইয়ে তেনারে দেহনের লাই। আমরা হাটবাজারে কই কমান্ডার আবু আলম ভাই আমাগো শরতকান্দির সোনাদানা। কি মিয়াভাই ভালা কই না আমরা।’
জাফর তাদের বিশ্বাস শ্রদ্ধাবোধ দেখে অভিভূত হয়। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সার্থকতা তো এখানেই। তার পুরস্কারের এ মাত্রা তো আকাশ ছুঁয়েছে। সে কেন ঠুংকো জিনিসের করতলবন্দি হবে? আকাশ-মাটির দ্যোতনায় সে তো ভাস্বর। তার জীবনে আর কী পাওয়ার বাকি থাকে?
‘তা মিয়া ভাই দ্যাশ স্বাধীন হইল। কতা ব্যাটা কত কিছু হাতাইয়া নিল, ধুমধাম করে টাকা-পয়সা বানাইল। অই যে হালুঘাটের আলফাজ মিয়া পাক আর্মির লগে হাইটা হাইটা রাজাকার দল করল, বসনচরের হিন্দু ভাইদের ঘরবাড়ি লুটপাট করল, মাইনষেরে দেশ থাইক্যা তাড়াইল হেই ব্যাটা কি না অহন তল্লাটের নেতা-সবচেয়ে বড়ো রেশনডিলার, সরজমিনে পাকা দালান উঠাইছে। চোট্টা। কিন্তু আমাগো আলম ভাই কিছুই চাইল না। আছে ওই দিঘির পাড়ের প্রাইমারি স্কুল-পোলাপাইন-দ্যাশের মাইনষের সুখ-দুখের খবরাখবর লইয়া।’
এদের কথা শুনতে শুনতে জাফর বুঝল। হ্যাঁ তাইতো আলম ভাই এখনো দেশকে ভালোবাসে। দারিদ্র্যের নিষ্পেষণ, অস্ত্রের প্রাচুর্য, জীবনের চাকচিক্য, রাজনীতির টোপ আলম ভাইকে তার আদর্শ হতে এক চুলও নড়াতে পারেনি। ভাবতে ভীষণ ভালো লাগল জাফরের। স্বাধীন বাংলাদেশে আলম ভাইরা এখনে বেঁচে আছে। হারেনি আলম ভাইরা সমাজের পঙ্কিলতার কাছে?
কাজী বাড়ির উঠোনে পা দিতেই চমকে যায় জাফর। কাকে যেন মুখোমুখি দেখে। আবু আলম ভাই। সেই চমৎকার দীঘল আদল, চোখে ভারী চশমা, টিকালো নাক, সুদূরপ্রসারী তীক্ষ্ম দৃষ্টির অধিকারী বার নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিবাহিনী কমান্ডার আবু আলম সহাস্যে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। জাফর দেখে আশেপাশের লোকজন দ্রুত সরে যাচ্ছে আবু আলম ভাইকে দেখে। তাদের শ্রদ্ধাবোধে ভারি ভাল লাগল জাফরের।
দু’হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয় জাফরকে আবু আলম ভাই। আশপাশ কাঁপানো হাসিতে ফেটে পড়ে আলম ভাই। জাফর ভীষণ অপ্রস্তুত হয়, ভড়কে যায়। এই মুহূর্তকে কেন জানি বিশ্বাস হচ্ছে না জাফরের। আলম ভাই তাকে বুকে আঁকড়ে ধরে আছে।
‘কি, সন্দেহ গেল জাফর! আমিই তো আবু আলম। এখনো বেঁচে আছি, স্বাধীন বাংলাদেশে। চল ঘরে গিয়ে বসি।’ জাফরকে একরকম টেনে ঘরে নিয়ে বসায় আবু আলম। জাফরের সেই কতো পরিচিত ঘর। মুক্তিযুদ্ধের সময় কতো দিন কেটেছে এখানে। পাকবাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের পর আবার মেঠো দেয়াল উঠিয়েছে। দেয়ালে ফ্রেমে বাঁধা বেশ কটি ছবি। সব কটি আলম ভাইয়ের যুদ্ধের পোশাক পরা ছবি, রাবেয়ার সূচীকর্ম, একপাশে বাংলাদেশের একটি বড় ম্যাপ, রক্ত ছড়ানো।
চা-মুড়ি নিয়ে রাবেয়া আসল। সেই বছরখানেক আগেকার মতো ধীর স্থির চলন-চাউনি এখনো রাবেয়াকে জুড়ে আছে। ছোট্ট হাত তুলল। আদাব নিল জাফর। কথা শুরু হল আলম ভাইয়ের সাথে।
‘জানো জাফর আমি কিন্তু বেশ আছি। হাটবাজার, মেলা-মজলিশে সবাই মান্যগণ্য করে। সবাই পথে ঘাটে আমাকে দেখলে সমীহ করে চলে। বয়-বৈঠকে আগেভাগে ডেকে নিয়ে যায়। এত সব কম কি?’
‘কেন আলম ভাই’ আপনি সদরে যাননি যে। আপনার তো অনেক অনেক কিছু প্রাপ্য ছিল। দেশের কাছে তো আপনি আরো অনেক কিছু আশা করতে পারতেন।’
হাসেন আলম ভাই। ‘তা কি হয়? নিজের জন্য, নিজের সুখের জন্য, হারানোর পাওনা গুনে নেওয়ার জন্য যুদ্ধ করিনি জাফর, দেশের স্বাধীনতা আসেনি। যদি তা চাইতাম-দেশকে কি ছোট করা হতো না? তাহলে শহীদদের রক্ত কোথায় মর্যাদা পেল? তা বেশ আছি। ঐ প্রাইমারি স্কুলে পড়াই। ও বেলা শরতকান্দি হাটে ঘুরে ঘুরে সওদাপাতি আনি, রাবেয়া আছে। দু’ভাই বোন-গল্প গুজব করে সময় ফুরিয়ে দি। আমার কি কষ্ট? নিঃসঙ্গতা?’
সময় দ্রুত ফুরিয়ে যেতে থাকে। আলাপচারিতার মুহূর্তে, যুদ্ধের স্মৃতি রোমন্থন, কষ্ট-সৃষ্টের জীবনযাপন, বিভীষিকার রাত-অন্ধকার, বীভৎস মৃত্যু, পাক-বাহিনীর ধ্বংস-তাণ্ডব-ক্রুরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের আটপৌরে জীবন-মরণযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা এতসব নিয়ে এ গল্পে সে গল্পে দীর্ঘ সময় কেটে যেতে থাকে; কেটে যায়। শরতকান্দির রাত বাড়তে থাকে। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর দু’জনে উঠোনে চেয়ার টেনে বসল। আকাশে চমৎকার ফুটফুটে জোছনা। ওপাশের বাগান হতে হাসনাহেনার মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে। জাফর কিছু বলতে গেলে আবু আলম তাকে থামিয়ে দেয়।
‘জানো জাফর তোমরা আমার জন্য কষ্ট পাও। আমার কথা চিন্তা-ভাবনা কর। কমান্ডের ম্যালা ছেলে ছোকরা দেখা করতে আসে, খোঁজ-খবর নেয়। অনেকে ভিন্নতর প্রসঙ্গেও টেনে নিতে চায়, কিন্তু ভালোবাসা, দেশের জন্য ভালোবাসা আমার সব কিছুকে হারিয়ে দিয়ে যায়।’
‘জাফর-ভালোবাসা বড়ো দুর্বল মায়াবী শব্দ। কেউ ভালোবেসে ভুল করে কেউ ভুল করে ভালোবাসে, এই দেখোনো-দেশকে ভালোবেসে আমার কি থাকল? মাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে মারল-পুড়িয়ে দিল রাস্তায় সহায় সম্বল, রাবেয়ার শূন্য দু’হাত আমার গলায় কাল ফাঁস দিল-সুখী সুন্দর জীবনের প্রতি আমার আর স্পৃহা কোথায় থাকল? যুদ্ধ জয়ের দ্যোতনা আমি কোথায় কার কাছে প্রকাশ করি? কি যে হলো আমার? যুদ্ধ-স্বাধীনতা যুদ্ধ-জয়ের সুখ আমার সব চাওয়া আকাঙ্ক্ষাকে তো হারিয়েই দিল। আমি কি সেই আবু আলম আছি?’
জাফর চুপচাপ কান পেতে শোনে।
রাত্রে এক ফাঁকে দেখা হল রাবেয়ার সাথে। জাফর তখন ছিল বিস্রস্ত ও অবিন্যস্ততা নিয়ে। বার বার মনে পড়ছে তখনও আলম ভাইয়ের কথাগুলো।
ঠিক সে সময়ে রাবেয়াকে দেখে আরো চমকে যায় জাফর। এখানে আসার আগে কতোবার ভেবে দেখেছে, রাবেয়ার কথা আলম ভাইকে কিছু একটা বলার জন্য মোটামুটি প্রস্তুতও ছিল জাফর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত থমকে পিছিয়ে যায় জাফর। সময় নেয় রাবেয়ার কথা বলার এবং এখন সেই রাবেয়া তার মুখোমুখি।
‘ভাইজানের কথায় নিশ্চয়ই দোটানায় পড়লেন।’ রাবেয়া জাফরের চোখে চোখ রাখে।
ম্লান হাসল জাফর। রাবেয়া তাহলে সব জেনেছে এবং শুনেছেও। কিন্তু রাবেয়া তাকে বাজিয়ে দেখতে চায় কেন? ভারি দ্বন্দ্বে পড়ে যায় জাফর। ‘জানেন আমি কিন্তু ভাইজানকে হারতে দেবো না। ভাইজান এক ভিন্ন সমাজের অধীশ্বর হয়ে থাক না, তার ভালোবাসা নিয়ে-জীবনযাপন নিয়ে। তাকে কেন ফেরাতে চান আপনারা।’
থমকে যায় জাফর। এ কোন রাবেয়া। তার ভাবনায় এ কি ছেদ আনতে যাচ্ছে রাবেয়া। জাফর চুপচাপ নিস্তব্ধতা পেরিয়ে যখন বাইরে আসে তখন দেখে রাবেয়া নেই।
রাতে শুয়ে শুয়ে অনেক কথা ভাবল জাফর। আবু আলম ভাই কি হেরে যাবে? এমন একজন যুদ্ধজয়ের সৈনিক কি পারিপার্শ্বিকতার কাছে হেরে যাবে? আ্তাভিমানের দায়িত্ববোধের বৃত্ত হতে কি বেরিয়ে আসা হবে না?
নাহ্, সে আলম ভাইয়ের পাশে দাঁড়াবে। একাত্তরের যুদ্ধের দিনগুলির মতো সে আবার আলম ভাইয়ের সহযোদ্ধা হবে। আলম ভাইকে আবার তুলে ধরবে দেশের কাছে সবার কাছে জীবনের কাছে।
ভোরে আবার দেখা হল রাবেয়ার সাথে। এ যেন সেই কালরাতের রাবেয়া নয়। আলম ভাই সকালে তড়িঘড়ি করে ঘাটকূল গেছে কিছু মাছ-টাছ পাওয়া যায় কি না দেখতে।
চা আনল রাবেয়া। বসতে বলল জাফর। একথা সেকথা-অনেক কথা হল রাবেয়ার সাথে। গুছিয়ে কথা বলার অভ্যাসটা রাবেয়ার এখনও আছে। কথাবার্তার ভেতর হতে জাফর বুঝল আলম ভাইকে রাবেয়া ধরে আছে। তা না হলে আলম ভাই আবার আগের মতো হৈ চৈ করত, এ বাড়ি ও বাড়ি যেত। কিন্তু রাবেয়া-এই এক জায়গায় আলম ভাই ভারি দুর্বল। রাবেয়ার মুখোমুখি থেকেও জাফর যেন অনেক দূরে, এক ভিন্নতর জগতে। সেখানে যেন রাজ্যের হাসনাহেনার গন্ধ, কার্তিকের কুয়াশার পুরুষ্টতা, বিরতিবিহীন কোনো ছোট নদীর কুলকুল কলরব। জাফর এ আনন্দের কথা বলে কাকে? একটা স্থির সিদ্ধান্তেও এসে যায় জাফর। আলম ভাইয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবে জাফর এবং দাঁড়ায়ও। তখন সকাল দুপুর বিকেল পেরিয়ে চারদিকে রাত্রির নিস্তব্ধতা।
জাফরের কথা শুনে আলম ভাই হাসল। ‘জাফর তুমি আমায় সত্যি ভালোবাস। আমার জীবন আমাকে ফিরিয়ে দিতে তুমি এই দুদিন ভীষণ যুদ্ধ করেছ। তুমি মহা ভাঙন থেকে উঠে আসছো জাফর। তোমার ভেতরে অসংখ্য ভাঙচুর হচ্ছে জাফর।’
‘রাবেয়াও আমাকে এ নিয়ে অনেক কথা বলেছে…। রাবেয়া বড়ো ভালো মেয়ে জাফর। রাবেয়া কোনোদিন বড় সড় কোনো কিছু কোনদিন আমার কাছে চায় নি। আজ, চাইল কিন্তু। কিন্তু কি চাইল জান।’
আলম ভাইয়ের কথায় জাফর নড়েচড়ে বসল, মনে হল-সারা পৃথিবী জুড়ে একটা ভূমিধস ঘটে যাচ্ছে এবং তা শেষ পর্যন্ত শরতকান্দির কাজী বাড়ির এই ঘরের দ্বারপ্রান্তে এসে ঠেকেছে। দরজার ওপাশে কিসের খস্খস্ শব্দ। রাবেয়াও এসে দাঁড়িয়েছে তাহলে।
‘কি চাইল জানো-তোমার ভালোবাসা, তবে নিজের জন্য নয়-আমার মতো একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য।’
ভূমিধসে ছিটকে যায় জাফর। কোথায় কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে যায়। দূরে অনেক দূরে হারিয়ে যাচ্ছে-হাওয়ার উচ্ছ্বলতায় রাবেয়া। দেখে কোথায় যেনো উড়ে যাচ্ছে নীল ডানা এক পাখি।
‘জাফর আমি কি করবো? রাবেয়াকে আমি কেমন করে বোঝাই জীবন জীবনই-এখানে কিসের কাব্য? জীবন তো একটাই। এই এক জীবনের সুখ কিসের সঙ্গে অদলবদল করে নেবে রাবেয়া।
সে আমাকে হারতে দেবে না জাফর। তার ভালোবাসার হার হোক, তাতে তার বিন্দুমাত্র খেদ নেই, দুঃখ নেই। মুক্তিযোদ্ধা আবু আলম জীবনের এই ক্রান্তিকালে হারুক-সে চায় না মোটেই চায় না। আজ দুপুরে অনেক কেঁদেছে রাবেয়া। বার বার ভেবে ভেবে ব্যর্থ হয়ে হেরে গেছে রাবেয়া। তার সুখের সংজ্ঞা বদলে গেছে জাফর।’
রাত ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। প্রসঙ্গান্তরে আলম ভাই আবার সহজ সরল কথার মানুষ হয়ে উঠে। গাঁও-গেরামের মানুষ হয়ে উঠে।
খেয়েদেয়ে জাফর তার জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে শুরু করে। আবু আলম হাসে। হায়-মানুষের জীবন, ভালোবাসা। মানুষ কত সহজ কাদামাটি দিয়ে গড়া। সারারাত ছটফট করে কাটায় জাফর। রাতে আবার দেখা হয় রাবেয়ার সাথে। সেই ত্রস্ততা নেই, নিঃশঙ্ক। ‘আবার আসবেন। ভাইয়াকে হারাবার পর আপনার কথা আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়বে। তখন আমার আর কোনো পথ খোলা থাকবে না।’ সরে যায় রাবেয়া। জাফর দেখে, চলে যাচ্ছে রাবেয়া। দূরে অনেক দূরে। যুদ্ধজয়ী একজন মুক্তিযোদ্ধার আদর্শে উজ্জীবিত রাবেয়াকে এই মুহূর্তে একজন সাধারণ মেয়েমানুষ ভাবতে ভীষণ কষ্ট হয় জাফরের।
আবু আলম ভাই এখনো জাগেনি। তাকে পথে নামতে হবে। রাবেয়া তাকে আর এক জীবনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।
এগিয়ে দিতে আসে রাবেয়া। কাকভোরের ফুটিফুটি আলো। কার্তিকের হিমঝরা শিউলিঝরা উঠোন ভিজে সপসসে। পায়ের ছাপ জেগে থাকে। রাবেয়া কখন এসে জাফরের একটি হাত তুলে নেয়। রাবেয়ার দুহাত কিসের নির্ভরতা খোঁজে। খিলচরের ডাহুক যেন। জাফরের পায়ে পা ফেলে রাবেয়া। আকাশ, মাটি, প্রকৃতি এক ভিন্নতর রহস্যময় খেলায় মেতে উঠে। দক্ষিণের তোতাডোবা নদীর কূল ঘেঁষা কাশফুলের মৌ মৌ ঘ্রাণ ছাড়িয়ে পড়ে শরতকান্দির আকাশে বাতাসে। আবার একে অপরের মুখোমুখি হয় আবু আলম, জাফর, রাবেয়া, আর এক যুদ্ধে তারা জড়িয়ে পড়ে।