সৌন্দর্যবর্ধনের নামে নগরের বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ‘ধ্বংসে’ যে চুক্তি হয়েছে তা বাতিল করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। অবশ্য উদ্যানটিতে বর্তমানে ২০ টি দোকান রয়েছে তা অপসারণ করা হবে না। এক্ষেত্রে চসিকের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে তিন বছরের জন্য দোকানগুলো বরাদ্দ দিয়ে ভাড়া আদায় করা হবে। তবে নতুন করে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা হবে না। পুরো উদ্যানকে ‘গ্রীন পার্ক’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এছাড়া সেখানে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের যে স্মৃতি রয়েছে তা সংরক্ষণ করা হবে।
জানা গেছে, চসিকের কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠন করে দেয়া ২১ সদস্যের একটি কমিটির সভা হওয়ার কথা রয়েছে আগামী সোমবার। ওই সভায় চুক্তি বাতিলসহ বিপ্লব উদ্যানকে ঘিরে গৃহীত চসিকের সিদ্ধান্তগুলোর চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হবে। বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, যে চুক্তির মাধ্যমে বিপ্লব উদ্যানের সবুজ ধ্বংস করা হয়েছ, সেটা বাতিল করব। সমস্ত অসম চুক্তি এবং যেগুলো দুর্নীতি করে হয়েছে তা বাতিল করে দেব। নতুন করে দোকান করার জন্য যে কনস্ট্রাকশন করেছে সেগুলো ভেঙে ফেলা হবে। নতুন কোনো দোকান নির্মাণ করা হবে না। উদ্যানে বিদ্যমান দোকানের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, সেগুলো নিয়ে আসলে কিছু করার নেই। আগের মেয়ররা করেছেন। ওসব দোকান থেকে কর্পোরেশন আর্থিকভাবে লাভবান হয় না। এক লাখ টাকার মতো পেয়ে থাকে। তাই পূর্বের চুক্তি বাতিল করে বিদ্যমান দোকানগুলো থেকে কর্পোরেশনের আয় বৃদ্ধির চিন্তা করছি আমরা। সেক্ষেত্রে তাদের তিন বছর মেয়াদ দিয়ে ভাড়া আদায় করবে কর্পোরেশন। এতে কর্পোরেশন লাভবান হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, ওখানে শহীদ জিয়ার কিছু স্মৃতি আছে। সেটা সংরক্ষণ করা হবে। যে ইতিহাসটা মানুষ ভুলে যাচ্ছে সেটা একপাশে লেখা থাকবে। যাতে তরুণ প্রজন্ম সেটা জানতে পারে। তবে পুরো বিপ্লব উদ্যানকে গ্রীন পার্ক করা হবে। সবুজের সমারোহ হবে সেটি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান আশিক ইমরান আজাদীকে বলেন, নতুন স্থাপনা নির্মাণ না করার বিষয়ে স্থপতি ইনস্টিটিউট এর পক্ষ থেকে আমরা শুরু থেকেই সোচ্চার ছিলাম। এখন মেয়র মহোদয় নতুন করে স্থাপনা নির্মাণ না করার যে উদ্যোগ নিয়েছেন সেটা খুবই ভাল উদ্যোগ। বিদ্যমান দোকান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দোকানগুলো তারা সিটি কর্পোরেশনকে ভাড়া দিয়ে নিয়েছেন। সেখানে তাদের বিনিয়োগ আছে। কিন্তু এর বাইরে যেন নতুন কোনো স্থাপনা না করে। সেখানে পেশাদার যারা ‘ল্যান্ড স্কেপ ডিজাইনার’ তাদের সাহায্য নিয়ে গাছপালা লাগানোসহ পার্ক হিসেবে যেন মানুষ ব্যবহার করতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া অপ্রয়োজনীয় যেসব স্থাপনা আছে সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে। উদ্যোগটা নেয়ার জন্য মেয়র মহোদয়কে ধন্যবাদ।
সবুজ ধ্বংসের সেই দুই চুক্তি : ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড ও রিফর্ম লিমিটেড নামে বেসরকারি দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্যবর্ধনের নামে করা ২০ বছর মেয়াদি ওই চুক্তির পর উদ্যানে গড়ে তোলে ইট–কংক্রিটের অবকাঠামো। পার্কে নির্মাণ করা হয় ২০টি দোকান। এরপর ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট নতুন করে চুক্তি করে চসিক। এবার অবশ্য রিফর্ম কনসোর্টিয়াম নামে কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। চুক্তির পর প্রতিষ্ঠানটি কাজও শুরু করে। লোহার বিভিন্ন স্ট্রাকচারও নির্মাণ করা হয়।
রিফর্ম কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে সম্পাদিত চসিকের চুক্তিতে ৩১টি শর্ত রয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী, বিপ্লব উদ্যানের পূর্ব পাশে দোতলায় ২০০ ফুট দীর্ঘ স্থাপনা নির্মাণ করে কফিশপ করার কথা। এটা নিচতলার সাথে একাধিক সিঁড়ি দিয়ে সংযুক্ত থাকবে। অবশ্য সেখানে একটি অংশে দোতলায় চট্টগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংবলিত জাদুঘরসহ প্রদর্শনী কেন্দ্র থাকবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ রয়েছে। চসিকের উদ্যোগ, আর্থিক সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় হবে এ কেন্দ্র।
এছাড়া উদ্যানের পূর্ব পাশে জাতীয় পতাকার আদলে স্টিল ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা তৈরি একটি কাঠামো করার কথা। এখানে সবুজ লতাপাতা দিয়ে আবৃত করে বাংলাদেশের পতাকা দেয়ার কথা। তবে হেলানো অবস্থায় ওই কাঠামোর নিচে কিডস বা গেমিং জোন করা করার কথা। এতে পূর্ব পাশে বিদ্যমান খালি জায়গা কমে যাওয়ার শঙ্কা ছিল। একইসঙ্গে কাঠামোর ওপর, নিচ ও দুই পাশে পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠানের লোগো প্রদর্শন করা হবে। এছাড়া উদ্যানে ১ হাজার ৩০০ বর্গফুট দুটি স্টিলের কাঠামোর ভেতর গেমিং জোন করা হবে বলেও চুক্তিতে আছে। এছাড়া ২৫টি ডিজিটাল স্ক্রিন, বিলবোর্ড বা মেগা সাইন স্থাপন করার সুযোগ আছে চুক্তি অনুযায়ী। এমনকি ডিজিটাল স্ক্রিন, মেগাসাইন, এটিএম বুথ, কিয়স্ক, প্রদর্শনী কেন্দ্র, কিডস এঙপেরিয়েন্স বা গেমিং জোন স্থাপন করার সুযোগ আছে।
এর আগে ২০১৮ সালের চুক্তি অনুযায়ী বিপ্লব উদ্যানে ফোয়ারা ও গ্লাস টাওয়ার নির্মাণ করা হয়। নতুন চুক্তির পর সই ফোয়ারা ভরাট এবং গ্লাস টাওয়ার ভাঙা হয়। এছাড়া নতুন চুক্তিতে সেখানে অস্থায়ী উন্মুক্ত মঞ্চ করা করার সুযোগ দেয়া হয়। চসিকের অনাপত্তি সাপেক্ষে বিভিন্ন অবকাশ দিবস এবং জাতীয়, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বিভিন্ন উৎসবে চত্বর ও হাঁটার জায়গায় কিয়স্ক স্থাপন করে উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করতে পারবে বলে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যদিয়ে মূলত মানুষের হাঁটার জায়গা সংকুচিত করে মেলা বা অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে করেন নগরবাসী।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, গত ৩ অক্টোবর বিপ্লব উদ্যান নিয়ে একটি সভা করে চসিক। ওই সভায় উদ্যানে বিদ্যামান ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ রেখে বাকি সব স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি জানান নগরপরিকল্পনাবিদ এবং বিশিষ্টজনেরা। এর প্রেক্ষিতে করণীয় ঠিক এবং বাস্তবায়নে করতে একটি কমিটি করার কথা ছিল। পরবর্তীতে সে কমিটি আর হয়নি।
এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বও চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তর পত্র দিয়ে জানায়, বিপ্লব উদ্যানে দ্বিতীয় দফায় সৌন্দর্য বর্ধনের নামে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন অবৈধ স্থাপনা নির্মাণসহ বৃক্ষ নিধন কাজ করছে। স্থাপনা নির্মাণের দ্বারা উদ্যান এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থার অবক্ষয়–ক্ষতির আশংকা রয়েছে।
এছাড়া বিপ্লব উদ্যান রক্ষার দাাবিতে সরকার পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতা অধিকার রক্ষা পরিষদ’, ‘বিপ্লব উদ্যান ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’, ‘বৈষম্যবিরোরী ছাত্র সমাজ’ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে। নতুন স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের দাবি জানায় ‘বিপ্লব উদ্যান দোকান মালিক সমিতি’ও।