মেট্রোরেল প্রকল্পকে ‘ব্যয়বহুল’ হিসেবে বর্ণনা করে চট্টগ্রাম মহানগরীর যানজট নিরসনে বিকল্প সাশ্রয়ী ব্যবস্থা খোঁজার তাগিদ দিয়েছে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম নামের একটি সংগঠন। গতকাল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে ‘বন্দরনগরী চট্টগ্রাম যোগাযোগ ভৌত অবকাঠামো কোন পথে’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে ফোরামের নেতারা তাদের মতামত তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে মেট্রোরেলের বিকল্প হিসেবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যানবাহন ব্যবস্থাপনা, গণপরিবহন হিসেবে বাসের জন্য আলাদা লেইন করা, ফুটপাথ ব্যবস্থাপনাসহ ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া হয়। খবর বিডিনিউজের।
ফোরামের সহসভাপতি প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া বলেন, চট্টগ্রামে রাজধানী ঢাকার মতো জনসংখ্যা নেই। ২০২২ সালের জনসংখ্যা জরিপ অনুযায়ী ঢাকার লোকসংখ্যা এক কোটি দুই লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন (বাস্তবে দুই কোটির ওপর), সেখানে চট্টগ্রামে ৩২ লাখ ২৭ হাজার ২৪৬ (বাস্তবে প্রায় ৭০ লাখ)।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকায় প্রতিদিন ২১ মিলিয়ন যাত্রী ট্রিপ হয়। বিপরীতে চট্টগ্রাম মহানগরীতে ট্রিপ হয় ৬ দশমিক ৭ মিলিয়ন, যা ২০৩০ সালে হতে পারে ১০ দশমিক ৪ মিলিয়ন। সে প্রসঙ্গ ধরে সুভাষ বড়ুয়া বলেন, নগরীতে যানজট কমাতে প্রথম ধাপেই মেট্রোরেল (ঘণ্টায় যার ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন ক্ষমতা রয়েছে) সিস্টেমে যাওয়ার আগে বিকল্প সাশ্রয়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়। এই সুপারিশগুলো ১৯৯৫, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের মাস্টার প্ল্যানে দেওয়া ছিল। যেমন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, যানবাহন ব্যবস্থাপনা (ডিডিএম), গণপরিবহন বাসের জন্য আলাদা (ডেডিকেডেট) লেইন করা, ফুটপাথ ব্যবস্থাপনা, জংশান ডিজাইন সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা, বিদ্যমান সড়কের শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন করলে প্রতি ঘণ্টায় গণপরিবহনে আলাদা লেইনের মাধ্যমে ৯ থেকে ১৭ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব। এর ফলে জনগণের করের টাকা এবং ঋণের টাকার সাশ্রয় হবে। বিআরটি (বাস র্যাপিড ট্রান্সপোর্ট) সিস্টেম নির্মাণ করতে কোনো ঋণও দরকার হবে না। ভবিষ্যতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে এর কার্যকারিতা অটুট থাকবে।
সুভাষ বড়ুয়া বলেন, সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা এবং যানবাহন চাহিদা ব্যবস্থাপনা ছাড়া ব্যয়বহুল আধুনিক গণপরিবহন মেট্রোরেল নির্মাণ করে চট্টগ্রাম নগরের যানজট নিরসন সম্ভব নয়। এটার সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সময় লাগবে দুই থেকে তিন বছর। সমীক্ষার ভিত্তিতে অনুমোদন, প্রকল্প বাস্তবায়নে লাগবে আরও পাঁচ থেকে সাত বছর। সব মিলিয়ে মেট্রোরেল সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ১০ বছরের মতো। এ সময় কি নগরবাসী অসহনীয় যানজটে দিন পার করবে? ডেডিকেটেড বাস লেইন ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নগরীর যানজট নিরসন সম্ভব এবং তা আগামী এক মাসের মধ্যে শুরু করা যায়। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সিদ্ধান্তের দরকার।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে সুভাষ বড়ুয়া বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) পদ্ধতি নির্মাণ, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় মেট্রোরেলের চাইতে ‘অনেক কম’। নগরীর টেকসই উন্নয়নের স্বার্থে জনগণের কল্যাণে দেশের মানুষ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করলে তা বিবেচনায় নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
ফোরামের সভাপতি ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, চট্টগ্রাম শুধু মহানগরী নয়, এটা বন্দরনগরও। নগর ও বন্দরের গতিশীলতার সমাধান মাল্টিডাইমেনশান্যাল নেচারের। সরলীকরণ করে চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধান নয়। রাজধানীর জন্য যা প্রযোজ্য, চট্টগ্রামে তা হুবহু প্রযোজ্য নাও হতে পারে। উপযুক্ততা যাচাই না করে ক্রমাগত ব্যয়বহুল ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছে সরকার।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে আইনগতভাবে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কথা বলেছিলাম, কিন্তু তারা সেটি করেনি। মাস্টার প্ল্যানের সুপারিশকে অগ্রাহ্য করে তারা বিশাল অংকের ভৌত অবকাঠামো (উড়াল সড়ক) করেছে ঝড়ের গতিতে। এজন্য ছিল না কোনো চিন্তা, দূরদর্শিতাও ছিল না। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ছিল না বিজ্ঞানসম্মত ট্রাফিক তথ্যের বিশ্লেষণ।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের উপদেষ্টা অধ্যাপক শফিক হায়দার চৌধুরী, সহসভাপতি প্রকৌশলী, স্থপতি বিধান বড়ুয়া, অধ্যাপক ড. নাজিম উদ্দিন সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।