বরাবরের মতো এবারও চলতি অর্থবছরের চেয়ে টাকার অংক আরো বাড়িয়ে আগামী ৬ জুন ২০২৪–২০২৫ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়ের বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। যা হবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আকারের বাজেট। এসব চ্যালেঞ্জের উত্তরণ ঘটিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা যাবে বলে মনে করেন অর্থমন্ত্রী। এটি হবে বর্তমানে অর্থমন্ত্রীর আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট উত্থাপন। ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি শেষ বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ফলে ব্যস্ত সময় পার করছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। খবর বাংলানিউজের।
এদিকে বৈশ্বিক সংকটের কথা বিবেচনায় নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ছয় শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ রিজার্ভ ও রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। মূল্য কমিয়ে নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে।
একই সঙ্গে সরকারি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা সাড়ে ৫ লাখ কোটি টাকার কাছাকাছি ধরে ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেট সাজানো হচ্ছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে সরকার রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্য ঠিক করতে যাচ্ছে তাতে চলতি অর্থবছরের তুলনায় অনেক বেশি টাকা জোগাড় করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর)। এছাড়া নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হচ্ছে না। দুই বছর পর আবারও অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। এবার বাজেট সামনে রেখে কর ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না করা হলেও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি বাতিল করা হতে পারে কিংবা এটি দুই শতাংশ থেকে কমিয়ে এক শতাংশ করা হতে পারে।
সম্প্রতি গণভবনে অনুষ্ঠিত ২০২৪–২৫ সালের বাজেট প্রস্তুতির সারসংক্ষেপ উপস্থাপন বিষয়ক বৈঠকে চলতি অর্থবছরের মতো আগামী অর্থবছরের বাজেটকেও ব্যয় সংকোচনমুখী করার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী বাজেটেও বিলাস পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে আগামী বাজেটের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে সঠিক দিশা ঠিক করতে না পারলে ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অর্থনীতিকে পথ দেখাতে হলে আগামী বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন পরিকল্পনায় বড় চ্যালেঞ্জ সামলাতে হবে। বিশেষ করে বাজেটের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ যেন না বাড়ে, রিজার্ভ যাতে আরও হারিয়ে না যায় এবং রাজস্ব আদায়ে বাড়তি নজর দিতে হবে।
তারা বলছেন, বছর ঘুরে প্রতিবার বাজেটের আকার বাড়লেও বাস্তবায়ন ঘাটতির পুরনো চিত্রই থাকছে। আরও একটি অর্থবছর শেষ হতে যাচ্ছে একই ধারায়। আসছে বাজেটেও বড় আকারের বাস্তবায়ন ঘাটতি থেকে যাবে।
অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শুধু পরিকল্পনা করলেই হবে না, অর্থ তো নেই। মূল সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতির ওপর আমাদের আস্থা চলে গেছে। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা কমে গেছে। মূল্যস্ফীতি আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডলার সংকটের কারণে রিজার্ভ কমে যাওয়ার পাশাপাশি চাপ বেড়েছে মূল্যস্ফীতির। গত বছরের মার্চ থেকে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। অথচ চলতি অর্থবছরে যা ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার পরিকল্পনা নিয়েছিল সরকার। এজন্য সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে সরকারের ডমেস্টিক ভলিউমটা কমাতে হবে। আমাদের প্রবৃদ্ধি সহজে হবে না। কেননা আমাদের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা অনেক খারাপ। সেটা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বাজেটের কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ যেন না বাড়ে, সেদিকে নজর দিতে হবে এটাই মূল চ্যালেঞ্জ।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের রিজার্ভ বাড়াতে হবে। ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে অর্থনীতির ওপর আস্থা থাকবে না। আমরা এদিক–সেদিক করলেই খাদে পড়ে যেতে পারি। কারণ আমাদের রিজার্ভ নেই। ২৪ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। তাই আমাদের সতর্কভাবে চলতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন গ্রস হিসাবে ২৪ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটের আগে যা ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলারের উপরে।
রাজস্ব আহরণ নিয়ে তিনি বলেন, লক্ষ্য যদি ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ধরে থাকে তাহলে আমি বলব, এটা বাস্তবতা ও অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক বেশি ধরা হয়েছে। সঠিক নীতি কৌশল অবলম্বন করা হলে এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা গেলে এটা যে অর্জন সম্ভব না তাও বলা যাবে না। কিন্তু আমরা অতীতে দেখেছি যে, রাজস্ব আহরণের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা কখনও বাস্তবায়ন করা যায়নি।
তিনি বলেন, রাজস্ব আহরণ অর্জন করা সম্ভব হবে না। টার্গেট যেটা ফিঙড করেছে, সেটা রিভাইস বাজেটের সাথে ঠিক আছে। কিন্তু রিভাইস বাজেটই তো অর্জন করা সম্ভব হবে না। এটি বরাবরই থাকে এবং সমস্যা তৈরি করে। বাজেট বাস্তবায়নকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, বাস্তবায়নের জন্য আমাদের রাজস্ব বাড়াতে হবে। বাজেট বাস্তবায়নে আমাদের সক্ষমতা বাড়ছে না। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না এবং আগামী বছরও হবে না। যতদিন রাজস্বে ঘাটতি থেকে যাবে, এর সমাধান করা যাবে না। সেজন্য রাজস্বের সঙ্গে মিল রেখে ব্যয় কমাতে হবে। আমরা অপ্রয়োজনীয় অনেক খাতে ব্যয় করে থাকি। সেই জায়গাটি বন্ধ করতে হবে। তাহলে মোটামুটি ঠিক থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় বরাদ্দ রেখে বাজেট পরিকল্পনা করা হয়েছে। চলতি ২০২৩–২৪ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয় ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আসন্ন বাজেটে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে বিশেষ কিছু জায়গায় কর ও ভ্যাটে ছাড় থাকলেও এবার রাজস্ব আদায়ের আওতা আরো বাড়ানো হচ্ছে। আগামী বাজেটে সরকারের রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় করার লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হতে পারে এনবিআরকে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে রাজস্ব আদায় বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার কথা উল্লেখ করা হবে। এর মধ্যে ১০ লাখ বা এর বেশি মূসক (ভ্যাট) পরিশোধের ক্ষেত্রে ই–পেমেন্ট বা এ–চালান বাধ্যতামূলক করা হবে। বর্তমান ই–পেমেন্ট বা এ–চালান শুধু ৫০ লাখ টাকা বা তার বেশি ভ্যাট পরিশোধে ব্যবহারের বিধান আছে।
এদিকে ইলেকট্রনিকস ট্যাঙ ডিটেকশন সোর্স (ইটিডিএস) অনলাইন প্ল্যাটফরম চালুর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা বৃদ্ধি, সেবার মানোন্নয়ন ও রাজস্ব আদায় বাড়াতে আয়কর আইন, ২০২৩ প্রয়োগ করা হবে। এবারের বাজেটে আয়কর খাতে কর অবকাশ সুবিধা কাটছাঁট করা হতে পারে। বিত্তবানদের কাছ থেকে আয়কর আদায় বাড়াতে ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হতে পারে।
এদিকে আসন্ন বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। এ কারণে খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার করে ভোগ্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার কৌশল রয়েছে আগামী বাজেটে।
এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, আমাদের মূল লক্ষ্য অর্থনীতিকে অনট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা। একই সঙ্গে নিত্যপণ্য যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে, এগুলো নিশ্চিত করা। একই সঙ্গে সরকার যে নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল, সেটির একটা রিফ্লেকশন দেখতে চাই। আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ থাকবে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ ও রাজস্ব আদায়। আমরা সংকোচনমূলক সময় পার করছি। সংকোচন থেকে কীভাবে সম্প্রসারণ করা যায়, সেটিই চেষ্টা করছি। এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন সামনে রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হচ্ছে। সর্বোপরি আগামী বাজেটে মানুষের আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
অর্থ প্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, সামগ্রিকভাবে বলা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রপ্তানিপণ্যের বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও প্রান্তিক মানুষের সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি এবারের বাজেটের অগ্রাধিকারে থাকবে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা আরও বাড়বে। এবার বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অগ্রাধিকার পাচ্ছে। পাশাপাশি নিম্নআয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া যেসব খাত দীর্ঘদিন কর অবকাশ সুবিধা পেয়ে আসছে, সেসব খাত থেকে কর অব্যাহতির সুবিধা উঠিয়ে দেওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।