প্রীতিলতাকে আজ বড় প্রয়োজন

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ৮ মে, ২০২১ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

ব্রিটিশ রাজশক্তি ভারতবাসীকে সামাজিকভাবে দমিয়ে রেখেছিল শতবছরের বেশি সময় ধরে। তাদের প্রমোদভবনের ফটকের সামনে ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’ লেখা সতর্কবাণীটিই যথেষ্ট এই সামাজিক অবদমনের স্বরূপ বোঝাতে। কিন্তু এই অবদমনে প্রতিবাদের ভাষা যোগাতে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল যে ব্রহ্মাস্ত্রটি তা কিন্তু শিক্ষা, প্রকৃত শিক্ষা। আমাদের একালের মতো ভারী-ভারী সনদধারী শিক্ষা নয়, যা আমাদের শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়াতে শেখায় না। মজার ব্যাপার হল, এই শিক্ষার সুযোগ এসেছিল কিন্তু ইংরেজদেরই হাত ধরে, যদিও তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রভুভক্ত কর্মচারী তৈরি করা। তাদের উদ্দেশ্য একেবারে সফল হয়নি, প্রভুভক্ত কর্মচারী একবারেই সৃষ্টি হয়নি তা নয়। তবে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্ব জ্ঞানভান্ডার উন্মুক্ত হয়। এই সুযোগের মই বেয়েই নতুন দিনের আলো ফোটার সম্ভাবনা দেখা যায়।
ভারতবর্ষের অগ্রগামী জনপদ হিসেবে বাংলা এগিয়ে থাকে বিপ্লবের পথেও। আর বাংলার বুকে চট্টগ্রাম বরাবরই এক সৌভাগ্যতিলক। এই বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামাবাড়িতে ১৯১১ সালের ৫ মে, বৈশাখের এক আগুন ঝরা দিনে জন্ম নেন প্রীতিলতা। বাবা মা নাম দেন রানী। সূর্যসেনরা ডাকতেন ‘ফুলতার’ বলে। আরও নানান ছদ্মনাম ধারণ করতে হয়েছিল তাঁকে একুশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে।
জগদ্বন্ধু ও প্রতিভা ওয়াদ্দেদারের ছয় ছেলেমেয়ের মধ্যে দ্বিতীয় রানী। মা ধনবান পরিবারের সন্তান হলেও বাবার নিম্নমধ্যবিত্ত আটপৌরে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষা ও মননশীলতার বীজ পুঁতে দেন। প্রীতিলতার কথা বলার আগে তাঁর মায়ের কথা আমাদের বলতেই হয়। প্রীতিলতার আত্মাহুতির পর তাঁর বাবা রাজরোষে পড়ে চাকরি হারালে মা-ই ধাত্রীবিদ্যা শিখে নিয়ে সংসারের হাল ধরেন। প্রীতির ছোট বোন শান্তিলতা’র বিয়ের দিন বাড়িভরা লোকজন, দম ফেলার সময় নেই প্রতিভা দেবীর। এমন সময় বাড়ির সামনে একটা ঘোড়ার গাড়ি থামে। প্রসব বেদনায় কষ্ট পাওয়া এক নারীর আত্মীয় এসেছেন তাঁকে নিয়ে যেতে। সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে বাঙ গুছিয়ে তিনি চড়ে বসেন ঘোড়ার গাড়িতে। আত্মীয়দের বলে যান- ‘তোমরা তো রইলে, এদিকটা সামলে নিও’। সেবাকে পরম ধর্ম বলে প্রাণে ধরেছেন তিনি। সেই সঙ্গে পেশার প্রতি বিশ্বস্ততার এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তও স্থাপন করেছেন। কোমলতা ও দৃঢ়তার অপূর্ব সমন্বয় দেখা যায় এই মা-টির চরিত্রে। এমন মায়ের মেয়েইতো দেশের জন্য প্রাণ দেবে।
বাবাটিও কম যান না। মিউনিসিপাল স্কুলের চাকরি ছেড়ে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে’তে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর আপিসের বড় সাহেব ভারতবাসী সম্পর্কে কটূক্তি করলে প্রতিবাদ করেন জগদ্বন্ধু। পরিণামে চাকরি হারাতে হয়। যদিও এ এনিয়ে তাঁর কোন আক্ষেপ ছিল না। সত্যি বলতে কি, বাবা মায়ের প্রভাব কতখানি প্রীতিলতার জীবনে তা নিয়ে আমাদের আরও কথা বলা প্রয়োজন, যা আমাদের একালের বাবা-মায়েদের পথ দেখাবে, আমাদের সন্তানদের মাঝে সততা, স্বকীয়তা ও দৃঢ়তার বীজ বুনতে সহায়ক হবে।
প্রীতিলতার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু ডাঃ খাস্তগীর বালিকা বিদ্যালয় হতে। লেখাপড়ায় রানী বরাবর সেরাদের কাতারে। তবে ইতিহাসের শিক্ষক ঊষাদিই প্রথম তাঁর হাতে তুলে দেন ‘অন্যবই’, পরীক্ষায় পাসের জন্য যেসব বই না পড়লেও চলে। এসব বই কাজ করে জীবনগঠনে ও মননশীলতার বীজ বপনে। অন্যবই পড়তে গিয়ে পরীক্ষায় খারাপ করে ফেলবে, বাবা এই নিয়ে আশংকা প্রকাশ করলেও পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার হিসেবে মেয়ের হাতে তুলে দেন ঊনিশ শতকে আমেরিকায় প্রচলিত দাসব্যবসা ও কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চলমান নির্যাতনের অমানবিকতার স্মারক হেরিয়েট বিচার স্টো’ র ‘আঙ্কল টম’স কেবিন’ এর বাংলা অনুবাদ টম চাচার কুটির। এই বইটি রানীর বুকে ঝড় তোলে শৈশবেই।
খাস্তগির ইংরেজি স্কুলে রানীর সহপাঠী ছিলেন আরেক বিপ্লবী কন্যা কল্পনা দত্ত। স্কুল প্রাঙ্গণে তারা একসঙ্গে ব্যাডমিন্টন খেলত, স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে। কিন্তু ঊষাদি’র সংস্পর্শ এবং তাঁর দেওয়া বইপত্র তাদের ভাবনার ঘরে নাড়া দেয়। বিপ্লবীদেরকেই তারা আদর্শ মানে। আমরা দেখতে পাই- শৈশবে রানীর নায়ক ক্ষুদিরাম বসু, কানাইলাল, কৈশোরে ঝাঁসি’র রানী লক্ষ্‌মীবাই, যৌবনে মাস্টারদা সূর্যসেন, রামকৃষ্ণ বিশ্বাস। এমনকি বইতে পড়া চরিত্রগুলোও রক্তমাংসের জ্যান্ত মানুষ হয়ে উঠে এসে তাঁকে সাহস যুগিয়েছে, আন্দোলিত করেছে। ভুপেন্দ্র কিশোর রক্ষিতের ‘চলার পথে’, রেখা নামের এক বিপ্লবীর গল্প, যিনি ইংরেজের হাতে ধরা পড়ে গেলে তথ্য বাঁচাতে সাগরে ঝাঁপ দেন। রানীর বুকে আত্মাহুতির মন্ত্রণা দিতে ‘রেখা’র অবদানও কম নয়। অগ্নিকন্যা প্রীতিলতার ছোট্ট জীবনের প্রতিটি দিনক্ষণই তাঁকে আত্মাহুতির প্রণোদনা যুগিয়েছে। তাড়িয়ে বেড়িয়েছে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের দিকে। দৃশ্যপট পাহাড়তলি ইউরোপিয়ান ক্লাব, তারিখ ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর।
অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ছিলেন একাধারে মেধাবী, বিনয়ী, স্নেহশীল, ধার্মিক আর আত্মপ্রত্যয়ী। বাবা-মার প্রতি ছিল অগাধ ভক্তি। পরিবারের অন্য সদস্য ছাড়া বিপ্লবী সহযোদ্ধাদের জন্যও তাঁর ভালোবাসার কমতি ছিল না। তিনি লিখতেন, গাইতেন। ভাল রাঁধতেনও। বাঁশিও বাজাতেন বলে কোন-কোন সূত্রে উল্লেখ আছে।
‘প্রিয় নয়, খাঁটি হওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের’ ইডেন কলেজে পড়ার সময় রানীকে একথা বলেছিলেন লীলা নাগ। এই সেই লীলা নাগ, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী শিক্ষার্থী। বেথুন কলেজে পড়ার সময় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে বড়লাটের পত্নীকে প্রথানুযায়ী নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন, অসম্মানজনক এই প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। এই ঘটনার সূত্র ধরে অবশেষে বন্ধ হয় এই প্রথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় লীলা নাগ প্রতিষ্ঠা করেন ‘দীপালী সংঘ’, মেয়েদের শরীরচর্চা, লাঠি ও অস্ত্রচালনা শেখার সংগঠন। কবিগুরু এসেছিলেন একদিন দীপালী সংঘ পরিদর্শনে। লীলানাগের কাছে এইসব গল্প শুনে রোমাঞ্চিত হতেন প্রীতিলতা।
লীলা নাগই রানীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’- ‘দেশের মেয়েদের অংশগ্রহণ, সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া কোন কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। মেয়েরা অন্তঃপুরের বাসিন্দা হয়ে ঘর গৃহস্থালি নিয়ে পড়ে থাকলে এ-জাতির মুক্তি আসবে না। নারীপুরুষ একসঙ্গে হাতে হাত রেখে কাজ করলেই কেবল খসে পড়বে অধীনতার শৃঙ্খল।’ ঠিক যেন চোখ খুলে যায় কিশোরী রানীর। লীলা নাগ যোগ করেন- ‘ঘর ও বাইরের কৃত্রিম বিভেদ রেখা মুছে দিতে হবে আমাদের’। ছুটিতে বাড়ি যাবার সময় লীলা নাগ প্রীতিকে দেন হলুদ রঙের একটি শপথনামা যাতে লেখা ছিল- ‘প্রয়োজন হইলে দেশের মুক্তিসংগ্রামে আমার সর্বস্ব, এমনকি জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করিতে প্রস্তুত থাকিব।’ দীপালী সংঘের সদস্যপদ লাভ হয় এই শপথনামা দিয়ে। ইতোমধ্যে সূর্যসেনের বিপ্লবী দলেও স্থান হয়ে যায় রানীর।
ইডেনের পড়া শেষ হলে রানী কলকাতার বেথুন কলেজে যান আরও পড়ার জন্য। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের আইবুড়ো বড় মেয়ে পড়েই যাচ্ছে। ছোট দুটি ততদিনে মাথা তুলছে। বাবামায়ের কি ভাবনা নেই! মেয়েকে পাত্রস্থ করতে হবেনা! মায়ের কি সাধ হয়না মেয়েকে সংসারী দেখতে? কিন্তু মেয়ের দৃঢ়তা তো বাপ মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া। সে তো কোন ভুল করছে না, এগিয়ে যাচ্ছে সত্য ও সুন্দরের পথেই। বাবা মায়ের আশীর্বাদই তাই মেয়ের চলার পাথেয়।
ভাবতে অবাক লাগে এই একুশ শতকেও এমন মা-বাবা খুব বেশি নেই আমাদের সমাজে। এই যে দলে-দলে এতো মেয়ে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, তাদের অধিকাংশের বাবা মায়ের স্বপ্ন- মেয়ের জন্য একটা ভাল ঘর ও ভাল বর পাওয়া। করোনাকালে শিক্ষাজীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় কত মেধাবী মেয়েকে পাত্রস্থ করে বাবা মা দায়মুক্ত হয়েছেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই। অর্থনৈতিক দীনতার পাশাপাশি আমাদের মানসিক দীনতাও এর জন্য অনেকাংশে দায়ী।
আমরা আধুনিকতার বড়াই করি, উন্নয়ন নিয়ে গর্ব করি। সত্যিই কি আমরা অনেক উন্নত আর আধুনিক হয়েছি? রাশি রাশি অট্টালিকা, রেস্তোরাঁ, সৌন্দর্যচর্চা কেন্দ্রই কি উন্নতি ও আধুনিকতার বাহন? ভাবনায়, মননে, স্বপ্নে আমরা কি দিন বদলের কোন আকাঙ্ক্ষা আদৌ ধারণ করি? ঠুনকো জনপ্রিয়তা, ভোগবিলাস ও ক্ষমতা আমাদের প্রধান মোক্ষ। তাই আত্মাহুতি নয়, আত্মহননের মৌসুম চলছে সমাজজুড়ে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরিমা দাস ও ভিলেজ রকস্টারস
পরবর্তী নিবন্ধঅসহায় মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসুন