রিমা দাস ও ভিলেজ রকস্টারস

আলেয়া পারভিন | শনিবার , ৮ মে, ২০২১ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

আরও বহু মেয়ের মতন মেয়েটা অভিনেত্রী হবার জন্যই এসেছিল মুম্বাইতে। কিন্তু মাতৃভাষা অসমীয়া ছেড়ে টান টান হিন্দি কিংবা ইংরেজি কোনটাই আয়ত্তে আনতে পারেনি। এবং বহু গল্পের মতই এ-গল্পটিও এখানেই ফুরিয়ে যেতে পারতো। কাজের সুযোগ খুব একটা হয়নি তার। ডিপ্রেশন কাটাতে হাঁটতে শুরু করলেন বিশ্ব সিনেমার অলিতে-গলিতে। সত্যজিৎ রায়, গদার, তারকোভস্কি, মাজিদ মাজিদি, ওং-কার-ওয়াইদের মতো মাস্টার ডিরেক্টরদের সিনেমার মধ্যে খোঁজার চেষ্টা করলো একটু প্রশান্তি। এই সিনেমা দেখতে দেখতেই বুঝে ফেললো অভিনয়ের বাইরেও সিনেমা থেকে নেওয়া কিংবা সিনেমাকে দেবার আরও হাজারটা পথ খোলা আছে।
ওই সময় নিজের সোনার গয়না বিক্রি করে একটা ক্যামেরা কিনে ফেললো ঝোঁকের মাথায়। কিন্তু, এই ঝোঁকটাই যে তাঁর জীবনের একটা বড় বাঁক বদল এ ব্যাপারে তার কোন সম্যক ধারণাই হয়তো ছিল না। কখনো ফিল্ম স্কুলে না যাওয়া, কারো সহকারী হিসেবে কাজ না করা মেয়েটা বেশ ভালভাবেই জানতো, সে কি বলতে চায়, কীভাবে বলতে চায়। ওটুকু জানাকে সম্বল করে ছোট্ট একটা দল নিয়ে সে বানাতে শুরু করলো তার ডেব্যু ফিচার ফিল্ম অন্তর্দৃষ্টি (গধহ রিঃয ধ নরহড়পঁষবৎ)। এই সিনেমা বানাতে গিয়েই শিখলো কীভাবে বলতে হয়- লাইট ক্যামেরা অ্যাকশন। এখানেও কিছু গতানুগতিক ব্যাপার ঘটতে শুরু করলো, মেয়েটা বুঝতে পারলো বেশ যে অভিনেতা কিংবা সহকারীর চোখে একটা দ্বিধা, সে দ্বিধা ঝেড়ে সে ভাবলো হয়তো সে-ই আসলে আত্মবিশ্বাসী না। মুম্বাই থেকে নিয়ে আসা, মনের ভেতরে পুষতে থাকা সেই রাগ বাড়তে লাগলো।
একদিন গ্রামের একটা অনুষ্ঠানে একদল ছেলেমেয়েকে দেখতে পেল থার্মোকল দিয়ে বানানো মেকি বাদ্যযন্ত্র দিয়ে গান গাইছে। রিমা দাস বিশ্বাস করেন আমাদের যাত্রার সাথে এই মহাবিশ্বেরও একটা যোগাযোগ আছে। না হয় সব বাধা থেকে মুক্ত হয়ে জীবনকে উপভোগ করতে চাওয়া এক নারীর সামনে, একদল শিশুর সব না পাওয়া ভুলে গিয়ে জীবনকে উপভোগ করা শুধু কাকতালীয় একটা ব্যাপার হতে পারে না। হয়তোবা এমনও হতে পারে, মানুষ মানুষের সকল না পাওয়া মহাবিশ্বের সাথে জুড়ে দেয়, না পাওয়ার হাহাকারই মানুষকে অবিচ্ছিন্ন করে তোলে জগতের এই অনিঃশেষ যাত্রার সাথে। রিমা দাসও তাই বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেননি।
ওই আনকোরা শিশুদের দল, কলেজ পড়ুয়া কাজিন মল্লিকা দাস আর গয়না বিক্রি করে কেনা সেই ক্যামেরা হাতে তিনি নেমে পরলেন এক কাব্যিক যাত্রায়। যেই যাত্রা চলে প্রায় চার বছর। রিমা দাস তার এই যাত্রার নাম দিয়েছেন ‘ভিলেজ রকস্টার’। আপনার যদি রিমা দাসের এই গল্পটুকু জানা থাকে, তাহলে রিমা দাস আর ‘ভিলেজ রকস্টার’ এর ১০ বছর বয়সী ধুনুকে আলাদা করা হয়তো সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে। কখনো ওই চার নম্বর দেয়ালটা ভেঙে রিমা দাস ঢুকে পরেন ধুনুর চরিত্রে কখনোবা ধুনু এসে নাড়ায় গল্পের কলকাঠি।
আসামের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম, সেই গ্রামেরই ছোট্ট মেয়ে ধুনু (ভনিতা দাস), ভালবাসে গাছে চড়তে, ছেলেদের সাথে মাছ ধরতে। এবং বিধবা মায়ের সাথে হাত মিলিয়ে কাজের ফুরসতে থার্মোকলের গীটার বাজাতে। ধুনু একটা গীটার কিনতে চায়, কিন্তু তার মতো হতদরিদ্র কারও পক্ষে কি তা সম্ভব?
‘ভিলেজ রকস্টার’ বানানোর এই চার বছরকালীন সময়ে তিনি কোনো প্রযোজকের চৌকাঠ মাড়াননি। নিজের গল্পের স্বাধীনতা কিংবা নিজের শেখার স্বাধীনতা তিনি অন্য কারো হাতে বর্গা দিতে চাননি। তাই নানারকম পার্টটাইম কাজ করে আর নিকট লোকদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে এই চার বছর তিনি সংসার চালিয়েছেন, শ্যুটিং এর খরচা জোগান দিয়েছেন।
খুব মজার ব্যাপার হল, রিমা’র প্রথম সিনেমা ‘দ্যা ম্যান উইথ আ বাইনোকিউলার’ এর গল্পটাও যেন রিমারই জীবনের কথা বলে। একজন অবসরপ্রাপ্ত ভূগোলের শিক্ষক চৌধুরীর গল্প এটি, এ-সিনেমায় দেখা যায় শিক্ষকের ছেলে তাঁকে একটি দুরবীণ উপহার দেয়, আর সেই উপহারই তাঁর জীবনটাকে পুরোপুরি পালটে ফেলে। চৌধুরী আজীবন স্বপ্ন দেখে গেছে স্ত্রীসহ সারা দুনিয়াটা ঘুরে বেড়াবার। কিন্তু সময় বা অর্থ কিছুরই সহায় ছিল না তার। বাইনোকুলাররা তাকে পেয়ে বসে, কিংবা তিনি বাইনোকুলারকে, দেখা যায় তিনি সবসময় প্রকৃতির ভেতরে গিয়ে বসে থাকেন, কখনো জীবনের অনেকগুলি নৌকো মিস করেছেন বলে বিলাপ করছেন। রিমা এক জায়গায় বলেছেন, ‘এই গল্পটা আমার মাথায় এসেছে আমার এক বন্ধুর বাবাকে দেখে। আমার কাছে বাইনোকুলার হল একটা মেটাফোর, যা মানুষের একাকীত্বের সংগ্রাম, অনুশোচনা, পার্থক্য, অন্যকে এবং আমাদের চারপাশকে নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য অবিরাম আকাঙ্ক্ষার এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অভাবের একটা কটু সত্য।
২০১৯ সালের ৯১তম অস্কারে ভারতের অফিসিয়াল এন্ট্রি ছিলো অস্কারের ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্যাটাগরিতে (আগে এই ক্যাটাগরির নাম ছিলো বেস্ট ফরেন ল্যাংগুয়েজ ফিল্ম) এবং ঐ বছর বাংলাদেশের অফিসিয়াল এন্ট্রি ছিলো মোস্তফা সারওয়ার ফারুকির ‘ডুব’। ২০১৮ সালে নির্মিত ৮৯টা দেশ থেকে ৮৭টা ফিল্ম জমা পড়ে সেই বছর। চূড়ান্ত ৯টা ফাইনালিস্ট কিংবা শেষের ৫ মনোনিত ফিল্মের কোনোটাতেই ছিল না বাংলাদেশ, ভারতের কোনো ফিল্ম। আর এ সংবাদে কোনভাবেই ‘ভিলেজ রকস্টারস’ যে একটা দুর্দান্ত চলচ্চিত্র এবং এর পরিচালক রিমা দাস যে একজন অসাধারণ পরিচালক সে-ভাবনা জৌলুশ হারায় না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রীলংকার বিপক্ষে সিরিজ জেতার স্বপ্ন সাইফ উদ্দিনের
পরবর্তী নিবন্ধপ্রীতিলতাকে আজ বড় প্রয়োজন