প্রতিবছর ৩ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস পালিত হয়। এই দিনটিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিবন্ধীদের যথাযথ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে এই দিনটির তাৎপর্য তুলে ধরা হয়। বিশেষ করে যে যার অবস্থান থেকে প্রতিবন্ধী দিবসটি পালন করে থাকে। পরিবারের প্রতিবন্ধী সন্তানকে অন্যান্য সন্তানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে লালন পালন করতে গিয়ে একটি পরিবারের অন্যান্য সদস্যকে অনেক কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। তাদের প্রতিটি ক্ষণ যেন জীবনযুদ্ধে পরিণত হয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্য এই আন্তর্জাতিক দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনের চেষ্টা করে থাকে। যেকোনো সামাজিক রেলীতে অথবা প্রতিবন্ধী দিবস উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন। আর যারা এই দিবসটির সম্পর্কে জানে না তাদের কথা বাদ দিলাম। প্রতিটা দিনের মতো তারা প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে জীবন যাপন করে। প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্ধারিত এই দিবসটি সম্পর্কে তারা অবগত না থাকায় অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবন্ধীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে প্রতিবন্ধীরা তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের সহায়তায় উপস্থিত হয়ে থাকে। এই প্রতিবন্ধীদের কেউ কেউ শারীরিক প্রতিবন্ধী আর কেউ কেউ মানসিক প্রতিবন্ধী। কেউ কেউ বাকপ্রতিবন্ধী যারা কথা বলতে পারে না। আর যারা দেখতে পারে না তারা হচ্ছে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। সত্যিকার অর্থে যাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করার মত শারীরিক শক্তি ও সামর্থ্য থাকে না তারা প্রতিবন্ধী হিসেবে বিবেচিত হয়। একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছে প্রতিবন্ধী শব্দটা খুবই কষ্টকর। শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কাছে না সেই পরিবারের প্রতিটি সদস্যের কাছে প্রতিবন্ধী শব্দটি খুবই কষ্টকর। মানুষ খুব সহজে প্রতিবন্ধী শব্দটা উচ্চারণ করে। কিন্তু তার আশেপাশে যারা অবস্থান করে তাদের অনেকেরই পরিবারে প্রতিবন্ধী সন্তান ভাই ও বোন থাকতে পারে। তখন এই শব্দটি তাকে খুব বেশি মর্মাহত করে। এই যন্ত্রণা অনেকেই বুঝতে পারে না। অন্যদিকে আমাদের সমাজে কোনো সুস্থ সবল মানুষ যদি সঠিকভাবে কাজ করতে না পারে তাকে অনেকেই প্রতিবন্ধী বলে আখ্যায়িত করে। হাসি তামাশার ছলে মন্তব্য করে কীরে তুই কি প্রতিবন্ধী? প্রতিবন্ধীর মত আচরণ করছিস। কিন্তু এই ধরনের মন্তব্য আশে পাশের অনেক মানুষকে আঘাত করে। মন্তব্যকারী হয়তো বুঝতে পারে না; যাদের পরিবারে প্রতিবন্ধী সন্তান আছে তারা মানসিকভাবে অপদস্ত হয়। কোনো পরিবারের আর্থিক সামর্থ্য যদি খুবই নগণ্য থাকে তাদেরকে আরো বেশি কষ্টের সম্মুখীন হতে হয়। অসচ্ছল পরিবারের সন্তানদের অবহেলার সম্মুখীন হতে হয় আরও বেশি। যদিও প্রতিটি সন্তান মা–বাবার কাছে সমান তবুও প্রতিবন্ধী সন্তানটিকে আর্থিক সচলতার অভাবে ও বাস্তবতার কারণে অনেক বেশি অবহেলা করতে হয়। শহর এলাকার বস্তি এলাকাগুলোতে যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদেরকে অনেক বেশি কষ্টের মধ্যে দিন অতিবাহিত করতে হয়। নিজেদের পাশাপাশি প্রতিবন্ধী সন্তানের লালন পালন করতে অসহায়ত্ববোধ করেন। কারণ এখানে আর্থিক সমস্যা অনেক বড় সমস্যা। মহান আল্লাহতালার সৃষ্টির মধ্যে প্রতিবন্ধীদের অবস্থানটা আল্লাহতালা নিজেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। প্রতিবন্ধীদের অনেকেই মাতৃগর্ভ থেকে এই সমস্যাগুলো নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। তাই শুরু থেকে এ প্রতিবন্ধী সন্তানরা জীবনের অর্থ বুঝতে পারে। বিশেষ করে যাদের বোধশক্তি আছে তারা প্রতিবন্ধীর বঞ্চনা প্রতিটি ধাপে ধাপে বুঝতে পারে কিন্তু যারা মানসিক প্রতিবন্ধী তারা শুরু থেকেই কিছুই বুঝতে পারে না। আমাদের আশেপাশে যাদের মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান আছে সেই পরিবারের অন্য সদস্যরা ভালোবাসায়ও আদরে তাদের জীবন চলার পথ সহজ করার চেষ্টা করে।
সামপ্রতিক ৫ আগস্ট সাড়া বাংলাদেশে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। শুরু থেকেই শেষ পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থী ও পথচারী মৃত্যুবরণ করে। এদের মধ্যে অনেকে আবার বিভিন্নভাবে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনেকের শরীরে বুলেটের স্প্লিন্টার থেকে গেছে। অমানুষিক যন্ত্রণা নিয়ে দিনযাপন করছে। আবার এদের মধ্যে অনেকেই বিভিন্নভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করে। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে অন্ধ হয়ে যায়। কারো এক চোখ অথবা কারো দুই চোখ নষ্ট হয়ে যায়। একটি সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে সম্পূর্ণরূপে একটি প্রতিবন্ধী জীবনে এখন তারা দিন কাটাচ্ছে। যেই মানুষটি এতদিন সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করে আসছে তাকে হঠাৎ করে একটি প্রতিবন্ধী জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হতে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ও বিশেষ করে পঙ্গু হাসপাতালে সংস্কার আন্দোলনে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে অনেক শিক্ষার্থী এখন প্রতিবন্ধী জীবন যাপন করছে। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ও দুর্ঘটনায় কবলিত হয়ে অনেকই প্রতিবন্ধী জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। আমাদের দেশে প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো জায়গায় বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের দুর্ঘটনা ঘটছে। আগুন লাগছে। এ ধরনের দুর্ঘটনার ফলে অনেকের আবার অঙ্গহানী হয়। তারা পঙ্গুক্তবরণ করে। অনেকে আবার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দুর্ঘটনার ফলে অনেক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষগুলো যখন প্রতিবন্ধী জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় তখন এ ধরনের মানুষগুলোর হঠাৎ করে পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তনকে মানিয়ে নেওয়া অনেক কষ্ট সাধ্য হয়। তাছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন অঞ্চলে পারিবারিক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে অনেক মানুষ পঙ্গুবরণ করেন। বিভিন্ন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনার ফলে যারা প্রতিবন্ধী হয়েছে তাদের সংখ্যা কম নয়। তাছাড়া বিভিন্ন নির্মাণ কাজের শ্রমিকরা নানান দুর্ঘটনায় আহত হয়। এই বিপুল সংখ্যক প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনযাত্রার জন্য প্রতিটি সরকার কিছু না কিছু পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। কিন্তু এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে খুবই নগণ্য। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে তাদেরকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয় ও তাদের সুবিধা অসুবিধাগুলো যেভাবে তুলে ধরা হয় সেইভাবে বাস্তবায়িত হয় না। যেভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আশ্বস্ত করা হয় তা ঠিক আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের পরের দিন থেকে গুরুত্ব পায় না। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে বক্তারা নিজেদেরকে উজাড় করে দেয় এবং প্রতিবন্ধীদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু বাস্তবে কোনো ধরনের ফলাফল দেখা যায় না। আমাদের দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়; একটি প্রতিবন্ধী সদস্যকে বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চালিয়ে নেওয়া বেশি চ্যালেঞ্জিং।
আমাদের দেশে সুবর্ণ কার্ডের মাধ্যমে প্রতিবন্ধীদের সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়। একটি সুবর্ণ কার্ড পাওয়ার জন্য একজন প্রতিবন্ধীকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। সূবর্ণ কার্ডগুলো নির্ধারণ ও বিতরণ করার সময় কর্তৃপক্ষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। যারা মাতৃগর্ভ থেকে প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে তারা কার্ডটি হাতে পেয়ে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে হঠাৎ দুর্ঘটনাকবলিত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু সরকারি সহায়তা আছে সেটা এখন বিবেচনার বিষয়। কারণ এই শিক্ষার্থীরা শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে প্রতিটি শ্রেণীতে নিজেদের সফলতার স্বাক্ষর রেখেছে। সামপ্রতিক সময়ে স্কুল পর্যায়ে থেকে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত অনেক শিক্ষার্থীকে প্রতিবন্ধী জীবন বরণ করতে হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আহত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশপথ যদি সহজ করা হয় তাহলে হয়তো তারা শিক্ষা জীবন শেষ করতে পারত। আর শিক্ষা জীবন শেষে তাদের জন্য চাকরির বিশেষ ব্যবস্থা থাকলে আহত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারগুলো কিছুটা সহজ জীবন যাপন করতে পারতো ও আশার আলো দেখতো। সংস্কার আন্দোলনে আহত এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা জীবন চালিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে সাহায্য ও সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আদৌ তাদের শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারবে নাকি সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সাহায্যে অনেক বিশাল বড় অংকের টাকার প্রয়োজন। বর্তমানে পাশে দাঁড়িয়ে ও সাহায্যের হাতের হাত বাড়িয়ে আহত শিক্ষার্থীদের উৎসাহ দেওয়া সকলের দায়িত্ব। জীবিকা নির্বাহের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। অসহায় শিক্ষার্থীদের পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। সুস্থ থাকলে হয়তো তাদের অনেকেই যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে পরিবার সমাজ ও দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে পারতো। তবুও আশায় থাকে প্রতিবন্ধীর প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে নিজেদেরকে তারা আবার সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসটিকে শুধুমাত্র একটি দিবসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং এ দিবসটিকে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে জন্মগতভাবে প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি বিভিন্ন দুর্ঘটনার আহত প্রতিবন্ধীদের জীবন যাত্রার পথকে সহজ করার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।