ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুর্তজা বশীর ও বায়ান্নর একুশে

ড. মনজুর-উল-আমিন চৌধুরী | শুক্রবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ

ভাষা আন্দোলনের দার্শনিক ভিত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, .মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, .মুহম্মদ এনামুল হক, অধ্যক্ষ আবুল কাসেম প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

বহুভাষাবিদ পন্ডিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ১৯১৪ সালে বি.. পাশ করে চট্টল মনীষা মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর পরামর্শে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯১৫১৯১৯ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের বসিরহাট কোর্টে ওকালতি করেন। ১৯১৯ সালেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। স্কুল শিক্ষক থেকে ওকালতি, বাড়তি রোজগার হলেও তাতে তাঁর মন বসেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ও গবেষণাতেই স্থিত ছিলেন জীবন সায়াহ্‌্ন পর্যন্ত। বাংলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদুল্লাহর নামে স্থাপনা রয়েছে। চট্টগ্রামের হাটহাজারীর গড়দুয়ারায় ১৯৬৪ সালে নয়া বাংলা সম্পাদক আবদুল্লাহ আল ছগীর, আসকর বলী, অধ্যাপক আহমদ হোসেন ও সমাজসেবী ফজলুল হক প্রমুখ মিলে গড়ে তুলেছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্‌্লাহ একাডেমী। এসব বেশ আগের ঘটনা। ২০১৩ সালে দেওয়ান বাজার সিএন্ডবি কলোনী স্কুলের শিক্ষক বাবু অভিজিৎ চক্রবর্তী, . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মৃতি কর্ম ও গবেষণা ফাউন্ডেশন, চট্টগ্রাম নামে একটি সংগঠন গড়তে উদ্যোগী হলেন। অভিজিৎ বাবু আমার স্ত্রী রোকেয়ার সহকর্মী। দুজনই একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। সে সুবাদে আমার সাথে আলাপ পরিচয়। অভিজিৎ বাবু একদিন বাসায় এসে আমাকে তাঁর অভিপ্রায়ের কথা জানালেন। তিনি এ সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে শহীদুল্লাহ পরিবারের সম্মতি আদায়ের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন এবং এ ব্যাপারে তাকে সহযোগিতার অনুরোধ করলেন।

আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ১৯৮৬ সাল থেকে অদ্যাবধি সিনেট সদস্য। সে সুবাদে ড. শহীদুল্লাহর ছেলে খ্যাতিমান শিল্পী চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক মুর্তজা বশীরের সাথে আলাপ পরিচয় ছিল। অধিকন্তু আমার বাবা আবদুল হক চৌধুরীর ১৯৮০ সালে প্রকাশিত চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি গ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী মুর্তজা বশীর সে সুবাদে পরিচয় আবদারঅনুরোধ করার পর্যায়েরই ছিল। তবুও কেন জানি সংকোচবোধ হল। আমি তাঁর সহকর্মী চবি চারুকলার প্রফেসর মিজানুর রহিম এবং চবি জাদুঘরের অবসরপ্রাপ্ত উপ পরিচালক ড. শামসুল হোসাইন বাহাদুর ভাইকে মুর্তজা বশীর সাহেবের সাথে বিষয়টি আলোচনার জন্য অনুরোধ করি। ‘শুভস্য শীঘ্রম’ সংস্কৃত উক্তিটি যেন আচমকা ঘটে গেল। মুর্তজা বশীর লিখিত সম্মতি দিলেন চট্টগ্রামে অভিজিৎ বাবুর প্রস্তাবিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মৃতি কর্ম ও গবেষণা ফাউন্ডেশন গঠনের জন্য। এ সংগঠন ইতিমধ্যে তাদের সংখ্যাধিক্য নয় গুণমান সম্মত কর্ম তৎপরতার মাধ্যমে সংস্কৃতি সেবী মহলে নিজেদের উজ্জ্বলতর অবস্থান সৃষ্টি করেছেএটা হচ্ছে প্রাপ্তি।

. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এবং মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী দু’জনই বেশভূষায় দাড়িটুপিওয়ালা। তাঁরা উভয়েই যুক্তিবাদী ইসলামে বিশ্বাসী। বিজ্ঞান মনস্ক ও সংস্কার মুক্ত মানুষ। মাওলানা শহীদুল্লাহকে স্নেহ করতেন। শহীদুল্লাহ ইসলামাবাদীকে ভক্তি করতেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক, সাহিত্য চর্চা, প্রকাশনা, মিশনারী ইত্যাকার কাজে তাদের জোটবদ্ধতা ছিল। মওলানার মাধ্যম্‌েই শহীদুল্লাহ সাহেবের চট্টগ্রামের সাথে যোগসূত্র। লক্ষ্যণীয় যে শহীদুল্লাহর প্রথম পেশা শিক্ষকতা চট্টগ্রামে। তাঁর পুত্র মুর্তজা বশীরের জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় এবং মুর্তজা বশিরের মেয়ে মুনিজা বশীরের বিয়ে হয় চট্টগ্রামের খ্যাতিমান আইনজীবী মরহুম এ.এন.এম. খালেদ চৌধুরীর ছেলে ব্যাংকার কায়েস চৌধুরীর সাথে। চট্টগ্রামের সাথে শহীদুল্লাহ পরিবারের পেশাগত এবং নাতনীর বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়তা রয়েছে। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্মৃতি কর্ম ও গবেষণা ফাউন্ডেশন যেন সে ধারাবাহিকতায় নবতর সংযোজন।

আজীবন ভাষা প্রেমী, জাতীয়তাবাদী, নিবেদিত প্রাণ গবেষক মনীষী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বায়ান্নের একুশে ফেব্রুয়ারী ঢাকার রাজপথে আবুল বারাকাত শহীদ হলেন। সে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুর্তজা বশীরের বর্ণনা: ‘… হঠাৎ গুলির শব্দ দৌড়ে পালাতে লাগল সবাই। চারদিকে আতঙ্ক। মুর্তজা বশীরের চোখের সামনে ঘটে যাচ্ছে এসব। আত্মরক্ষার জন্য সবাই খুঁজছে নিরাপদ আশ্রয়। ব্যারাকের দক্ষিণ দিকে চলমান ভিড় দেখে তিনি দৌড়ে এগিয়ে গেলেন। তাঁর ভাষায়, ‘বেশ লম্বা, শ্যামবর্ণ, মুখমন্ডল পরিষ্কারভাবে কামানো, সারা চেহারায় বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটায় ভরে যাওয়া ঘাম আর প্যান্টের পেটের নিচ থেকে কলের মতো অঝোরে রক্তের ঢল। সবার সঙ্গে আমিও তাকে ধরেছি। আমার সাদা পায়জামায় কে যেন আবিরের রং পিচকিরি দিয়ে রাঙিয়ে দিল। আমি তাকে ধরেছি বুকের কাছে। আমার মাথা তার মুখের কাছে। সে চোখ তুলে তাকাল। . . . আমার বাড়িতে খবর দেবেন আমার নাম আবুল বরকত. . . । ‘পৃথিবীতে ভাষার ইতিহাসের প্রথম শহীদ আবুল বরকত শুকনো জিব বের করে বললেন, ‘পানি পানি’। বুলেটবিদ্ধ তাঁকে সতীর্থরা ধরে নিয়ে যাচ্ছেন মেডিকেলে। বশীরও তাঁকে বুকের কাছে জাপটে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। দ্বিধান্বিত হয়ে পকেটে রাখা ঘাম মোছার রুমাল বের করে নিংড়িয়ে তাঁর মুখে দিয়ে কিছুটা তৃষ্ণা নিবারণের চেষ্টা করলেন। এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও তো নেই।

সে দিন নিমতলীর জাদুঘরে ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করার কথা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনরের পত্নী লেডি ভিকারুননিসা নূনের। হাসপাতালে আবুল বরকতকে রেখে চিত্র প্রদর্শনীর হলে এলেন বশীর। বরকতের রক্তে তাঁর কাপড় লাল। তিনি প্রতিবাদ করলেন। বললেন তাঁর ছবি এখানে প্রদর্শন করবেন না। তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন আমিনুল ইসলাম, রশিদ চৌধুরী, সৈয়দ জাহাঙ্গীর, আবদুর রাজ্জাকসহ অন্য শিল্পীরাও। সবার একই কথা, এই পরিস্থিতিতে কিছুতেই প্রদর্শনীর উদ্বোধন হতে পারে না। মুর্তজা বশীর এবং আরও কয়েকজন প্রদর্শনকক্ষে গিয়ে নিজেদের ছবি দেয়াল থেকে নামিয়ে নিয়ে এলেন। প্রদর্শনী বন্ধ করা হলো।

আবদুল রাজ্জাকের সঙ্গে রিকশায় বশীর রওনা দিলেন বাড়ির দিকে। সাদা পায়জামা ও চকলেট রঙের শার্টের বুকে আবুল বরকতের তাজা রক্ত। এর চেয়ে মহৎ চিত্রকর্ম আর কী হতে পারে। পিতা জ্ঞানতাপস ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কনিষ্ঠ পুত্রের অপেক্ষায় ঘরে পায়চারি করছিলেন। বাড়ির দরজায় পুত্রকে সারা দিন পর দেখে রেগে গেলেন। ধমক দিলেন অভিমানে পুত্র তাঁর হাতের মুঠোয় রাখা শহীদ আবুল বরকতের তাজা রক্তমাখা রুমালটি মেলে ধরলেন মুহুর্তেই পরিবেশটি পুরোপুরি পাল্টে গেল। মারা গেছে কেউ? জানতে চাইলেন তাঁর পিতা। তিনি মাথা নাড়ালেন। ঘর থেকে যখন বেরিয়ে আসছিলেন বশীর। ড. শহীদুল্লাহ বললেন, ‘দাঁড়াও।’ তাঁর মাকে বললেন ‘আমার কালো আচকানটা কই? চামড়ার স্যুটকেস থেকে বের করে দিলেন তাঁর কালো আচকানটি। সেটা নিয়ে নিজেই দাড়ি ছাঁটার ছোট কাঁচি দিয়ে নিচের অংশের একটু টুকরো কেটে পুত্রের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমার হাতে বেঁধে দাও।’ শহীদের রক্তাক্ত রুমালের বিনিময়ে মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নীরব প্রতিবাদ শুধু কালো ব্যাজ ধারণ করার মধ্যে আটকে থাকেনি। এই ‘কালো ব্যাজ’ পরবর্তী সময়ে জাতীয় ঘৃণা ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে উঠে। ” (একুশের চিত্র ভাষ্যকারনাছির আলী মামুন, প্রথমআলো ২১ ফেব্রুয়ারী ২০১৬)

বরকত তথা ভাষা শহীদের সেই রক্তের কথা কবি আল মাহমুদের কথায়:

ফেব্রুয়ারীর একুশ তারিখ

দুপুর বেলার অক্ত

বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?

বরকতের রক্ত’ (একুশের কবিতা, আল মাহমুদ)

ভাষা প্রেমী শহীদুল্লাহ এবং ভাষা সৈনিক মুর্তজা বশীরের এ প্রতিবাদ, ক্রোধ ক্ষোভ ও ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া বাংলা ভাষাভাসী মানুষ চিরদিন শ্রদ্ধায় ভালবাসায় স্মরণ করবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, ঘাসফুল ও সিনেট সদস্য,

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনগরবাসীকে মশা থেকে বাঁচাতে যা করার সব করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধমাতৃভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম ও কোহিনূর প্রেস